সত্য থাকুন ধরিত্রীতে
শুষ্ক রুক্ষ ঋষির চিতে ,
জ্যামিতি আর বীজগণিতে ,
কারো ইথে আপত্তি নেই—
কিন্তু আমার প্রিয়ার কানে
এবং আমার কবির গানে
পঞ্চশরের পুষ্পবাণে
মিথ্যে থাকুন রাত্রিদিনেই ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
ওগো সত্য বেঁটেখাটো ,
বীণার তন্ত্রী যতই ছাঁটো ,
কণ্ঠ আমার যতই আঁটো ,
বলব তবু উচ্চ সুরে—
আমার প্রিয়ার মুগ্ধ দৃষ্টি
করছে ভুবন নূতন সৃষ্টি ,
মুচকি হাসির সুধার বৃষ্টি
চলছে আজি জগৎ জুড়ে ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
যদি বল ‘ আর বছরে
এই কথাটাই এমনি করে
বলেছিলি , কিন্তু ওরে
শুনেছিলেন আরেক জনে’—
জেনো তবে মূঢ়মত্ত ,
আর বসন্তে সেটাই সত্য ,
এবারো সেই প্রাচীন তত্ত্ব
ফুটল নূতন চোখের কোণে ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
আজ বসন্তে বকুল ফুলে
যে গান বায়ু বেড়ায় বুলে
কাল সকালে যাবে ভুলে—
কোথায় বাতাস, কোথায় সে ফুল !
হে সুন্দরী , তেমনি কবে
এ – সব কথা ভুলব যবে
মনে রেখো আমায় তবে—
ক্ষমা কোরো আমার সে ভুল ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
অনবসর
ছেড়ে গেলে হে চঞ্চলা ,
হে পুরাতন সহচরী !
ইচ্ছা বটে বছর কতক
তোমার জন্য বিলাপ করি ,
সোনার স্মৃতি গড়িয়ে তোমার
বসিয়ে রাখি চিত্ততলে ,
একলা ঘরে সাজাই তোমায়
মাল্য গেঁথে অশ্রুজলে—
নিদেন কাঁদি মাসেক – খানেক
তোমায় চির – আপন জেনেই—
হায় রে আমার হতভাগ্য !
সময় যে নেই , সময় যে নেই ।
বর্ষে বর্ষে বয়স কাটে ,
বসন্ত যায় কথায় কথায় ,
বকুলগুলো দেখতে দেখতে
ঝ’রে পড়ে যথায় তথায় ,
মাসের মধ্যে বারেক এসে
অস্তে পালায় পূর্ণ – ইন্দু ,
শাস্ত্রে শাসায় জীবন শুধু
পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দু—
তাঁদের পানে তাকাব না
তোমায় শুধু আপন জেনেই
সেটা বড়োই বর্বরতা—
সময় যে নেই , সময় যে নেই ।
এসো আমার শ্রাবণ – নিশি ,
এসো আমার শরৎলক্ষ্মী ,
এসো আমার বসন্তদিন
লয়ে তোমার পুষ্পপক্ষী ,
তুমি এসো , তুমিও এসো ,
তুমি এসো , এবং তুমি ,
প্রিয়ে , তোমরা সবাই জান
ধরণীর নাম মর্তভূমি—
যে যায় চলে বিরাগভরে
তারেই শুধু আপন জেনেই
বিলাপ করে কাটাই , এমন
সময় যে নেই , সময় যে নেই ।
ইচ্ছে করে বসে বসে
পদ্যে লিখি গৃহকোণায়
‘ তুমিই আছ জগৎ জুড়ে’—
সেটা কিন্তু মিথ্যে শোনায় ।
ইচ্ছে করে কোনোমতেই
সান্ত্বনা আর মান্ব না রে ,
এমন সময় নতুন আঁখি
তাকায় আমার গৃহদ্বারে—
চক্ষু মুছে দুয়ার খুলি
তারেই শুধু আপন জেনেই ,
কখন তবে বিলাপ করি ?
সময় যে নেই , সময় যে নেই ।
অন্তরতম
আমি যে তোমায় জানি , সে তো কেউ জানে না ।
তুমি মোর পানে চাও , সে তো কেউ মানে না ।
মোর মুখে পেলে তোমার আভাস
কত জনে কত করে পরিহাস ,
পাছে সে না পারি সহিতে
নানা ছলে তাই ডাকি যে তোমায়—
কেহ কিছু নারে কহিতে ।
তোমার পথ যে তুমি চিনায়েছ
সে কথা বলি নে কাহারে ।
সবাই ঘুমালে জনহীন রাতে
একা আসি তব দুয়ারে ।
স্তব্ধ তোমার উদার আলয় ,
বীণাটি বাজাতে মনে করি ভয় ,
চেয়ে থাকি শুধু নীরবে ।
চকিতে তোমার ছায়া দেখি যদি
ফিরে আসি তব গরবে ।
প্রভাত না হতে কখন আবার
গৃহকোণ – মাঝে আসিয়া
বাতায়নে বসি বিহ্বল বীণা
বিজনে বাজাই হাসিয়া ।
পথ দিয়ে যে বা আসে যে বা যায়
সহসা থমকি চমকিয়া চায় ,
মনে করে তারে ডেকেছি—
জানে না তো কেহ কত নাম দিয়ে
এক নামখানি ঢেকেছি ।
ভোরের গোলাপ সে গানে সহসা
সাড়া দেয় ফুলকাননে ,
ভোরের তারাটি সে গানে জাগিয়া
চেয়ে দেখে মোর আননে ।
সব সংসার কাছে আসে ঘিরে ,
প্রিয়জন সুখে ভাসে আঁখিনীরে ,
হাসি জেগে ওঠে ভবনে ।
যে নামে যে ছলে বীণাটি বাজাই
সাড়া পাই সারা ভুবনে ।
নিশীথে নিশীথে বিপুল প্রাসাদে
তোমার মহলে মহলে
হাজার হাজার সোনার প্রদীপ
জ্বলে অচপল অনলে ।
মোর দীপে জ্বেলে তাহারি আলোক
পথ দিয়ে আসি , হাসে কত লোক ,
দূরে যেতে হয় পালায়ে—
তাই তো সে শিখা ভবনশিখরে
পারি নে রাখিতে জ্বালায়ে ।
বলি নে তো কারে , সকালে বিকালে
তোমার পথের মাঝেতে
বাঁশি বুকে লয়ে বিনা কাজে আসি
বেড়াই ছদ্মসাজেতে ।
যাহা মুখে আসে গাই সেই গান
নানা রাগিণীতে দিয়ে নানা তান ,
এক গান রাখি গোপনে ।
নানা মুখপানে আঁখি মেলি চাই ,
তোমা – পানে চাই স্বপনে ।
অপটু
যতবার আজ গাঁথনু মালা
পড়ল খসে খসে
কী জানি কার দোষে !
তুমি হোথায় চোখের কোণে
দেখছ বসে বসে ।
চোখ – দুটিরে প্রিয়ে ,
শুধাও শপথ নিয়ে
আঙুল আমার আকুল হল
কাহার দৃষ্টিদোষে !
আজ যে বসে গান শোনাব
কথাই নাহি জোটে ,
কণ্ঠ নাহি ফোটে ।
মধুর হাসি খেলে তোমার
চতুর রাঙা ঠোঁটে ।
কেন এমন ত্রুটি
বলুক আঁখি – দুটি—
কেন আমার রুদ্ধ কণ্ঠে
কথাই নাহি ফোটে !
রেখে দিলাম মাল্য বীণা ,
সন্ধ্যা হয়ে আসে ।
ছুটি দাও এ দাসে—
সকল কথা বন্ধ করে
বসি পায়ের পাশে ।
নীরব ওষ্ঠ দিয়ে
পারব যে কাজ প্রিয়ে
এমন কোনো কর্ম দেহো
অকর্মণ্য দাসে ।