সোজাসুজি
হৃদয় – পানে হৃদয় টানে ,
নয়ন – পানে নয়ন ছোটে ,
দুটি প্রাণীর কাহিনীটা
এইটুকু বৈ নয়কো মোটে ।
শুক্লসন্ধ্যা চৈত্র মাসে
হেনার গন্ধ হাওয়ায় ভাসে—
আমার বাঁশি লুটায় ভূমে ,
তোমার কোলে ফুলের পুঁজি ।
তোমার আমার এই – যে প্রণয়
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
বসন্তী – রঙ বসনখানি
নেশার মতো চক্ষে ধরে ,
তোমার গাঁথা যূথীর মালা
স্তুতির মতো বক্ষে পড়ে ।
একটু দেওয়া একটু রাখা ,
একটু প্রকাশ একটু ঢাকা ,
একটু হাসি একটু শরম—
দুজনের এই বোঝাবুঝি ।
তোমার আমার এই – যে প্রণয়
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
মধুমাসের মিলন – মাঝে
মহান কোনো রহস্য নেই ,
অসীম কোনো অবোধ কথা
যায় না বেধে মনে – মনেই ।
আমাদের এই সুখের পিছু
ছায়ার মতো নাইকো কিছু ,
দোঁহার মুখে দোঁহে চেয়ে
নাই হৃদয়ের খোঁজাখুঁজি ।
মধুমাসে মোদের মিলন
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
ভাষার মধ্যে তলিয়ে গিয়ে
খুঁজি নে ভাই ভাষাতীত ,
আকাশ – পানে বাহু তুলে
চাহি নে ভাই আশাতীত ।
যেটুকু দিই যেটুকু পাই
তাহার বেশি আর কিছু নাই—
সুখের বক্ষ চেপে ধরে
করি নে কেউ যোঝাযুঝি ।
মধুমাসে মোদের মিলন
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
শুনেছিনু প্রেমের পাথার
নাইকো তাহার কোনো দিশা ,
শুনেছিনু প্রেমের মধ্যে
অসীম ক্ষুধা অসীম তৃষা—
বীণার তন্ত্রী কঠিন টানে
ছিঁড়ে পড়ে প্রেমের তানে ,
শুনেছিনু প্রেমের কুঞ্জ
অনেক বাঁকা গলিঘুঁজি ।
আমাদের এই দোঁহার মিলন
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
স্থায়ী-অস্থায়ী
তুলেছিলেম কুসুম তোমার
হে সংসার , হে লতা !
পরতে মালা বিঁধল কাঁটা
বাজল বুকে ব্যথা ,
হে সংসার , হে লতা !
বেলা যখন পড়ে এল ,
আঁধার এল ছেয়ে ,
দেখি তখন চেয়ে—
তোমার গোলাপ গেছে , আছে
আমার বুকের ব্যথা ,
হে সংসার , হে লতা !
আরো তোমার অনেক কুসুম
ফুটবে যথা – তথা—
অনেক গন্ধ , অনেক মধু ,
অনেক কোমলতা ,
হে সংসার , হে লতা !
সে ফুল তোলার সময় তো আর
নাহি আমার হাতে ।
আজকে আঁধার রাতে
আমার গোলাপ গেছে , কেবল
আছে বুকের ব্যথা ,
হে সংসার , হে লতা !
স্বল্পশেষ
অধিক কিছু নেই গো কিছু নেই ,
কিছু নেই—
যা আছে তা এই গো শুধু এই ,
শুধু এই ।
যা ছিল তা শেষ করেছি
একটি বসন্তেই ।
আজ যা কিছু বাকি আছে
সামান্য এই দান—
তাই নিয়ে কি রচি দিব
একটি ছোটো গান ?
একটি ছোটো মালা তোমার
হাতের হবে বালা ।
একটি ছোটো ফুল তোমার
কানের হবে দুল ।
একটি তরুলতায় ব’সে
একটি ছোটো খেলায়
হারিয়ে দিয়ে যাবে মোরে
একটি সন্ধেবেলায় ।
অধিক কিছু নেই গো কিছু নেই ,
কিছু নেই ।
যা আছে তা এই গো শুধু এই ,
শুধু এই ।
ঘাটে আমি একলা বসে রই ,
ওগো আয় !
বর্ষানদী পার হবি কি ওই—
হায় গো হায় !
অকূল – মাঝে ভাসবি কে গো
ভেলার ভরসায় ।
আমার তরীখান
সইবে না তুফান ;
তবু যদি লীলাভরে
চরণ কর দান ,
শান্ত তীরে তীরে তোমায়
বাইব ধীরে ধীরে ।
একটি কুমুদ তুলে তোমার
পরিয়ে দেব চুলে ।
ভেসে ভেসে শুনবে বসে
কত কোকিল ডাকে
কূলে কূলে কুঞ্জবনে
নীপের শাখে শাখে ।
ক্ষুদ্র আমার তরীখানি—
সত্য করি কই ,
হায় গো পথিক , হায় ,
তোমায় নিয়ে একলা নায়ে
পার হব না ওই
আকুল যমুনায় ।
০১.উৎসর্গ (ক্ষণিকা)
ক্ষণিকারে দেখেছিলে
ক্ষণিক বেশে কাঁচা খাতায় ,
সাজিয়ে তারে এনে দিলেম
ছাপা বইয়ের বাঁধা পাতায় ।
আশা করি নিদেন – পক্ষে
ছ’টা মাস কি এক বছরই
হবে তোমার বিজন – বাসে
সিগারেটের সহচরী ।
কতকটা তার ধোঁয়ার সঙ্গ
স্বপ্নলোকে উড়ে যাবে—
কতকটা কি অগ্নিকণায়
ক্ষণে ক্ষণে দীপ্তি পাবে ?
কতকটা বা ছাইয়ের সঙ্গে
আপনি খসে পড়বে ধুলোয় ,
তার পরে সে ঝেঁটিয়ে নিয়ে
বিদায় কোরো ভাঙা কুলোয় ।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর