কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোথায় পাবি প্রাণ ?
যেথায় সুখে তরুণ যুগল
পাগল হয়ে বেড়ায় ,
আড়াল বুঝে আঁধার খুঁজে
সবার আঁখি এড়ায় ,
পাখি তোদের শোনায় গীতি ,
নদী শোনায় গাথা ,
কত রকম ছন্দ শোনায়
পুষ্প লতা পাতা—
সেইখানেতে সরল হাসি
সজল চোখের কাছে
বিশ্ববাঁশির ধ্বনির মাঝে
যেতে কি সাধ আছে ?
হঠাৎ উঠে উচ্ছ্বসিয়া
কহে আমার গান—
সেইখানে মোর স্থান ।
যাত্রী
আছে , আছে স্থান !
একা তুমি , তোমার শুধু
একটি আঁটি ধান ।
নাহয় হবে , ঘেঁষাঘঁষি ,
এমন কিছু নয় সে বেশি ,
নাহয় কিছু ভারী হবে
আমার তরীখান—
তাই বলে কি ফিরবে তুমি
আছে , আছে স্থান !
এসো , এসো নায়ে !
ধুলা যদি থাকে কিছু
থাক্ – না ধূলা পায়ে ।
তনু তোমার তনুলতা ,
চোখের কোণে চঞ্চলতা ,
সজলনীল – জলদ – বরন
বসনখানি গায়ে—
তোমার তরে হবে গো ঠাঁই—
এসো এসো নায়ে ।
যাত্রী আছে নানা ,
নানা ঘাটে যাবে তারা
কেউ কারো নয় জানা ।
তুমিও গো ক্ষণেক – তরে
বসবে আমার তরী -‘ পরে ,
যাত্রা যখন ফুরিয়ে যাবে ,
মান্বে না মোর মানা—
এলে যদি তুমিও এসো ,
যাত্রী আছে নানা ।
কোথা তোমার স্থান ?
কোন্ গোলাতে রাখতে যাবে
একটি আঁটি ধান ?
বলতে যদি না চাও তবে
শুনে আমার কী ফল হবে ,
ভাবব ব’সে খেয়া যখন
করব অবসান—
কোন্ পাড়াতে যাবে তুমি ,
কোথা তোমার স্থান ?
যুগল
ঠাকুর , তব পায়ে নমোনমঃ ,
পাপিষ্ঠ এই অক্ষমেরে ক্ষম ,
আজ বসন্তে বিনয় রাখো মম—
বন্ধ করো শ্রীমদ্ভাগবত ।
শাস্ত্র যদি নেহাত পড়তে হবে
গীত – গোবিন্দ খোলা হোক – না তবে ।
শপথ মম , বোলো না এই ভবে
জীবনখানা শুধুই স্বপ্নবৎ ।
একটা দিনের সন্ধি করিয়াছি ,
বন্ধ আছে যমরাজের সমর—
আজকে শুধু এক বেলারই তরে
আমরা দোঁহে অমর দোঁহে অমর ।
স্বয়ং যদি আসেন আজি দ্বারে
মান্ব নাকো রাজার দারোগারে—
কেল্লা হতে ফৌজ সারে সারে
দাঁড়ায় যদি , ওঁচায় ছোরা – ছুরি ,
বলব , ‘ রে ভাই , বেজার কোরো নাকো ,
গোল হতেছে , একটু থেমে থাকো ,
কৃপাণ – খোলা শিশুর খেলা রাখো
খ্যাপার মতো কামান – ছোঁড়াছুঁড়ি ।
একটুখানি সরে গিয়ে করো
সঙের মতো সঙিন ঝম – ঝমর ।
আজকে শুধু এক বেলারই তরে
আমরা দোঁহে অমর দোঁহে অমর । ‘
বন্ধুজনে যদি পুণ্যফলে
করেন দয়া , আসেন দলে দলে ,
গলায় বস্ত্র কব নয়নজলে ,
‘ ভাগ্য নামে অতিবর্ষা – সম !
এক দিনেতে অধিক মেশামেশি
শ্রান্তি বড়োই আনে শেষাশেষি ,
জান তো ভাই , দুটি প্রাণীর বেশি
এ কুলায়ে কুলায় নাকো মম ।
ফাগুন – মাসে ঘরের টানাটানি—
অনেক চাঁপা , অনেকগুলি ভ্রমর ।
ক্ষুদ্র আমার এই অমরাবতী—
আমরা দুটি অমর , দুটি অমর ।
যৌবনবিদায়
ওগো যৌবনতরী ,
এবার বোঝাই সাঙ্গ করে দিলেম বিদায় করি ।
কতই খেয়া , কতই খেয়াল ,
কতই – না দাঁড় – বাওয়া—
তোমার পালে লেগেছিল
কত দখিন হাওয়া !
কত ঢেউয়ের টল্মলানি
কত স্রোতের টান—
পূর্ণিমাতে সাগর হতে
কত পাগল বান !
এ পার হতে ও পার ছেয়ে
ঘন মেঘের সারি ,
শ্রাবণ – দিনে ভরা গাঙে
দু – কূল – হারা পাড়ি ।
অনেক খেলা , অনেক মেলা
সকলি শেষ ক’রে
চল্লিশেরই ঘাটের থেকে
বিদায় দিনু তোরে ।
ওগো তরুণ তরী ,
যৌবনেরই শেষ কটি গান দিনু বোঝাই করি ।
সে – সব দিনের কান্না হাসি ,
সত্য মিথ্যা ফাঁকি ,
নিঃশেষিয়ে যাস রে নিয়ে
রাখিস নে আর বাকি ।
নোঙর দিয়ে বাঁধিস নে আর
চাহিস নে আর পাছে—
ফিরে ফিরে ঘুরিস নে আর
ঘাটের কাছে কাছে ।
এখন হতে ভাঁটার স্রোতে
ছিন্ন পালটি তুলে
ভেসে যা রে স্বপ্ন – সমান
অস্তাচলের কূলে ।
সেথায় সোনা – মেঘের ঘাটে
নামিয়ে দিয়ো শেষে
বহুদিনের বোঝা তোমার
চিরনিদ্রার দেশে ।
ওরে আমার তরী ,
পারে যাবার উঠল হাওয়া , ছোট্ রে ত্বরা করি ।
যেদিন খেয়া ধরেছিলেম
ছায়াবটের ধারে ,
ভোরের সুরে ডেকেছিলেম
‘ কে যাবি আয় পারে’ ।
ভেবেছিলেম ঘাটে ঘাটে
করতে আনাগোনা
এমন চরণ পড়বে নায়ে
নৌকো হবে সোনা ।
এতবারের পারাপারে ,
এত লোকের ভিড়ে ,
সোনা – করা দুটি চরণ
দেয় নি পরশ কি রে ?
যদি চরণ পড়ে থাকে
কোনো একটি বারে
যা রে সোনার জন্ম নিয়ে
সোনার মৃত্যু – পারে ।
শাস্ত্র
পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যাবে
এমন কথা শাস্ত্রে বলে ,
আমরা বলি বানপ্রস্থ
যৌবনেতেই ভালো চলে ।
বনে এত বকুল ফোটে ,
গেয়ে মরে কোকিল পাখি ,
লতাপাতার অন্তরালে
বড়ো সরস ঢাকাঢাকি ।
চাঁপার শাখে চাঁদের আলো ,
সে সৃষ্টি কি কেবল মিছে ?
এ – সব যারা বোঝে তারা
পঞ্চাশতের অনেক নীচে ।
পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যাবে
এমন কথা শাস্ত্রে বলে ,
আমরা বলি বানপ্রস্থ
যৌবনেতেই ভালো চলে ।
ঘরের মধ্যে বকাবকি ,
নানান মুখে নানা কথা ।
হাজার লোকে নজর পাড়ে ,
একটুকু নাই বিরলতা ।
সময় অল্প , ফুরায় তাও
অরসিকের আনাগোনায়—
ঘণ্টা ধরে থাকেন তিনি
সৎপ্রসঙ্গ – আলোচনায় ।
হতভাগ্য নবীন যুবা
কাছেই থাকে বনের খোঁজে ,
ঘরের মধ্যে মুক্তি যে নেই
এ কথা সে বিশেষ বোঝে ।
পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যাবে
এমন কথা শাস্ত্রে বলে ,
আমরা বলি বানপ্রস্থ
যৌবনেতেই ভালো চলে ।
আমরা সবাই নব্যকালের
সভ্য যুবা অনাচারী ,
মনুর শাস্ত্র শুধরে দিয়ে
নতুন বিধি করব জারি—
বুড়ো থাকুন ঘরের কোণে ,
পয়সাকড়ি করুন জমা ,
দেখুন বসে বিষয় – পত্র ,
চালান মামলা – মকদ্দমা ,
ফাগুন – মাসে লগ্ন দেখে
যুবারা যাক বনের পথে ,
রাত্রি জেগে সাধ্যসাধন
থাকুক রত কঠিন ব্রতে ।
পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যাবে
এমন কথা শাস্ত্রে বলে ,
আমরা বলি বানপ্রস্থ
যৌবনেতেই ভালো চলে ।