পাড়ার যত জ্ঞানীগুণীর সাথে
নষ্ট হল দিনের পর দিন—
অনেক শিখে পক্ব হল মাথা
অনেক দেখে দৃষ্টি হল ক্ষীণ ,
কত কালের কত মন্দ ভালো
বসে বসে কেবল জমা করি ,
ফেলাছড়া – ভাঙাছেঁড়ার বোঝা
বুকের মাঝে উঠছে ভরি ভরি ,
গুঁড়িয়ে সে – সব উড়িয়ে ফেলে দিক
দিক্ – বিদিকে তোদের ঝোড়ো হাওয়া ।
বুঝেছি ভাই , সুখের মধ্যে সুখ
মাতাল হয়ে পাতাল – পানে ধাওয়া ।
হোক রে সিধা কুটিল দ্বিধা যত ,
নেশায় মোরে করুক দিশাহারা ,
দানোয় এসে হঠাৎ কেশে ধরে
এক দমকে করুক লক্ষ্মীছাড়া ।
সংসারেতে সংসারী তো ঢের
কাজের হাটে অনেক আছে কেজো ,
মেলাই আছে মস্ত বড়ো লোক—
সঙ্গ তাঁদের অনেক সেজো মেজো ।
থাকুন তাঁরা ভবের কাজে লেগে ,
লাগুক মোরে সৃষ্টিছাড়া হাওয়া—
বুঝেছি ভাই , কাজের মধ্যে কাজ
মাতাল হয়ে পাতাল – পানে ধাওয়া ।
শপথ করে দিলাম ছেড়ে আজই
যা আছে মোর বুদ্ধি বিবেচনা ,
বিদ্যা যত ফেলব ঝেড়ে ঝুড়ে
ছেড়ে ছুড়ে তত্ত্ব – আলোচনা ।
স্মৃতির ঝারি উপুড় করে ফেলে
নয়নবারি শূন্য করি দিব ,
উচ্ছ্বসিত মদের ফেনা দিয়ে
অট্টহাসি শোধন করি নিব ।
ভদ্রলোকের তকমা – তাবিজ ছিঁড়ে
উড়িয়ে দেবে মদোন্মত্ত হাওয়া ,
শপথ করে বিপথ – ব্রত নেব—
মাতাল হয়ে পাতাল – পানে ধাওয়া ।
মেঘমুক্ত
ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে ,
আয় গো আয়—
কাঁচা রোদখানি পড়েছে বনের
ভিজে পাতায় ।
ঝিকিঝিকি করি কাঁপিতেছে বট ,
ওগো ঘাটে আয় , নিয়ে আয় ঘট—
পথের দু ধারে শাখে শাখে আজি
পাখিরা গায় ।
ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে ,
আয় গো আয় ।
তোমাদের সেই ছায়া – ঘেরা দিঘি ,
না আছে তল—
কূলে কূলে তার ছেপে ছেপে আজি
উঠেছে জল ।
এ ঘাট হইতে ও ঘাটে তাহার
কথা – বলাবলি নাহি চলে আর
একাকার হল তীরে আর নীরে
তাল – তলায় ।
আজ ভোর হতে নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
ঘাটে পঁইঠায় বসিবি বিরলে
ডুবায়ে গলা ,
হবে পুরাতন প্রাণের কথাটি
নূতন বলা ।
সে কথার সাথে রেখে রেখে মিল
থেকে থেকে ডেকে উঠিবে কোকিল ,
কানাকানি করে ভেসে যাবে মেঘ
আকাশ – গায় ।
আজ ভোর থেকে নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
তপন – আতপে আতপ্ত হয়ে
উঠেছে বেলা ;
খঞ্জন দুটি আলস্যভরে
ছেড়েছে খেলা ।
কলস পাকড়ি আঁকড়িয়া বুকে
ভরা জলে তোরা ভেসে যাবি সুখে ,
তিমিরনিবিড় ঘনঘোর ঘুমে
স্বপনপ্রায় ।
আজ ভোর থেকে নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
মেঘ ছুটে গেল নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
আজিকে সকালে শিথিল কোমল
বহিছে বায় ।
পতঙ্গ যেন ছবিসম আঁকা
শৈবাল -‘ পরে মেলে আছে পাখা ,
জলের কিনারে বসে আছে বক
গাছের ছায় ।
আজ ভোর হতে নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
যথাসময়
ভাগ্য যখন কৃপণ হয়ে আসে ,
বিশ্ব যবে নিঃস্ব তিলে তিলে ,
মিষ্ট মুখে ভুবন – ভরা হাসি
ওষ্ঠে শেষে ওজন – দরে মিলে ,
বন্ধুজনে বন্ধ করে প্রাণ ,
দীর্ঘদিন সঙ্গীহীন একা ,
হঠাৎ পড়ে ঋণশোধেরই পালা ,
ঋণীজনের না যায় পাওয়া দেখা ,
তখন ঘরে বন্ধ হ রে কবি ,
খিলের পরে খিল লাগাও খিল ।
কথার সাথে গাঁথো কথার মালা ,
মিলের সাথে মিল মিলাও মিল ।
কপাল যদি আবার ফিরে যায় ,
প্রভাত – কালে হঠাৎ জাগরণে ,
শূন্য নদী আবার যদি ভরে
শরৎ – মেঘে ত্বরিত বরিষনে ,
বন্ধু ফিরে বন্দী করে বুকে ,
সন্ধি করে অন্ধ অরিদল ,
অরুণ ঠোঁটে তরুণ ফোটে হাসি ,
কাজল চোখে করুণ আঁখিজল ,
তখন খাতা পোড়াও খ্যাপা কবি ,
দিলের সাথে দিল লাগাও দিল ।
বাহুর সাথে বাঁধো মৃণাল – বাহু ,
চোখের সাথে চোখে মিলাও মিল ।
যথাস্থান
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোন্খানে তোর স্থান ?
পন্ডিতেরা থাকেন যেথায়
বিদ্যেরত্ন – পাড়ায়—
নস্য উড়ে আকাশ জুড়ে
কাহার সাধ্য দাঁড়ায় ,
চলছে সেথায় সূক্ষ্ম তর্ক
সদাই দিবারাত্র
‘ পাত্রাধার কি তৈল কিম্বা
তৈলাধার কি পাত্র’ ।
পুঁথিপত্র মেলাই আছে
মোহধ্বান্তনাশন ,
তারি মধ্যে একটি প্রান্তে
পেতে চাস কি আসন ?
গান তা শুনি গুঞ্জরিয়া
গুঞ্জরিয়া কহে—
নহে নহে নহে ।
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোন্ দিকে তোর টান ?
পাষাণ – গাঁথা প্রাসাদ -‘ পরে
আছেন ভাগ্যবন্ত ,
মেহাগিনির মঞ্চ জুড়ি
পঞ্চ হাজার গ্রন্থ—
সোনার জলে দাগ পড়ে না ,
খোলে না কেউ পাতা ,
অ – স্বাদিতমধু যেমন
যূথী অনাঘ্রাতা ।
ভৃত্য নিত্য ধুলা ঝাড়ে
যত্ন পুরা মাত্রা ,
ওরে আমার ছন্দোময়ী ,
সেথায় করবি যাত্রা ?
গান তা শুনি কর্ণমূলে
মর্মরিয়া কহে—
নহে নহে নহে ।
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোথায় পাবি মান ?
নবীন ছাত্র ঝুঁকে আছে
এক্জামিনের পড়ায় ,
মনটা কিন্তু কোথা থেকে
কোন্ দিকে যে গড়ায় ,
অপাঠ্য সব পাঠ্য কেতাব
সামনে আছে খোলা ,
কর্তৃজনের ভয়ে কাব্য
কুলুঙ্গিতে তোলা—
সেইখানেতে ছেঁড়াছড়া
এলোমোলোর মেলা ,
তারি মধ্যে ওরে চপল ,
করবি কি তুই খেলা ?
গান তা শুনে মৌনমুখে
রহে দ্বিধার ভরে—
যাব – যাব করে ।
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোথায় পাবি ত্রাণ ?
ভান্ডারেতে লক্ষ্মী বধূ
যেথায় আছে কাজে ,
ঘরে ধায় সে ছুটি পায় সে
যখন মাঝে মাঝে ,
বালিশ – তলে বইটি চাপা
টানিয়া লয় তারে ,
পাতাগুলিন ছেঁড়াখোঁড়া
শিশুর অত্যাচারে—
কাজল – আঁকা সিঁদুরমাখা
চুলের – গন্ধে – ভরা
শয্যাপ্রান্তে ছিন্ন বেশে
চাস কি যেতে ত্বরা ?
বুকের ‘পরে নিশ্বসিয়া
স্তব্ধ রহে গান—
লোভে কম্পমান ।