তোমার মাপে হয় নি সবাই
তুমিও হও নি সবার মাপে ,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে—
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি ?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি ।
আকাশ তবু সুনীল থাকে ,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো ,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো ।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর ।
মনেরে তাই কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।
নিজের ছায়া মস্ত করে
অস্তাচলে বসে বসে
আঁধার করে তোল যদি
জীবনখানা নিজের দোষে ,
বিধির সঙ্গ বিবাদ করে
নিজের পায়েই কুড়ুল মার ,
দোহাই তবে এ কার্যটা
যত শীঘ্র পার সারো ।
খুব খানিকটে কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া
মনের সঙ্গ এক রকমে
করে নে ভাই , বোঝাপড়া ।
তাহার পরে আঁধার ঘরে
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো—
ভুলে যা ভাই , কাহার সঙ্গে
কতটুকুন তফাত হল ।
মনেরে তাই কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।
ভর্ৎসনা
মিথ্যা আমায় কেন শরম দিলে
চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারে !
আমি তোমার পাড়ার প্রান্ত দিয়ে
চলেছিলেম আপন গৃহদ্বারে —
যেথা আমার বাঁধা ঘাটের কাছে
দুটি চাঁপায় ছায়া করে আছে ,
জামের শাখা ফলে – আঁধার – করা
স্বচ্ছগভীর পদ্মদিঘির ধারে ।
তুমি আমায় কেন শরম দিলে
চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারে !
আজ তো আমি মাটির পানে চেয়ে
দীনবেশে যাই নি তোমার ঘরে ।
অতিথ হয়ে দিই নি দ্বারে সাড়া ,
ভিক্ষাপাত্র নিই নি কাতর – করে ।
আমি আমার পথে যেতে যেতে
তোমার ঘরের দ্বারের বাহিরেতে
ঘনশ্যামল তমাল – তরুমূলে
দাঁড়িয়েছি এই দণ্ড – দুয়ের তরে ।
নতশিরে দুখানি হাত জুড়ি
দীনবেশে যাই নি তোমার ঘরে ।
আমি তোমার ফুল্ল পুষ্পবনে
তুলি নাই তো যূথীর একটি দল ।
আমি তোমার ফলের শাখা হতে
ক্ষুধাভরে ছিঁড়ি নাই তো ফল ।
আছি শুধু পথের প্রান্তদেশে
দাঁড়ায় যেথা সকল পান্থ এসে ,
নিয়েছি এই শুধু গাছের ছায়া—
পেয়েছি এই তরুণ তৃণতল ।
আমি তোমার ফুল্ল পুষ্পবনে
তুলি নাই তো যূথীর একটি দল ।
শ্রান্ত বটে আছে চরণ মম ,
পথের পঙ্ক লেগেছে দুই পায় ।
আষাঢ় – মেঘে হঠাৎ এল ধারা
আকাশ – ভাঙা বিপুল বরষায় ।
ঝোড়ো হাওয়ার এলোমেলো তালে
উঠল নৃত্য বাঁশের ডালে ডালে ,
ছুটল বেগে ঘন মেঘের শ্রেণী
ভগ্নরণে ছিন্নকেতুর প্রায় ।
শ্রান্ত বটে আছে চরণ মম ,
পথের পঙ্ক লেগেছে দুই পায় ।
কেমন করে জানব মনে আমি
কী যে আমায় ভাবলে মনে মনে ।
কাহার লাগি একলা ছিলে বসে
মুক্তকেশে আপন বাতায়নে ।
তড়িৎশিখা ক্ষণিক দীপ্তালোকে
হানতেছিল চমক তোমার চোখে ,
জানত কে বা দেখতে পাবে তুমি
আছি আমি কোথায় যে কোন্ কোণে ।
কেমন করে জানব মনে আমি
আমায় কী যে ভাবলে মনে মনে ।
বুঝি গো দিন ফুরিয়ে গেল আজি ,
এখনো মেঘ আছে আকাশ ভরে ।
থেমে এল বাতাস বেণুবনে ,
মাঠের ‘পরে বৃষ্টি এল ধরে ।
তোমার ছায়া দিলেম তবে ছাড়ি ,
লও গো তোমার ভূমি – আসন কাড়ি ,
সন্ধ্যা হল— দুয়ার করো রোধ ,
যাব আমি আপন পথ -‘ পরে ।
বুঝি গো দিন ফুরিয়ে গেল আজি ,
এখনো মেঘ আছে আকাশ ভরে ।
মিথ্যা আমায় কেন শরম দিলে
চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারে !
আছে আমার নতুন – ছাওয়া ঘর
পাড়ার পরে পদ্মদিঘির ধারে ।
কুটিরতলে দিবস হলে গত
জ্বলে প্রদীপ ধ্রুবতারার মতো ,
আমি কারো চাই নে কোনো দান
কাঙালবেশে কোনো ঘরের দ্বারে ।
মিথ্যা আমায় কেন শরম দিলে
চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারে !
ভীরুতা
গভীর সুরে গভীর কথা
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই ।
মনে মনে হাসবি কিনা
বুঝব কেমন করে ?
আপনি হেসে তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই—
ঠাট্টা করে ওড়াই সখী ,
নিজের কথাটাই ।
হাল্কা তুমি কর পাছে
হাল্কা করি ভাই ,
আপন ব্যথাটাই ।
সত্য কথা সরলভাবে
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই ।
অবিশ্বাসে হাসবি কিনা
বুঝব কেমন করে ?
মিথ্যা ছলে তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই ,
উল্টা করে বলি আমি
সহজ কথাটাই ।
ব্যর্থ তুমি কর পাছে
ব্যর্থ করি ভাই ,
আপন ব্যথাটাই ।
সোহাগ – ভরা প্রাণের কথা
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই ।
সোহাগ ফিরে পাব কিনা
বুঝব কেমন করে ?
কঠিন কথা তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই ,
গর্বছলে দীর্ঘ করি
নিজের কথাটাই ।
ব্যথা পাছে না পাও তুমি
লুকিয়ে রাখি তাই
নিজের ব্যথাটাই ।
ইচ্ছা করে নীরব হয়ে
রহিব তোর কাছে ,
সাহস নাহি পাই ।
মুখের ‘পরে বুকের কথা
উথ্লে ওঠে পাছে
অনেক কথা তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই ,
কথার আড়ে আড়াল থাকে
মনের কথাটাই ।
তোমায় ব্যথা লাগিয়ে শুধু
জাগিয়ে তুলি ভাই
আপন ব্যথাটাই ।
ইচ্ছা করি সুদূরে যাই ,
না আসি তোর কাছে ।
সাহস নাহি পাই ।
তোমার কাছে ভীরুতা মোর
প্রকাশ হয় রে পাছে
কেবল এসে তাই
দেখা দিয়েই যাই ,
স্পর্ধাতলে গোপন করি
মনের কথাটাই ।
নিত্য তব নেত্রপাতে
জ্বালিয়ে রাখি ভাই ,
আপন ব্যথাটাই ।
মাতাল
ওরে মাতাল , দুয়ার ভেঙেদিয়ে
পথেই যদি করিস মাতামাতি ,
থলিঝুলি উজাড় করে ফেলে
যা আছে তোর ফুরাস রাতারাতি ,
অশ্লেষাতে যাত্রা করে শুরু
পাঁজিপুঁথি করিস পরিহাস ,
অকারণে অকাজ লয়ে ঘাড়ে
অসময়ে অপথ দিয়ে যাস ,
হালের দড়ি নিজের হাতে কেটে
পালের ‘পরে লাগাস ঝোড়ো হাওয়া ,
আমিও ভাই , তোদের ব্রত লব
মাতাল হয়ে পাতাল – পানে ধাওয়া ।