অকূল – মাঝে ভাসিয়ে তরী
যাচ্ছি অজানায়
আমি শুধু একলা নেয়ে
আমার শূন্য নায় ।
নব নব পবনভরে
যাব দ্বীপে দ্বীপান্তরে ,
নেব তরী পূর্ণ করে
অপূর্ব ধন যত ।
ভিখারি তোর ফিরবে যখন
ফিরবে রাজার মতো ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমায় যদি না পাই , তবু
আর কারে তো পাবই ।
বিদায়
তোমরা নিশি যাপন করো ,
এখনো রাত রয়েছে ভাই ,
আমায় কিন্তু বিদায় দেহো—
ঘুমোতে যাই , ঘুমোতে যাই ।
মাথার দিব্য , উঠো না কেউ
আগ বাড়িয়ে দিতে আমায়—
চলছে যেমন চলুক তেমন ,
হঠাৎ যেন গান না থামায় ।
আমার যন্ত্রে একটি তন্ত্রী
একটু যেন বিকল বাজে ,
মনের মধ্যে শুনছি যেটা
হাতে সেটা আসছে না যে ।
একেবারে থামার আগে
সময় রেখে থামতে যে চাই—
আজকে কিছু শ্রান্ত আছি ,
ঘুমোতে যাই , ঘুমোতে যাই ।
আঁধার – আলোয় সাদায় – কালোয়
দিনটা ভালোই গেছে কাটি ,
তাহার জন্যে কারো সঙ্গে
নাইকো কোনো ঝগড়াঝাঁটি ।
মাঝে মাঝে ভেবেছিলুম
একটু – আধটু এটা – ওটা
বদল যদি পারত হতে
থাকত নাকো কোনো খোঁটা ।
বদল হলে কখন মনটা
হয়ে পড়ত ব্যতিব্যস্ত ,
এখন যেমন আছে আমার
সেইটে আবার চেয়ে বসত ।
তাই ভেবেছি দিনটা আমার
ভালোই গেছে , কিছু না চাই—
আজকে শুধু শ্রান্ত আছি ,
ঘুমোতে যাই , ঘুমোতে যাই ।
বিদায়রীতি
হায় গো রানী , বিদায়বাণী
এমনি করে শোনে ?
ছি ছি , ওই – যে হাসিখানি
কাঁপছে আঁখিকোণে !
এতই বারে বারে কি রে
মিথ্যা বিদায় নিয়েছি রে ,
ভাবছ তুমি মনে মনে
এ লোকটি নয় যাবার—
দ্বারের কাছে ঘুরে ঘুরে
ফিরে আসবে আবার ।
আমায় যদি শুধাও তবে
সত্য করেই বলি—
আমারো সেই সন্দেহ হয়
ফিরে আসব চলি ।
বসন্তদিন আবার আসে ,
পূর্ণিমা – রাত আবার হাসে ,
বকুল ফোটে রিক্ত শাখায়—
এরাও তো নয় যাবার ।
সহস্র বার বিদায় নিয়ে
এরাও ফেরে আবার ।
একটুখানি মোহ তবু
মনের মধ্যে রাখো ,
মিথ্যেটারে একেবারেই
জবাব দিয়ো নাকো ।
ভ্রমক্রমে ক্ষণেক – তরে
এনো গো জল আঁখির ‘পরে
আকুল স্বরে যখন কব
‘ সময় হল যাবার’ ।
তখন নাহয় হেসো , যখন
ফিরে আসব আবার ।
বিরহ
তুমি যখন চলে গেলে
তখন দুই – পহর—
সূর্য তখন মাঝ – গগনে ,
রৌদ্র খরতর ।
ঘরের কর্ম সাঙ্গ করে
ছিলেম তখন একলা ঘরে ,
আপন – মনে বসে ছিলেম
বাতায়নের ‘পর ।
তুমি যখন চলে গেলে
তখন দুই – পহর ।
চৈত্র মাসের নানা খেতের
নানা গন্ধ নিয়ে
আসতেছিল তপ্ত হাওয়া
মুক্ত দুয়ার দিয়ে ।
দুটি ঘুঘু সারাটা দিন
ডাকতেছিল শ্রান্তিবিহীন ,
একটি ভ্রমর ফিরতেছিল
কেবল গুন্গুনিয়ে
চৈত্র মাসের নানা খেতের
নানা বার্তা নিয়ে ।
তখন পথে লোক ছিল না ,
ক্লান্ত কাতর গ্রাম ।
ঝাউশাখাতে উঠতেছিল
শব্দ অবিশ্রাম ।
আমি শুধু একলা প্রাণে
অতি সুদূর বাঁশির তানে
গেঁথেছিলেম আকাশ ভ’রে
একটি কাহার নাম ।
তখন পথে লোক ছিল না ,
ক্লান্ত কাতর গ্রাম ।
ঘরে ঘরে দুয়ার দেওয়া ,
আমি ছিলেম জেগে—
আবাঁধা চুল উড়তে ছিল
উদাস হাওয়া লেগে ।
তটতরুর ছায়ার তলে
ঢেউ ছিল না নদীর জলে ,
তপ্ত আকাশ এলিয়ে ছিল
শুভ্র অলস মেঘে ।
ঘরে ঘরে দুয়ার দেওয়া ,
আমি ছিলেম জেগে ।
তুমি যখন চলে গেলে
তখন দুই – পহর ,
শুষ্ক পথে দগ্ধ মাঠে
রৌদ্র খরতর ।
নিবিড় – ছায়া বটের শাখে
কপোত দুটি কেবল ডাকে
একলা আমি বাতায়নে—
শূন্য শয়ন – ঘর ।
তুমি যখন গেলে তখন
বেলা দুই – পহর ।
বিলম্বিত
অনেক হল দেরি ,
আজো তবু দীর্ঘ পথের
অন্ত নাহি হেরি ।
তখন ছিল দখিন হাওয়া
আধ – ঘুমো আধ – জাগা ,
তখন ছিল সর্ষে – খেতে
ফুলের আগুন লাগা ,
তখন আমি মালা গেঁথে
পদ্মপাতায় ঢেকে
পথে বাহির হয়েছিলেম
রুদ্ধ কুটির থেকে ।
অনেক হল দেরি ,
আজো তবু দীর্ঘ পথের
অন্ত নাহি হেরি ।
বসন্তের সে মালা
আজ কি তেমন গন্ধ দেবে
নবীন – সুধা – ঢালা ?
আজকে বহে পুবে বাতাস ,
মেঘে আকাশ জুড়ে—
ধানের খেতে ঢেউ উঠেছে
নব – নবাঙ্কুরে ।
হাওয়ায় হাওয়ায় নাইকো রে হায়
হালকা সে হিল্লোল ,
নাই বাগানে হাস্যে গানে
পাগল গণ্ডগোল ।
অনেক হল দেরি ,
আজো তবু দীর্ঘ পথের
অন্ত নাহি হেরি ।
হল কালের ভুল ,
পুবে হাওয়ায় ধরে দিলেম
দখিন হাওয়ার ফুল ।
এখন এল অন্য সুরে
অন্য গানের পালা ,
এখন গাঁথো অন্য ফুলে
অন্য ছাঁদের মালা ।
বাজছে মেঘের গুরু গুরু ,
বাদল ঝরো ঝরো—
সজল বায়ে কদম্ববন
কাঁপছে থরোথরো ।
অনেক হল দেরি ,
আজো তবু দীর্ঘ পথের
অন্ত নাহি হেরি ।
বোঝাপড়া
মনেরে আজ কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে ,
কেউ বিকিয়ে আছে , কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে ,
কতকটা যে স্বভাব তাদের
কতকটা বা তোমারো ভাই ,
কতকটা এ ভবের গতিক—
সবার তরে নহে সবাই ।
তোমায় কতক ফাঁকি দেবে
তুমিও কতক দেবে ফাঁকি ,
তোমার ভোগে কতক পড়বে
পরের ভোগে থাকবে বাকি ,
মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম—
তোমারি কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম !
মনেরে আজ কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।
অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
এলে সুখের বন্দরেতে ,
জলের তলে পাহাড় ছিল
লাগল বুকের অন্দরেতে ,
মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো
উঠল কেঁপে আর্তরবে—
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গ
ঝগড়া করে মরতে হবে ?
ভেসে থাকতে পার যদি
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয় ,
না পার তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো ।
এটা কিছু অপূর্ব নয় ,
ঘটনা সামান্য খুবই—
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেইখানে হয় জাহাজ – ডুবি ।
মনেরে তাই কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।