মাঠে মাঠে বাতাস ফিরে মাতি ,
বৃথা স্বপ্নে কাটল সারা রাতি ।
হায় রে , সত্য কঠিন ভারী ,
ইচ্ছামত গড়তে নারি—
স্বপ্ন সেও চলে আপন মতে ,
আমি চলি আমার শূন্য পথে ।
কালকে ছিল এমন ঘন রাত ,
আকুল ধারে এমন বারিপাত ,
মিথ্যা যদি মধুর রূপে
আসত কাছে চুপে চুপে
তাহা হলে কাহার হত ক্ষতি —
স্বপ্ন যদি ধরত সে মুরতি ?
পথে
গাঁয়ের পথে চলেছিলেম
অকারণে ,
বাতাস বহে বিকালবেলা
বেণুবনে ।
ছায়া তখন আলোর ফাঁকে
লতার মতন জড়িয়ে থাকে ,
একা একা কোকিল ডাকে
নিজমনে ।
আমি কোথায় চলেছিলেম
অকারণে ।
জলের ধারে কুটিরখানি
পাতা – ঢাকা ,
দ্বারের ‘পরে নুয়ে পড়ে
নিম্বশাখা ।
ওই যে শুনি মাঝে মাঝে
না জানি কোন্ নিত্যকাজে
কোথায় দুটি কাঁকন বাজে
গৃহকোণে ।
যেতে যেতে এলেম হেথা
অকারণে ।
দিঘির জলে ঝলক ঝলে
মানিক হীরা ,
সর্ষেখেতে উঠছে মেতে
মৌমাছিরা ।
এ পথ গেছে কত গাঁয়ে
কত গাছের ছায়ে ছায়ে
কত মাঠের গায়ে গায়ে
কত বনে ।
আমি শুধু হেথায় এলেম
অকারণে ।
আরেক দিন সে ফাগুন মাসে
বহু আগে
চলেছিলেম এই পথে সেই
মনে জাগে ।
আমের বোলের গন্ধে অবশ
বাতাস ছিল উদাস অলস ,
ঘাটের শানে বাজছে কলস
ক্ষণে ক্ষণে ।
সে – সব কথা ভাবছি বসে
অকারণে ।
দীর্ঘ হয়ে পড়ছে পথে
বাঁকা ছায়া ,
গোষ্ঠঘরে ফিরছে ধেনু
শ্রান্তকায়া ।
গোধূলিতে খেতের ‘পরে
ধূসর আলো ধূ ধূ করে ,
বসে আছে খেয়ার তরে
পান্থজনে ।
আবার ধীরে চলছি ফিরে
অকারণে ।
পরামর্শ
সূর্য গেল অস্তপারে—
লাগল গ্রামের ঘাটে
আমার জীর্ণ তরী ।
শেষ বসন্তের সন্ধ্যা – হাওয়া
শস্যশূন্য মাঠে
উঠল হাহা করি ।
আর কি হবে নূতন যাত্রা
নূতন রাণীর দেশে
নূতন সাজে সেজে ?
এবার যদি বাতাস উঠে
তুফান জাগে শেষে ,
ফিরে আসবি নে যে ।
অনেক বার তো হাল ভেঙেছে ,
পাল গিয়েছে ছিঁড়ে
ওরে দুঃসাহসী ।
সিন্ধুপানে গেছিস ভেসে
অকূল কালো নীরে
ছিন্ন – রশারশি ।
এখন কি আর আছে সে বল ?
বুকের তলা তোর
ভরে উঠছে জলে ।
অশ্রু সেঁচে চলবি কত—
আপন ভারে ভোর
তলিয়ে যাবি তলে ।
এবার তবে ক্ষান্ত হ রে
ওরে শ্রান্ত তরী ,
রাখ্ রে আনাগোনা ।
বর্ষশেষের বাঁশি বাজে
সন্ধ্যা – গগন ভরি ,
ওই যেতেছে শোনা ।
এবার ঘুমো কূলের কোলে
বটের ছায়াতলে
ঘাটের পাশে রহি ,
ঘটের ঘায়ে যেটুকু ঢেউ
উঠে তটের জলে
তারি আঘাত সহি ।
ইচ্ছা যদি করিস তবে
এ পার হতে পারে
যাস রে খেয়া বেয়ে ।
আনবে বহি গ্রামের বোঝা
ক্ষুদ্র ভারে ভারে
পাড়ার ছেলেমেয়ে ।
ও পারেতে ধানের খোলা
এই পারেতে হাট ,
মাঝে শীর্ণ নদী—
সন্ধ্যা সকাল করবি শুধু
এ – ঘাট ও – ঘাট
ইচ্ছা করিস যদি ।
হায় রে মিছে প্রবোধ দেওয়া ,
অবোধ তরী মম
আবার যাবে ভেসে ।
কর্ণ ধরে বসেছে তার
যমদূতের সম
স্বভাব সর্বনেশে ।
ঝড়ের নেশা ঢেউয়ের নেশা
ছাড়বে নাকো আর ,
হায় রে মরণলুভী !
ঘাটে সে কি রইবে বাঁধা ,
অদৃষ্টে যাহার
আছে নৌকাডুবি !
প্রতিজ্ঞা
আমি হব না তাপস , হব না , হব না ,
যেমনি বলুন যিনি ।
আমি হব না তাপস নিশ্চয় যদি
না মেলে তপস্বিনী ।
আমি করেছি কঠিন পণ
যদি না মিলে বকুলবন ,
যদি মনের মতন মন
না পাই জিনি ,
তবে হব না তাপস , হব না , যদি না
পাই সে তপস্বিনী ।
আমি ত্যজিব না ঘর , হব না বাহির
উদাসীন সন্ন্যাসী ,
যদি ঘরের বাহিরে না হাসে কেহই
ভুবন – ভুলানো হাসি ।
যদি না উড়ে নীলাঞ্চল
মধুর বাতাসে বিচঞ্চল ,
যদি না বাজে কাঁকন মল
রিনিক – ঝিনি—
আমি হব না তাপস , হব না , যদি না
পাই গো তপস্বিনী ।
আমি হব না তাপস , তোমার শপথ ,
যদি সে তপের বলে
কোনো নূতন ভুবন না পারি গড়িতে
নূতন হৃদয় – তলে ।
যদি জাগায়ে বীণার তার
কারো টুটিয়া মরম – দ্বার ,
কোনো নূতন আঁখির ঠার
না লই চিনি
আমি হব না তাপস , হব না , হব না ,
না পেলে তপস্বিনী ।
বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ
কোন্ বাণিজ্যে নিবাস তোমার
কহো আমায় ধনী ,
তাহা হলে সেই বাণিজ্যের
করব মহাজনি ।
দুয়ার জুড়ে কাঙাল বেশে
ছায়ার মতো চরণদেশে
কঠিন তব নূপুর ঘেঁষে
আর বসে না রইব—
এটা আমি স্থির বুঝেছি
ভিক্ষা নৈব নৈব ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমায় যদি না পাই , তবু
আর কার তো পাবই ।
সাজিয়ে নিয়ে জাহাজখানি
বসিয়ে হাজার দাঁড়ি
কোন্ নগর যাব , দিয়ে
কোন্ সাগরে পাড়ি ।
কোন্ তারকা লক্ষ্য করি ,
কূল – কিনারা পরিহরি ,
কোন্ দিকে যে বাইব তরী
অকূল কালো নীরে—
মরব না আর ব্যর্থ আশায়
বালুমরুর তীরে ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমার যদি না পাই , তবু
আর কার তো পাবই ।
সাগর উঠে তরঙ্গিয়া ,
বাতাস বহে বেগে ,
সূর্য যেথায় অস্তে নামে
ঝিলিক মারে মেঘে ।
দক্ষিণে চাই , উত্তরে চাই—
ফেনায় ফেনা , আর কিছু নাই—
যদি কোথাও কূল নাহি পাই
তল পাব তো তবু ।
ভিটার কোণে হতাশমনে
রইব না আর কভু ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমায় যদি না পাই , তবু
আর কারে তো পাবই ।
নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ
প্রবাল দিয়ে ঘেরা ,
শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে
সাগর – বিহঙ্গরা ।
নারিকেলের শাখে শাখে
ঝোড়ো বাতাস কেবল ডাকে ,
ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে
বইছে নগনদী—
সোনার রেণু আনব ভরি
সেথায় নামি যদি ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমায় যদি না পাই , তবু
আর কারে তো পাবই ।