বোলপুর
৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৪
যাচনা
কীর্তন
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখিয়ো— তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহারি তালটি শিখিয়ো— তোমার
চরণমঞ্জীরে।
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখিটি— তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণে।
মনে ক’রে, সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখীটি— তোমার
কনককঙ্কণে।
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রাখিয়ো— তোমার
অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণশুভসিন্দূরে
একটি বিন্দু আঁকিয়ো— তোমার
ললাটচন্দনে।
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো গো— তোমার
অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো গো— তোমার
অতুল গৌরবে।
সাহাজাদপুর। বোট
৮ আশ্বিন ১৩০৪
রাত্রি
মোরে করো সভাকবি ধ্যানমৌন তোমার সভায়
হে শর্বরী, হে অবগুণ্ঠিতা!
তোমার আকাশ জুড়ি যুগে যুগে জপিছে যাহারা
বিরচিত তাহাদের গীতা!
তোমার তিমিরতলে যে বিপুল নিঃশব্দ উদ্যোগ
ভ্রমিতেছে জগতে জগতে,
আমারে তুলিয়া লও সেই তার ধ্বজচক্রহীন
নীরবঘর্ঘর মহারথে।
তুমি একেশ্বরী রানী বিশ্বের অন্তর‐অন্তঃপুরে
সুগম্ভীরা হে শ্যামাসুন্দরী!
দিবসের ক্ষয়হীন বিরাট ভাণ্ডারে প্রবেশিয়া
নীরবে রাখিছ ভাণ্ড ভরি।
নক্ষত্ররতন‐দীপ্ত নীলাকান্ত সুপ্তিসিংহাসনে
তোমার মহান জাগরণ!
আমারে জাগায়ে রাখো সে নিস্তব্ধ জাগরণতলে
নির্নিমেষ পূর্ণসচেতন!
কত নিদ্রাহীন চক্ষু যুগে যুগে তোমার আঁধারে
খুঁজেছিল প্রশ্নের উত্তর।
তোমার নির্বাক্ মুখে একদৃষ্টে চেয়েছিল বসি
কত ভক্ত জুড়ি দুই কর।
দিবস মুদিলে চক্ষু, ধীরপদে কৌতূহলী‐দল
অঙ্গনে পশিয়া সাবধানে
তব দীপহীন কক্ষে সুখদুঃখ‐জন্মমরণের
ফিরিয়াছে গোপন সন্ধানে।
স্তম্ভিত তমিস্রপুঞ্জ কম্পিত করিয়া অকস্মাৎ
অর্ধরাত্রে উঠেছে উচ্ছ্বাসি
সদ্যস্ফুট ব্রহ্মমন্ত্র আন্দোলিত ঋষিকণ্ঠ হতে
আন্দোলিয়া ঘন তন্দ্রারাশি।
পীড়িত ভুবন লাগি মহাযোগী করুণাকাতর,
চকিতে বিদ্যুৎরেখাবৎ
তোমার নিখিললুপ্ত অন্ধকারে দাঁড়ায়ে একাকী
দেখেছে বিশ্বের মুক্তিপথ।
জগতের সেই‐সব যামিনীর জাগরূকদল
সঙ্গীহীন তব সভাসদ্
কে কোথা বসিয়া আছে আজি রাত্রে ধরণীর মাঝে,
গনিতেছে গোপন সম্পদ—
কেহ কারে নাহি জানে, আপনার স্বতন্ত্র আসনে
আসীন স্বাধীন স্তব্ধচ্ছবি—
হে শর্বরী, সেই তব বাক্যহীন জাগ্রত সভায়
মোরে করি দাও সভাকবি!
১৩০৬
লজ্জিতা
ভৈরবী
যামিনী না যেতে জাগালে না কেন—
বেলা হল, মরি লাজে।
শরমে জড়িত চরণে কেমনে
চলিব পথের মাঝে!
আলোকপরশে মরমে মরিয়া
হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া,
কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া
কামিনী শিথিল সাজে।
যামিনী না যেতে জাগালে না কেন,
বেলা হল, মরি লাজে।
নিবিয়া বাঁচিল নিশার প্রদীপ
উষার বাতাস লাগি।
রজনীর শশী গগনের কোণে
লুকায় শরণ মাগি।
পাখি ডাকি বলে— গেল বিভাবরী,
বধূ চলে জলে লইয়া গাগরি,
আমি এ আকুল কবরী আবরি
কেমনে যাইব কাজে!
যামিনী না যেতে জাগালে না কেন—
বেলা হল মরি লাজে।
যমুনা
৭ আশ্বিন ১৩০৪
লীলা
সিন্ধুভৈরবী
কেন বাজাও কাঁকন কনকন, কত
ছলভরে!
ওগো, ঘরে ফিরে চলো, কনককলসে
জল ভ’রে।
কেন জলে ঢেউ তুলি ছলকি ছলকি
কর খেলা!
কেন চাহ খনে খনে চকিত নয়নে
কার তরে
কত ছলভরে!
হেরো যমুনাবেলায় আলসে হেলায়
গেল বেলা,
যত হাসিভরা ঢেউ করে কানাকানি
কলস্বরে
কত ছলভরে!
হেরো নদীপরপারে গগনকিনারে
মেঘমেলা,
তারা হাসিয়া হাসিয়া চাহিছে তোমারি
মুখ’‐পরে
কত ছলভরে!
[ভাদ্র/আশ্বিন] ১৩০৪
শরত্
আজি কি তোমার মধুর মূরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে!
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।
পারে না বহিতে নদী জলধার,
মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর—
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল
তোমার কাননসভাতে।
মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,
শরৎকালের প্রভাতে।
জননী, তোমার শুভ আহ্বান
গিয়েছে নিখিল ভুবনে—
নূতন ধান্যে হবে নবান্ন
তোমার ভবনে ভবনে।
অবসর আর নাহিক তোমার,
আঁটি আঁটি ধান চলে ভারে ভার,
গ্রামপথে‐পথে গন্ধ তাহার
ভরিয়া উঠিছে পবনে।
জননী, তোমার আহ্বান লিপি
পাঠায়ে দিয়েছ ভুবনে।
তুলি মেঘভার আকাশ তোমার
করেছ সুনীলবরনি;
শিশির ছিটায়ে করেছ শীতল
তোমার শ্যামল ধরণী।
স্থলে জলে আর গগনে গগনে
বাঁশি বাজে যেন মধুর লগনে,
আসে দলে দলে তব দ্বারতলে
দিশি দিশি হতে তরণী।
আকাশ করেছ সুনীল অমল,
স্নিগ্ধশীতল ধরণী।
বহিছে প্রথম শিশিরসমীর
ক্লান্ত শরীর জুড়ায়ে—
কুটিরে কুটিরে নব নব আশা
নবীন জীবন উড়ায়ে।
দিকে দিকে মাতা কত আয়োজন—
হাসিভরা‐মুখ তব পরিজন
ভাণ্ডারে তব সুখ নব নব
মুঠা মুঠা লয় কুড়ায়ে।
ছুটেছে সমীর আঁচলে তাহার
নবীন জীবন উড়ায়ে।
আয় আয় আয়, আছ যে যেথায়
আয় তোরা সব ছুটিয়া—
ভাণ্ডারদ্বার খুলেছে জননী,
অন্ন যেতেছে লুটিয়া।
ও পার হইতে আয় খেয়া দিয়ে,
ও পাড়া হইতে আয় মায়ে ঝিয়ে—
কে কাঁদে ক্ষুধায় জননী শুধায়,
আয় তোরা সবে জুটিয়া।
ভাণ্ডারদ্বার খুলেছে জননী,
অন্ন যেতেছে লুটিয়া।
মাতার কণ্ঠে শেফালিমাল্য
গন্ধে ভরিছে অবনী।
জলহারা মেঘ আঁচলে খচিত
শুভ্র যেন সে নবনী।
পরেছে কিরীট কনককিরণে,
মধুর মহিমা হরিতে হিরণে,
কুসুমভূষণজড়িত চরণে
দাঁড়ায়েছে মোর জননী।
আলোকে শিশিরে কুসুমে ধান্যে
হাসিছে নিখিল অবনী।