বসন কার দেখিতে পাই জ্যোৎস্নালোকে লুণ্ঠিত,
নয়ন কার নীরব নীল গগনে!
বদন কার দেখিতে পাই কিরণে অবগুণ্ঠিত,
চরণ কার কোমল তৃণশয়নে!
পরশ কার পুষ্পবাসে পরান মন উল্লাসি
হৃদয়ে উঠে লতার মতো জড়ায়ে!
পঞ্চশরে ভস্ম করে করেছ এ কী সন্ন্যাসী—
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে।
১২ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৪
মদনভস্মের পূর্বে
একদা তুমি অঙ্গ ধরি ফিরিতে নব ভুবনে,
মরি মরি, অনঙ্গদেবতা।
কুসুমরথে মকরকেতু উড়িত মধুপবনে,
পথিকবধূ চরণে প্রণতা।
ছড়াত পথে আঁচল হতে অশোক চাঁপা করবী
মিলিয়া যত তরুণ তরুণী,
বকুলবনে পবন হত সুরার মতো সুরভি—
পরান হত অরুণবরনি।
সন্ধ্যা হলে কুমারীদলে বিজন তব দেউলে
জ্বালায়ে দিত প্রদীপ যতনে,
শূন্য হলে তোমার তূণ বাছিয়া ফুলমুকুলে
সায়ক তারা গড়িত গোপনে।
কিশোর কবি মুগ্ধছবি বসিয়া তব সোপানে
বাজায়ে বীণা রচিত রাগিণী।
হরিণ‐সাথে হরিণী আসি চাহিত দীননয়ানে,
বাঘের সাথে আসিত বাঘিনী।
হাসিয়া যবে তুলিতে ধনু প্রণয়ভীরু ষোড়শী
চরণে ধরি করিত মিনতি।
পঞ্চশর গোপনে লয়ে কৌতূহলে উলসি
পরখছলে খেলিত যুবতী।
শ্যামল তৃণশয়নতলে ছড়ায়ে মধুমাধুরী
ঘুমাতে তুমি গভীর আলসে,
ভাঙাতে ঘুম লাজুক বধূ করিত কত চাতুরী—
নূপুর দুটি বাজাত লালসে।
কাননপথে কলস লয়ে চলিত যবে নাগরী
কুসুমশর মারিতে গোপনে,
যমুনাকূলে মনের ভুলে ভাসায়ে দিয়ে গাগরি
রহিত চাহি আকুল নয়নে।
বাহিয়া তব কুসুমতরী সমুখে আসি হাসিতে—
শরমে বালা উঠিত জাগিয়া,
শাসনতরে বাঁকায়ে ভুরু নামিয়া জলরাশিতে
মারিত জল হাসিয়া রাগিয়া।
তেমনি আজো উদিছে বিধু, মাতিছে মধুযামিনী,
মাধবীলতা মুদিছে মুকুলে।
বকুলতলে বাঁধিছে চুল একেলা বসি কামিনী
মলয়ানিলশিথিল দুকূলে।
বিজন নদীপুলিনে আজো ডাকিছে চখা চখিরে,
মাঝেতে বহে বিরহবাহিনী।
গোপনব্যথা‐কাতরা বালা বিরলে ডাকি সখীরে
কাঁদিয়া কহে করুণ কাহিনী।
এসো গো আজি অঙ্গ ধরি সঙ্গে করি সখারে
বন্যমালা জড়ায়ে অলকে,
এসো গোপনে মৃদুচরণে বাসরগৃহ‐দুয়ারে
স্তিমিতশিখা প্রদীপ‐আলোকে।
এসো চতুর, মধুর হাসি তড়িৎসম সহসা
চকিত করো বধুরে হরষে—
নবীন করো মানবঘর, ধরণী করো বিবশা
দেবতাপদ‐সরস‐পরশে।
১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৪
তার আহ্বান
বারেক তোমার দুয়ারে দাঁড়ায়ে
ফুকারিয়া ডাকো জননী!
প্রান্তরে তব সন্ধ্যা নামিছে,
আঁধারে ঘেরিছে ধরণী।
ডাকো, ‘চলে আয়, তোরা কোলে আয়।’
ডাকো সকরুণ আপন ভাষায়;
সে বাণী হৃদয়ে করুণা জাগায়,
বেজে ওঠে শিরা ধমনী—
হেলায় খেলায় যে আছে যেথায়
সচকিয়া উঠে অমনি।
আমরা প্রভাতে নদী পার হনু,
ফিরিনু কিসের দুরাশে।
পরের উঞ্ছ অঞ্চলে লয়ে
ঢালিনু জঠরহুতাশে।
খেয়া বহে নাকো, চাহি ফিরিবারে,
তোমার তরণী পাঠাও এ পারে,
আপনার খেত গ্রামের কিনারে
পড়িয়া রহিল কোথা সে!
বিজন বিরাট শূন্য সে মাঠ
কাঁদিছে উতলা বাতাসে!
কাঁপিয়া কাঁপিয়া দীপখানি তব
নিবু‐নিবু করে পবনে—
জননী, তাহারে করিয়ো রক্ষা
আপন বক্ষোবসনে।
তুলি ধরো তারে দক্ষিণ করে—
তোমার ললাটে যেন আলো পড়ে,
চিনি দূর হতে, ফিরে আসি ঘরে
না ভুলি আলেয়া‐ছলনে।
এ পারে দুয়ার রুদ্ধ, জননী,
এ পরপুরীর ভবনে।
তোমার বনের ফুলের গন্ধ
আসিছে সন্ধ্যাসমীরে।
শেষ গান গাহে তোমার কোকিল
সুদূরকুঞ্জতিমিরে।
পথে কোনো লোক নাহি আর বাকি,
গহন কাননে জ্বলিছে জোনাকি,
আকুল অশ্রু ভরি দুই আঁখি
উচ্ছ্বসি উঠে অধীরে।
‘তোরা যে আমার’ ডাকো একবার
দাঁড়ায়ে দুয়ারবাহিরে।
নাগর-নদী। আত্রাই পথে
৭ আষাঢ় ১৩০৫
মানসপ্রতিমা
ইমনকল্যাণ
তুমি সন্ধ্যার মেঘ শান্তসুদূর
আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্যগগনবিহারী!
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে
তোমারে করেছি রচনা—
তুমি আমারি যে তুমি আমারি,
মম অসীমগগনবিহারী!
মম হৃদয়রক্তরঞ্জনে তব
চরণ দিয়েছি রাঙিয়া,
অয়ি সন্ধ্যাস্বপনবিহারী!
তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে
মম সুখদুখ ভাঙিয়া—
তুমি আমারি যে তুমি আমারি
মম বিজনজীবনবিহারী!
মম মোহের স্বপন‐অঞ্জন তব
নয়নে দিয়েছি পরায়ে,
অয়ি মুগ্ধনয়নবিহারী!
মম সংগীত তব অঙ্গে অঙ্গে
দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে—
তুমি আমারি যে তুমি আমারি,
মম জীবনমরণবিহারী!
চলন বিল। ঝড়বৃষ্টি
৯ আশ্বিন ১৩০৪
মার্জনা
ওগো প্রিয়তম, আমি তোমারে যে ভালোবেসেছি
মোরে দয়া করে কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
ভীরু পাখির মতন তব পিঞ্জরে এসেছি,
ওগো, তাই বলে দ্বার কোরো না রুদ্ধ কোরো না।
মোর যাহা‐কিছু ছিল কিছুই পারি নি রাখিতে,
মোর উতলা হৃদয় তিলেক পারি নি ঢাকিতে,
সখা, তুমি রাখো ঢাকো, তুমি করো মোরে করুণা—
ওগো, আপনার গুণে অবলারে কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
ওগো প্রিয়তম, যদি নাহি পার ভালোবাসিতে
তবু ভালোবাসা কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
তব দুটি আঁখিকোণ ভরি দুটি‐কণা হাসিতে
এই অসহায়া‐পানে চেয়ো না বন্ধু, চেয়ো না।
আমি সম্বরি বাস ফিরে যাব দ্রুতচরণে,
আমি চকিত শরমে লুকাব আঁধার মরণে,
আমি দু‐হাতে ঢাকিব নগ্নহৃদয়বেদনা—
ওগো প্রিয়তম, তুমি অভাগীরে কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
ওগো প্রিয়তম, যদি চাহ মোরে ভালোবাসিয়া
মোর সুখরাশি কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।
যবে সোহাগের স্রোতে যাব নিরুপায় ভাসিয়া
তুমি দূর হতে বসি হেসো না গো সখা, হেসো না!
যবে রানীর মতন বসিব রতন‐আসনে,
যবে বাঁধিব তোমারে নিবিড়প্রণয়শাসনে,
যবে দেবীর মতন পুরাব তোমার বাসনা,
ওগো তখন হে নাথ, গরবীরে কোরো মার্জনা কোরো মার্জনা।