আমার এ মনোজ্বালা
আমার এ মনোজ্বালা
আমার এ মনোজ্বালা কে বুঝিবে সরলে
কেন যে এমন করে, ম্রিয়মাণ হয়ে থাকি
কেন যে নীরবে হেন বসে থাকি বিরলে।
এ যাতনা কেহ যদি বুঝিতে পারিত দেবি,
তবে কি সে আর কভু পারিত গো হাসিতে?
হৃদয় আছয়ে যার সঁপিতে পারে সে প্রাণ
এ জ্বলন্ত যন্ত্রণার এক তিল নাশিতে!
হে সখী হে সখাগণ, আমার মর্মের জ্বালা
কেহই তোমরা যদি না পার গো বুঝিতে,
কী আগুন জ্বলে তার নিভৃত গভীর তলে
কী ঘোর ঝটিকা সনে হয় তারে যুঝিতে।
তবে গো তোমরা মোরে শুধায়ো না শুধায়ো না
কেন যে এমন করে রহিয়াছি বসিয়া
বিরলে আমারে হেথা, একলা থাকিতে দাও,
[আমা]র মনের কথা বুঝিবে কী করিয়া?
[ম্রিয়]মাণ মুখে, এই শূন্যপ্রায় নেত্রে
[ক]লঙ্ক সঁপি গো আমি তোমাদের হরষে;
পূর্ণিমা যামিনী যথা মলিন হইয়া যায়
ক্ষুদ্র এক অন্ধকার জলদের পরশে।
কিন্তু কী করিব বলো, কী চাও কী দিব আমি
তোমাদের আমোদ গো এক তিল বাড়াতে
হৃদয়ে এমন জ্বালা, কী করে হাসিব বলো
কিছুতে বিষণ্ণভাব পারি না যে তাড়াতে।
বিরক্ত হোয়ো না সখি, অমন বিরক্ত নেত্রে
আমার মুখের পানে রহিয়ো না চাহিয়া,
কী আঘাত লাগে প্রাণে, দেখি ও বিরক্ত মুখ
কেমনে সখি গো তাহা বুঝাইব কহিয়া?
ব্যথায় পাইয়া ব্যথা, যদি গো শুধাতে কথা
অশ্রুজলে মিশাইতে যদি অশ্রুজল
আদরে স্নেহের স্বরে, একটি কহিতে কথা,
অনেক নিভিত তবু এ হৃদি-অনল
জানিতাম ওগো সখি, কাঁদিলে মমতা পাব,
কাঁদিলে বিরক্ত হবে এ কী নিদারুণ?
চরণে ধরি গো সখি, একটু করিয়ো দয়া
নহিলে নিভিবে কিসে বুকের আগুন!
…
উপহার-গীতি
উপহার-গীতি
ছেলেবেলা হতে বালা, যত গাঁথিয়াছি মালা
যত বনফুল আমি তুলেছি যতনে
ছুটিয়া তোমারি কোলে, ধরিয়া তোমারি গলে
পরায়ে দিয়াছি সখি তোমারি চরণে।
আজো গাঁথিয়াছি মালা, তুলিয়া বনের ফুল
তোমারি চরণে সখি দিব গো পরায়ে —
না-হয় ঘৃণার ভরে, দলিয়ো চরণতলে
হৃদয় যেমন করে দলেছ দুপায়ে।
পৃথিবীর নিন্দাযশে, কটাক্ষ করি না বালা
তুমি যদি সোহাগেতে করহ গ্রহণ
আমার সর্বস্বধন, কবিতার মালাগুলি
পৃথিবীর তরে আমি করি নি গ্রন্থন।
আমি যে-সকল গান গাই গো মনের সুখে
সপ্তসুরে পূর্ণ করি এ শূন্য আকাশ
পৃথিবীর আর কেহ, শুনুক বা না শুনুক
তুমি যেন শুন বালা, এই অভিলাষ!
তোমার লাগিবে ভালো, তুমি গো বলিবে ভালো,
গলাবে তোমারি মন এ সংগীত-ধ্বনি
আমার মর্মের কথা, তুমিই বুঝিবে সখি
আর কেহ না বুঝুক খেদ নাহি গণি
একদিন মনে পড়ে, যাহা তাহা গাইতাম
সকলি তোমার সখি লাগিত গো ভালো
নীরবে শুনিতে তুমি, সমুখে বহিত নদী
মাথায় ঢালিত চাঁদ পূর্ণিমার আলো।
সুখের স্বপনসম, সেদিন গেল গো চলি
অভাগা অদৃষ্টে হায় এ জন্মের তরে
আমার মনের গান মর্মের রোদনধ্বনি
স্পর্শও করে না আজ তোমার অন্তরে।
তবুও — তবুও সখি তোমারেই শুনাইব
তোমারেই দিব সখি যা আছে আমার।
দিনু যা মনের সাথে, তুলিয়া লও তা হাতে
ভগ্নহৃদয়ের এই প্রীতি-উপহার।
বাড়িতে, ১লা কার্তিক, মঙ্গলবার
এ হতভাগারে ভালো কে বাসিতে চায়
এ হতভাগারে ভালো কে বাসিতে চায়
এ হতভাগারে ভালো কে বাসিতে চায়?
সুখ-আশা থাকে যদি বেসো না আমায়!
এ জীবন, অভাগার — নয়ন সলিলধার
বলো সখি কে সহিতে পারিবে তা হায়!
এ ভগ্নপ্রাণের অতি বিষাদের গান
বলো সখি কে শুনিতে পারে সারা প্রাণ
গেছি ভুলে ভালোবাসা — ছাড়িয়াছি সুখ-আশা
ভালোবেসে কাজ নাই স্বজনি আমায়!
এসো আজি সখা
এসো আজি সখা বিজন পুলিনে
বলিব মনের কথা;
মরমের তলে যা-কিছু রয়েছে
লুকানো মরম-ব্যথা।
সুচারু রজনী, মেঘের আঁচল
চাপিয়া অধরে হাসিছে শশি,
বিমল জোছনা সলিলে মজিয়া
আঁধার মুছিয়া ফেলেছে নিশি,
কুসুম কাননে বিনত আননে
মুচকিয়া হাসে গোলাপবালা,
বিষাদে মলিনা, শরমে নিলীনা,
সলিলে দুলিছে কমলিনী বধূ
ম্লানরূপে করি সরসী আলা!
আজি, খুলিয়া ফেলিব প্রাণ
আজি, গাইব কত গান,
আজি, নীরব নিশীথে,চাঁদের হাসিতে
মিশাব অফুট তান!
দুই হৃদয়ের যত আছে গান
এক সাথে আজি গাইব,
দুই হৃদয়ের যত আছে কথা
দুইজনে আজি কহিব;
কতদিন সখা, এমন নিশীথে
এমন পুলিনে বসি,
মানসের গীত গাহিয়া গাহিয়া
কাটাতে পাই নি নিশি!
স্বপনের মতো সেই ছেলেবেলা
সেইদিন সথা মনে কি হয়?
হৃদয় ছিল গো কবিতা মাখানো
প্রকৃতি আছিল কবিতাময়,
কী সুখে কাটিত পূরণিমা রাত
এই নদীতীরে আসি,
[কু]সুমের মালা গাঁথিয়া গাঁথিয়া
গনিয়া তারকারাশি।
যমুনা সুমুখে যাইত বহিয়া
সে যে কী সুখের গাইত গান,
ঘুম ঘুম আঁখি আসিত মুদিয়া
বিভল হইয়া যাইত প্রাণ!
[কত] যে সুখের কল্পনা আহা
আঁকিতাম মনে মনে
[সা] রাটি জীবন কাটাইব যেন
…
তখন কি সখা জানিতাম মনে
পৃথিবী কবির নহে
কল্পনা আর যতই প্রবল
ততই সে দুখ সহে!
এমন পৃথিবী, শোভার আকর
পাখি হেথা করে গান
কাননে কাননে কুসুম ফুটিয়া
পরিমল করে দান!
আকাশে হেথায় উঠে গো তারকা
উঠে সুধাকর, রবি,
বরন বরন জলদ দেখিছে
নদীজলে মুখছবি,
এমন পৃথিবী এও কারাগার
কবির মনের কাছে!
যে দিকে নয়ন ফিরাইতে যায়
সীমায় আটক আছে!
তাই [যে] গো সখা মনে মনে আমি
গড়েছি একটি বন,
সারাদিন সেথা ফুটে আছে ফুল,
গাইছে বিহগগণ!
আপনার ভাবে হইয়া পাগল
রাতদিন সুখে আছি গো সেথা
বিজন কাননে পাখির মতন
বিজনে গাইয়া মনের ব্যথা!
কতদিন পরে পেয়েছি তোমারে,
ভুলেছি মরমজ্বালা;
দুজনে মিলিয়া সুখের কাননে
গাঁথিব কুসুমমালা!
দুজনে মিলিয়া পূরণিমা রাতে
গাইব সুখের গান
যমুনা পুলিনে করিব দুজনে
সুখ নিশা অবসান,
আমার এ মন সঁপিয়া তোমারে
লইব তোমার মন
হৃদয়ের খেলা খেলিয়া খেলিয়া
কাটাইব সারাক্ষণ!
এইরূপে সখা কবিতার কোলে
পোহায়ে যাইবে প্রাণ
সুখের স্বপন দেখিয়া দেখিয়া
গাহিয়া সুখের গান।