বিদায় (যাও তবে প্রিয়তম সুদূর প্রবাসে)
যাও তবে প্রিয়তম সুদূর প্রবাসে
নব বন্ধু নব হর্ষ নব সুখ আশে।
সুন্দরী রমণী কত, দেখিবে গো শত শত
ফেলে গেলে যারে তারে পড়িবে কি মনে?
তব প্রেম প্রিয়তম, অদৃষ্টে নাইকো মম
সে-সব দুরাশা সখা করি না স্বপনে
কাতর হৃদয় শুধু এই ভিক্ষা চায়
ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়।
স্মরিলে এ অভাগীর যাতনার কথা,
যদিও হৃদয়ে লাগে তিলমাত্র ব্যথা,
মরমের আশা এই, থাক্ রুদ্ধ মরমেই
কাজ নাই দুখিনীরে মনে করে আর।
কিন্তু দুঃখ যদি সখা, কখনো গো দেয় দেখা
মরমে জনমে যদি যাতনার ভার,
ও হৃদয় সান্ত্বনার বন্ধু যদি চায়
ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়।
Mrs. Amelia Opie
বিদায়-চুম্বন (একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার)
একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার
জনমের মতো দেখা হবে না কো আর।
মর্মভেদী অশ্রু দিয়ে, পূজিব তোমারে প্রিয়ে
দুখের নিশ্বাস আমি দিব উপহার।
সে তো তবু আছে ভালো, একটু আশার আলো
জ্বলিতেছে অদৃষ্টের আকাশে যাহার।
কিন্তু মোর আশা নাই, যে দিকে ফিরিয়া চাই
সেই দিকে নিরাশার দারুণ আঁধার!
ভালো যে বেসেছি তারে দোষ কী আমার?
উপায় কী আছে বলো উপায় কী তার?
দেখামাত্র সেই জনে, ভালোবাসা আসে মনে
ভালো বাসিলেই ভুলা নাহি যায় আর!
নাহি বাসিতাম যদি এত ভালো তারে
অন্ধ হয়ে প্রেমে তার মজিতাম না রে
যদি নাহি দেখিতাম, বিচ্ছেদ না জানিতাম
তা হলে হৃদয় ভেঙে যেত না আমার!
আমারে বিদায় দাও যাই গো সুন্দরী,
যাই তবে হৃদয়ের প্রিয় অধীশ্বরী,
থাকো তুমি থাকো সুখে, বিমল শান্তির বুকে
সুখ, প্রেম, যশ, আশা থাকুক তোমার
একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার।
Robert Burns
বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা
বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা!
দিবেরাত্রি আহার নিদ্রে ছেড়ে,
তপিস্যে আর লড়াই করে শেষে
বশিষ্টের গাইটি নিলে কেড়ে।
বিশ্বামিত্র তোমার মতো গোরু
দুটি এমন দেখি নি বিশ্বে!
নইলে একটি গাভী পাবার তরে
এত যুদ্ধ এত তপিস্যে!
Heinrich Hein
সাধনা, বৈশাখ, ১২৯৯
বৃদ্ধ কবি (মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে)
মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে
জীবন হতেছে শেষ,
শিথিল কপোল মলিন নয়ন
তুষার-ধবল কেশ!
পাশেতে আমার নীরবে পড়িয়া
অযতনে বীণাখানি,
বাজাবার বল নাইকো এ হাতে
জড়িমা জড়িত বাণী!
গীতিময়ী মোর সহচরী বীণা!
হইল বিদায় নিতে;
আর কি পারিবি ঢালিবারে তুই
অমৃত আমার চিতে?
তবু একবার আর-একবার
ত্যজিবার আগে প্রাণ,
মরিতে মরিতে গাহিয়া লইব
সাধের সে-সব গান!
দুলিবে আমার সমাধি-উপরে
তরুগণ শাখা তুলি,
বনদেবতারা গাইবে তখন
মরণের গানগুলি!
ভারতী, কার্তিক, ১২৮৬
ভালোবাসে যারে তার চিতাভস্ম-পানে
ভালোবাসে যারে তার চিতাভস্ম-পানে
প্রেমিক যেমন চায় কাতর নয়ানে
তেমনি যে তোমা-পানে নাহি চায় গ্রীস্
তাহার হৃদয় মন পাষাণ কুলিশ
ইংরাজেরা ভাঙিয়াছে প্রাচীর তোমার
দেবতাপ্রতিমা লয়ে গেছে [সিন্ধুপার]
এ দেখে কার না হবে হবে ॥।
[ধূম]কেতু সম তারা কী কুক্ষণে হায়
[ছা]ড়িয়া সে ক্ষুদ্র দ্বীপ আইল হেথায়
[অ]সহায় বক্ষ তব রক্তময় করি
দেবতা প্রতিমাগুলি লয়ে গেল হরি।
George Gordon Byron
মালতী পুঁথি
ভুজ-পাশ-বদ্ধ অ্যান্টনি (এই তো আমরা দোঁহে বসে আছি কাছে কাছে)
এই তো আমরা দোঁহে বসে আছি কাছে কাছে!
একটি ভুজঙ্গ-ভুজে আমারে জড়ায়ে আছে;
আরেকটি শ্যাম-বাহু, শতেক মুকুতা ঝুলে,
সোনার মদিরা পাত্র আকাশে রয়েছে তুলে।
অলকের মেঘ মাঝে জ্বলিতেছে মুখখানি,
রূপের মদিরা পিয়া
আবেশে অবশ হিয়া,
পড়েছে মাতাল হয়ে, কখন্ কিছু না জানি!
রাখিয়া বক্ষের পরে অবশ চিবুক মোর,
হাসিতেছি তার পানে, হৃদয়ে আঁধার ঘোর!
বাতায়ন-যবনিকা, বাতাস, সরায়ে ধীরে
বীজন করিছে আসি এ মোর তাপিত শিরে।
সম্মুখেতে দেখা যায়
পীতবর্ণ বালুকায়
অস্তগামী রবিকর আদূর “নীলের’ তীরে।
চেয়ে আছি, দেখিতেছি, নদীর সুদূর পারে,
(কী জানি কিসের দুখ!)
পশ্চিম দিকের মুখ
বিষণ্ণ হইয়া আসে সন্ধ্যার আঁধার ভারে।
প্রদোষ তারার মুখে হাসি আসি উঁকি মারে!
রোমীয় স্বপন এক জাগিছে সম্মুখে মোর,
ঘুরিছে মাথার মাঝে, মাথায় লেগেছে ঘোর।
রোমীয় সমর-অস্ত্র ঝঞ্ঝনিয়া উঠে বাজি,
বিস্ফারিত নাসা চাহে রণ-ধূম পিতে আজি।
কিন্তু হায়! অমনি সে মুখ্ পানে হেসে চায়,
কী জানি কী হয় মতি,
হীন প্রমোদের প্রতি।
বীরের ভ্রূকুটিগুলি তখনি মিলায়ে যায়!
গরবিত, শূন্য হিয়া, জর্জর আবেশ-বাণে,
যে প্রমোদ ঘৃণা করি হেসে চাই তারি পানে।
অনাহূত হর্ষ এক জাগ্রতে স্বপনে আসি,
শৌর্যের সমাধি-পরে ঢালে রবি-কর রাশি!
কতবার ঘৃণি তারে! রমণী সে অবহেলে
পৌরুষ নিতেছে কাড়ি বিলাসের জালে ফেলে!
কিন্তু সে অধর হতে
অমনি অজস্র স্রোতে
ঝরে পড়ে মৃদু হাসি, চুম্বন অমৃত-মাখা
আমারে করিয়া তুলে, ভাঙাঘর ফুলে ঢাকা।
বীরত্বের মুখ খানি একবার মনে আনি,
তার পরে ওই মুখে ফিরাই নয়ন মম,
ওই মুখ! একখানি উজ্জ্বল কলঙ্ক সম!
ওই তার শ্যাম বাহু আমারে ধরেছে হায়!
অঙ্গুলির মৃদু স্পর্শে বল মোর চলে যায়!
মুখ ফিরাইয়া লই– রমণী যেমনি ধীরি
মৃদু কণ্ঠে মৃদু কহে, অমনি আবার ফিরি।
রোমের আঁধার মেঘ দেখে যেই মুখ-‘পরে,
অমনি দু বাহু দিয়ে কণ্ঠ জড়াইয়া ধরে,
বরষে নয়নবারি আমার বুকের মাঝ,
চুমিয়া সে অশ্রুবারি শুকানো বীরের কাজ।
তার পরে ত্যজি মোরে চরণ পড়িছে টলে,
থর থর কেঁপে বলে–“যাও, যাও, যাও চলে!’
ঢুলু ঢুলু আঁখিপাতা পুরে অশ্রু-মুকুতায়,
শ্যামল সৌন্দর্য তার হিম-শ্বেত হয়ে যায়!
জীবনের লক্ষ্য, আশা, ইচ্ছা, হারাইয়া ফেলি,
চেয়ে দেখি তার পানে কাতর নয়ন মেলি।
আবার ফিরাই মুখ, কটাক্ষেতে চেয়ে রই,
কল&ড়বঁ;ঙ্ক প্রমোদে মাতি তাহারে টানিয়া লই!
আরেকটি বার রোম, হইব সন্তান তোর
একটি বাসনা এই বন্দী এ হৃদয়ে মোর।
গৌরবে সম্মানে মরি এই এক আছে আশ,
চাহি না করিতে ব্যয় চুম্বনে অন্তিম শ্বাস!
বুঝি হায় সে আশাও পুরিবে না কোনো কালে
রোমীয় মৃত্যুও বুঝি ঘটিবে না এ কপালে!
রোমীয় সমাধি চাই
তাও বুঝি ভাগ্যে নাই,
ওই বুকে মরে যাব, বুঝি মরণের কালে!
Robert Buchanan
ভারতী, আশ্বিন-কার্তিক, ১২৮৮