গানগুলি মোর বিষে ঢালা
গানগুলি মোর বিষে ঢালা
কী হবে আর তাহা বই?
ফুটন্ত এ প্রাণের মাঝে
বিষ ঢেলেছে বিষময়ী!
গানগুলি মোর বিষেঢালা,
কী হবে আর তাহা বই?
বুকের মধ্যে সর্প আছে,
তুমিও সেথা আছে অয়ি!
Heinrich Hein
গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয়
গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয়
রূপের মোহনে আছিল মাতি,
প্রাণের স্বপন আছিল যখন
প্রেম প্রেম শুধু দিবস রাতি!
শান্ত আশা এ হৃদয়ে আমার
এখন ফুটিতে পারে,
সুবিমলতর দিবস আমার
এখন উঠিতে পারে।
বালক কালের প্রেমের স্বপন–
মধুর যেমন উজল যেমন
তেমন কিছুই আসিবে না,
তেমন কিছুই আসিবে না!
সে দেবীপ্রতিমা নারিব ভুলিতে
প্রথম প্রণয় আঁকিল যাহা,
স্মৃতি-মরু মোর উজল করিয়া
এখনো হৃদয়ে বিরাজে তাহা!
সে প্রতিমা সেই পরিমল সম
পলকে যা লয় পায়,
প্রভাতকালের স্বপন যেমন
পলকে মিশায়ে যায়।
অলস প্রবাহ জীবনে আমার
সে কিরণ কভু ভাসিবে না আর
সে কিরণ কভু ভাসিবে না,
সে কিরণ কভু ভাসিবে না!
Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies
চপলারে আমি অনেক ভাবিয়া
চপলারে আমি অনেক ভাবিয়া
দূরেতে রাখিয়া এলেম তারে,
রূপ-ফাঁদ হতে পালাইতে তার,
প্রণয়ে ডুবাতে মদিরা-ধারে।
এত দূরে এসে বুঝিনু এখন
এখনো ঘুচে নি প্রণয়-ঘোর,
মাথায় যদিও চড়েছে মদিরা
প্রণয় রয়েছে হৃদয়ে মোর।
যুবতীর শেষে লইনু শরণ
মাগিনু সহায় তার,
অনেক ভাবি সে কহিল তখন
“চপলা নারীর সার।’
আমি কহিলাম “সে কথা তোমার
কহিতে হবে না মোরে–
দোষ যদি কিছু বলিবারে পারো
শুনি প্রণিধান করে।’
যুবতী কহিল “তাও কভু হয়?
যদি বলি দোষ আছে–
নামের আমার কুযশ হইবে
কহিনু তোমার কাছে।’
এখন তো আর নাই কোনো আশা
হইয়াছি অসহায়–
চপলা আমার মরমে মরমে
বাণ বিঁধিতেছে, হায়!
দলে মিশি তার ইন্দ্রিয় আমার
বিরোধী হয়েছে মোর,
যুবতী আমার–বলিছে আমারে
রূপের অধীন ঘোর!
Lord Cantalupe
জাগি রহে চাঁদ (জাগি রহে চাঁদ আকাশে যখন)
বেহাগ
জাগি রহে চাঁদ আকাশে যখন
সারাটি রজনী!
শ্রান্ত জগত ঘুমে অচেতন
সারাটি রজনী!
অতি ধীরে ধীরে হৃদে কী লাগিয়া
মধুময় ভাব উঠে গো জাগিয়া
সারাটি রজনী!
ঘুমায়ে তোমারি দেখি গো স্বপন
সারাটি রজনী!
জাগিয়া তোমারি দেখি গো বদন
সারাটি রজনী!
ত্যজিবে যখন দেহ ধূলিময়
তখনি কি সখি তোমার হৃদয়,
আমার ঘুমের শয়ন-‘পরে
ভ্রমিয়া বেড়াবে প্রণয়-ভরে।
সারাটি রজনী!
জীবন উৎসর্গ (এসো এসো এই বুকে নিবাসে তোমার)
এসো এসো এই বুকে নিবাসে তোমার,
যূথভ্রষ্ট বাণবিদ্ধ হরিণী আমার,
এইখানে বিরাজিছে সেই চির হাসি,
আঁধারিতে পারিবে না তাহা মেঘরাশি।
এই হস্ত এ হৃদয় চিরকাল মতো
তোমার, তোমারি কাজে রহিবে গো রত!
কিসের সে চিরস্থায়ী ভালোবাসা তবে,
গৌরবে কলঙ্কে যাহা সমান না রবে?
জানি না, জানিতে আমি চাহি না, চাহি না,
ও হৃদয়ে এক তিল দোষ আছে কিনা,
ভালোবাসি তোমারেই এই শুধু জানি,
তাই হলে হল, আর কিছু নাহি মানি।
দেবতা সুখের দিনে বলেছ আমায়,
বিপদে দেবতা সম রক্ষিব তোমায়,
অগ্নিময় পথ দিয়া যাব তব সাথে,
রক্ষিব, মরিব কিংবা তোমারি পশ্চাতে।
Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies
জীবন মরণ (ওরা যায়, এরা করে বাস)
ওরা যায়, এরা করে বাস;
অন্ধকার উত্তর বাতাস
বহিয়া কত-না হা-হুতাশ
ধূলি আর মানুষের প্রাণ
উড়াইয়া করিছে প্রয়াণ।
আঁধারেতে রয়েছি বসিয়া;
একই বায়ু যেতেছে শ্বসিয়া
মানুষের মাথার উপরে,
অরণ্যের পল্লবের স্তরে।
যে থাকে সে গেলদের কয়,
“অভাগা, কোথায় পেলি লয়।
আর না শুনিবি তুই কথা,
আর হেরিবি তরুলতা,
চলেছিস মাটিতে মিশিতে,
ঘুমাইতে আঁধার নিশীথে।’
যে যায় সে এই বলে যায়,
“তোদের কিছুই নাই হায়,
অশ্রুজল সাক্ষী আছে তায়।
সুখ যশ হেথা কোথা আছে
সত্য যা তা মৃতদেরি কাছে।
জীব, তোরা ছায়া, তোরা মৃত,
আমরাই জীবন্ত প্রকৃত।’
Victor Hugo
‘আলোচনা’ পত্রিকা, কার্তিক, ১২৯১
তুমি একটি ফুলের মতো মণি
তুমি একটি ফুলের মতো মণি
এম্নি মিষ্টি, এম্নি সুন্দর!
মুখের পানে তাকাই যখনি
ব্যথায় কেন কাঁদায় অন্তর!
শিরে তোমার হস্ত দুটি রাখি
পড়ি এই আশীষ মন্তর,
বিধি তোরে রাখুন চিরকাল
এমনি মিষ্টি, এম্নি সুন্দর!
Heinrich Hein
দামিনীর আঁখি কিবা
দামিনীর আঁখি কিবা
ধরে জ্বল’ জ্বল’ বিভা
কার তরে জ্বলিতেছে কেবা তাহা জানিবে?
চারি দিকে খর ধার
বাণ ছুটিতেছে তার
কার-‘পরে লক্ষ্য তার কেবা অনুমানিবে?
তার চেয়ে নলিনীর আঁখিপানে চাহিতে
কত ভালো লাগে তাহা কে পারিবে কহিতে?
সদা তার আঁখি দুটি
নিচু পাতে আছে ফুটি,
সে আঁখি দেখে নি কেহ উঁচু পানে তুলিতে!
যদি বা সে ভুলে কভু চায় কারো আননে,
সহসা লাগিয়া জ্যোতি
সে-জন বিস্ময়ে অতি
চমকিয়া উঠে যেন স্বরগের কিরণে!
ও আমার নলিনী লো, লাজমাখা নলিনী,
অনেকেরি আঁখি-‘পরে
সৌন্দর্য বিরাজ করে,
তোর আঁখি-‘পরে প্রেম নলিনী লো নলিনী!
দামিনীর দেহে রয়
বসন কনকময়
সে বসন অপসরী সৃজিয়াছে যতনে,
যে গঠন যেই স্থান
প্রকৃতি করেছে দান
সে-সকল ফেলিয়াছে ঢাকিয়া সে বসনে।
নলিনী বসন পানে দেখ দেখি চাহিয়া
তার চেয়ে কত ভালো কে পারিবে কহিয়া?
শিথিল অঞ্চল তার
ওই দেখো চারি ধার
স্বাধীন বায়ুর মতো উড়িতেছে বিমানে,
যেথা যে গঠন আছে
পূর্ণ ভাবে বিকাশিছে
যেখানে যা উঁচু নিচু প্রকৃতির বিধানে!
ও আমার নলিনী লো, সুকোমলা নলিনী
মধুর রূপের ভাস
তাই প্রকৃতির বাস,
সেই বাস তোর দেহে নলিনী লো নলিনী!
দামিনীর মুখ-আগে
সদা রসিকতা জাগে,
চারি ধারে জ্বলিতেছে খরধার বাণ সে,
কিন্তু কে বলিতে পারে
শুধু সে কি ধাঁধিবারে,
নহে তা কি খর ধারে বিঁধিবারি মানসে?
কিন্তু নলিনীর মনে
মাথা রাখি সঙ্গোপনে
ঘুমায়ে রয়েছে কিবা প্রণয়ের দেবতা।
সুকোমল সে শয্যার
অতি যা কঠিন ধার
দলিত গোলাপ তাও আর কিছু নহে তা!
ও আমার নলিনী লো, বিনয়িনী নলিনী
রসিকতা তীব্র অতি
নাই তার এত জ্যোতি
তোমার নয়নে যত নলিনী লো নলিনী।
Thomas Moore
ভারতী, আষাঢ়, ১২৮৮