- বইয়ের নামঃ অনুবাদ কবিতা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অদৃষ্টের হাতে লেখা
অদৃষ্টের হাতে লেখা সূক্ষ্ম এক রেখা,
সেই পথ বয়ে সবে হয় অগ্রসর।
কত শত ভাগ্যহীন ঘুরে মরে সারাদিন
প্রেম পাইবার আগে মৃত্যু দেয় দেখা,
এত দূরে আছে তার প্রাণের দোসর!
কখন বা তার চেয়ে ভাগ্য নিরদয়,
প্রণয়ী মিলিল যদি–অতি অসময়!
“হৃদয়টি?’ “দিয়াছি তা!’ কান্দিয়া সে কহে,
“হাতখানি প্রিয়তম?’ “নহে, নহে, নহে!’
Matthew Arnold
আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি
আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি
দুখ জ্বালা সব যাই ভুলি।
অধরে অধরে পরশিয়া
প্রাণমন উঠে হরষিয়া।
মাথা রাখি যবে ওই বুকে
ডুবে যাই আমি মহা সুখে।
যবে বল তুমি, “ভালবাসি’,
শুনে শুধু আঁখিজলে ভাসি।
Heinrich Hein
আবার আবার কেন রে আমার
আবার আবার কেন রে আমার
সেই ছেলেবেলা আসে নি ফিরে,
হরষে কেমন আবার তা হলে,
সাঁতারিয়ে ভাসি সাগরের জলে,
খেলিয়ে বেড়াই শিখরী শিরে!
স্বাধীন হৃদয়ে ভালো নাহি লাগে,
ঘোরঘটাময় সমাজধারা,
না, না, আমি রে যাব সেই স্থানে,
ভীষণ ভূধর বিরাজে যেখানে,
তরঙ্গ মাতিছে পাগল পারা!
অয়ি লক্ষ্মী, তুমি লহো লহো ফিরে,
ধন ধান্য তুমি যাদেছ মোরে,
জাঁকালো উপাধি নাহি আমি চাই,
ক্রীতদাসে মম কোনো সুখ নাই,
সেবকের দল যাক-না সোরে!
তুলে দাও মোরে সেই শৈল-‘পরে,
গরজি ওঠে যা সাগর-নাদে,
অন্য সাধ নাই, এই মাত্র চাই,
ভ্রমিব সেথায় স্বাধীন হৃদে!
অধিক বয়স হয় নে তো মম,
এখনি বুঝিতে পেরেছি হায়,
এ ধরা নহে তো আমার কারণে,
আর মম সুখ নাহি এ জীবনে,
কবে রে এড়াব এ দেহ দায়!
একদা স্বপনে হেরেছিনু আমি,
সুবিমল এক সুখের স্থান,
কেন রে আমার সে ঘুম ভাঙিল
কেন রে আমার নয়ন মেলিল,
দেখিতে নীরস এ ধরা খান!
এক কালে আমি বেসেছিনু ভালো,
ভালোবাসা-ধন কোথায় এবে,
বাল্যসখা সব কোথায় এখন–
হায় কী বিষাদে ডুবেছে এ মন,
আশারও আলোক গিয়েছে নিবে!
অমোদ-আসরে আমোদ-সাথীরা,
মাতায় ক্ষণেক আমোদ রসে,
কিন্তু এ হৃদয়, আমোদের নয়,
বিরলে কাঁদি যে একেলা বসে!
উঃ কী কঠোর, বিষম কঠোর,
সেই সকলের আমোদ-রব,
শত্রু কিম্বা সখা নহে যারা মনে,
অথচ পদ বা বিভব কারণে,
দাও ফিরে মোরে সেই সখাগুলি,
বয়সে হৃদয়ে সমান যারা,
এখনি যে আমি ত্যেজিব তা হলে,
গভীর নিশীথ-আমোদীর দলে,
হৃদয়ের ধার কি ধারে তারা!
সর্বস্ব রতন, প্রিয়তমা ওরে,
তোরেও সুধাই একটি কথা,
বল দেখি কিসে আর মম সুখ,
হেরিয়েও যবে তোর হাসি-মুখ,
কমে না হৃদয়ে একটি ব্যথা!
যাক তবে সব, দুঃখ নাহি তায়,
শোকের সমাজ নাহিকো চাই,
গভীর বিজনে মনের বিরাগে,
স্বাধীন হৃদয়ে ভালো যাহা লাগে,
সুখে উপভোগ করিব তাই!
মানব-মন্ডলী ছেড়ে যাব যাব,
বিরাগে কেবল, ঘৃণাতে নয়,
অন্ধকারময় নিবিড় কাননে,
থাকিব তবুও নিশ্চিন্ত মনে,
আমারও হৃদয় আঁধারময়!
কেন রে কেন রে হল না আমার,
কপোতের মতো বায়ুর পাখা,
তা হলে ত্যেজিয়ে মানব-সমাজ,
গগনের ছাদ ভেদ করি আজ,
থাকিতাম সুখে জলদে ঢাকা!
George Gordon Byron
ভারতী, আষাঢ়, ১২৮৫
কষ্টের জীবন (মানুষ কাঁদিয়া হাসে)
মানুষ কাঁদিয়া হাসে,
পুনরায় কাঁদে গো হাসিয়া।
পাদপ শুকায়ে গেলে,
তবুও সে না হয় পতিত,
তরণী ভাঙিয়া গেলে
তবু ধীরে যায় সে ভাসিয়া,
ছাদ যদি পড়ে যায়,
দাঁড়াইয়া রহে তবু ভিত।
বন্দী চলে যায় বটে,
তবুও তো রহে কারাগার,
মেঘে ঢাকিলেও সূর্য
কোনোমতে দিন অস্ত হয়,
তেমনি হৃদয় যদি
ভেঙেচুরে হয় চুরমার,
কোনোক্রমে বেঁচে থাকে
তবুও সে ভগন হৃদয়।
ভগন দর্পণ যথা,
ক্রমশ যতই ভগ্ন হয়,
ততই সে শত শত,
প্রতিবিম্ব করয়ে ধারণ,
তেমনি হৃদয় হতে,
কিছুই গো যাইবার নয়।
হোক না শীতল স্তব্ধ,
শত খন্ডে ভগ্ন চূর্ণ মন,
হউক-না রক্তহীন,
হীনতেজ তবুও তাহারে,
বিনিদ্র জ্বলন্ত জ্বালা,
ক্রমাগত করিবে দাহন,
শুকায়ে শুকায়ে যাবে,
অন্তর বিষম শোকভারে,
অথচ বাহিরে তার,
চিহ্নমাত্র না পাবে দর্শন।
George Gordon Byron
কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা
“কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে!
এতই যাতনা দুখিনী আমারে
দিতেছ কেমন করে?
গাঁথিয়া রেখেছি পরাতে মালিকা
তোমার গলার-‘পরে,
কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা,
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে!
এতই যাতনা দুখিনী-বালারে
দিতেছ কেমন করে?
যে শপথ তুমি বলেছ আমারে
মনে করে দেখো তবে,
মনে করো সেই কুঞ্জ যেথায়
কহিলে আমারি হবে।
কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে,
এতই যাতনা দুখিনী-বালারে
দিতেছ কেমন করে?’
এত বলি এক কাঁদিছে ললনা
ভাসিছে লোচন-লোরে
“কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে।
এতই যাতনা দুখিনী-বালারে
দিতেছ কেমন করে?’
William Chappel
গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে
১
গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে,
নিভৃত নিরালা ঠাঁই, লেশমাত্র আলো নাই,
লুকানো এ প্রেমসাধ গোপনে নিবসে,
শুদ্ধ যবে ভালোবাসা নয়নে তোমার,
ঈষৎ প্রদীপ্ত হয়, উচ্ছ্বসয়ে এ-হৃদয়,
ভয়ে ভয়ে জড়সড় তখনি আবার।
২
শূন্য এই মরমের সমাধি-গহ্বরে,
জ্বলিছে এ প্রেমশিখা চিরকাল-তরে,
কেহ না দেখিতে পায়, থেকেও না থাকা প্রায়,
নিভিবারও নাম নাই নিরাশার ঘোরে।
৩
যা হবার হইয়াছে– কিন্তু প্রাণনাথ!
নিতান্ত হইবে যবে এ শরীরপাত,
আমার সমাধি-স্থানে কোরো নাথ কোরো মনে,
রয়েছে এ এক দুঃখিনী হয়ে ধরাসাৎ।
৪
যত যাতনা আছে দলুক আমায়,
সহজে সহিতে নাথ সব পারা যায়,
কিন্তু হে তুমি-যে মোরে, ভুলে যাবে একেবারে
সে কথা করিতে মনে হৃদি ফেটে যায়।
৫
রেখো তবে এই মাত্র কথাটি আমার,
এই কথা শেষ কথা, কথা নাহি আর,
(এ দেহ হইলে পাত, যদি তুমি প্রাণনাথ,
প্রকাশো আমার তরে তিলমাত্র শোক,
ধর্মত হবে না দোষী দোষিবে না লোক–
কাতরে বিনয়ে তাই, এই মাত্র ভিক্ষা চাই,
কখনো চাহি নে আরো কোনো ভিক্ষা আর)
যবে আমি যাব ম’রে, চির এ দুঃখিনী তরে,
বিন্দুমাত্র অশ্রুজল ফেলো একবার–
আজন্ম এত যে ভালোবেসেছি তোমায়,
সে প্রেমের প্রতিদান একমাত্র প্রতিদান,
তা বই কিছুই আর দিয়ো না আমায়।
George Gordon Byron