বসুন।
মহিলা সামনের সোফাটার উপরে বসে ব্যাগ থেকে ছোট একটি রুমাল বের করে তার মুখের ঘামটা মুছে নিলেন।
মিঃ রায়, আমি আপনাকে চিনি না, কেবল আপনার নামের সঙ্গেই আমার যা পরিচয়। একটা বিশ্রী রকম সংকটে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি, আপনি যদি দয়া করে আমাকে সাহায্য করেন।
কি হয়েছে?
ভদ্রমহিলা তখন সংক্ষেপে তার স্বামীর তিন বৎসর আগে পুরীর এক হোটেলে আত্মহত্যার কথা বললেন ও সেই সঙ্গে নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও দিলেন।
বললেন, তিন বৎসর আগে যে দুঃখের ও লজ্জার ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছিল, এত বছর পর যে আবার সেই ব্যাপারটায় এমনি করে একটা সঙ্কট সৃষ্টি হবে ভাবতেও পারিনি। যাকে এই তিনটে বছর জেনে এসেছি মৃত বলে, তারই কাছ থেকে যে এমন একটা চিঠি পাব কেমন করে ভাবব বলুন!
চিঠিটা আপনার সঙ্গে আছে?
আছে, এই যে—মালতী ব্যাগ থেকে মুখ-ছেড়া টিকিট লাগানো সাদা খাম বের করে কিরীটীর হাতে তুলে দিলেন।
জামসেদপুরের ঠিকানা ও মালতী দেবীর নাম লেখা খামটার উপরে হাতের লেখায়। খাম থেকে চিঠিটা বের করে কিরীটী পড়ল। সংক্ষিপ্ত একটা হাতে লেখা চিঠি লেখাটা পুরুষের হাতের বলেই মনে হয়।
এ চিঠি আপনি বলছেন আপনারই স্বামীর লেখা? প্রশ্নটা করে কিরীটী তাকাল মালতী দেবীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, তারই হাতের লেখা।
লেখাটা চিনতে আপনার কোন রকম ভুল হয়নি তো মালতী দেবী?
না, ওটা আমার স্বামীরই হাতে লেখা। সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
আপনার স্বামীর লেখা অন্য কোন চিঠিপত্র আপনার কাছে আছে?
আছে। আমি নিজেও মিলিয়ে দেখেছি, আপনিও দেখুন—বলে গোটা দুই পুরাতন চিঠি মালতী কিরীটীর হাতে তুলে দিলেন।
কিরীটী সব চিঠিগুলো দেখে বুঝতে পারে একই ব্যক্তির লেখা প্রত্যেকটি চিঠি। মালতী দেবী, আপনি তাহলে বিশ্বাস করেন আপনার স্বামী আজও বেঁচে আছেন? অর্থাৎ তিন বছর পূর্বে পুরীর হোটেলে যিনি ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, তিনি অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তি!
মালতী দেবী বললেন, ঐ চিঠিটা পাবার পর তা ছাড়া আর অন্য কি ভাবতে পারি বলুন। আপনিও তো চিঠিগুলো দেখলেন, আপনারও কি তাই মনে হয় না?
হ্যাঁ, তাই মনে হয় বটে, তবে কথা হচ্ছে—
কি বলুন?
আপনি একটু আগে তিন বছর আগে পুরীর এক হোটেলের মধ্যে যে ঘটনাটা ঘটেছিল বললেন, সে-সময় আপনিই তো নিজে গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করে বলে এসেছিলেন মৃত ব্যক্তি আপনার স্বামী–
হ্যাঁ, বলে এসেছিলাম।
তাহলে কি ভাবব, আপনি যে কারণেই হোক সত্য কথাটা পুলিসকে বলেননি?
সত্যিই বলেছিলাম।
সত্য বলেছিলেন?
হ্যাঁ, সেদিন যেমন মৃতদেহ দেখে বলেছিলাম সে-ই আমার স্বামী, আজও ঐ চিঠি যে তারই লেখা তাও বলছি! সেদিন যেমন আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম, আজও তেমনি আমি নিঃসন্দেহ।
মৃতদেহটা আপনার স্বামীরই ছিল?
হ্যাঁ। শান্ত দৃঢ় গলায় জবাব দিলেন মালতী দেবী।
কিন্তু এই চিঠি যদি সত্যি-সত্যিই আপনার স্বামীরই লেখা হয় তাহলে কি ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে না যে সেদিন যে মৃতদেহকে আপনার স্বামীর বলে সনাক্ত করে এসেছিলেন তিনি নিশ্চয় আপনার স্বামী নন, কারণ মৃত ব্যক্তি তো আর চিঠি লিখতে পারেন না। সুতরাং তিনি সম্পূর্ণ অন্য ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি অবিকল আপনার স্বামীর মতো দেখতে ছিলেন বলেই আপনার ঐ ভুলটা হয়েছিল।
মালতী দেবী কোন জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন।
মালতী দেবী, আপনি সমস্ত ব্যাপারটা আর একবার ভেবে দেখুন–
চিঠিটা পেয়েছি আমি প্রায় মাস দেড়েক আগে, তারপর আমার স্বামী সত্যিই আজও বেঁচে আছেন কিনা—কিম্বা আমারই হয়ত সেদিন ভুল হয়েছিল সেই কথা ভেবেই সমস্ত রকম অনুসন্ধান করার পর ব্যাপারটার একটা মীমাংসায় পৌঁছবার জন্যই শেষ পর্যন্ত আপনার কাছে। এসেছি।
কিন্তু আপনাকে সাহায্য করতে হলে কতকগুলো আবশ্যকীয় প্রশ্নের জবাব আমার একান্ত দরকার।
বলুন কি জানতে চান?
আপনার স্বামীর সঙ্গে আপনার মানে বুঝতেই পারছেন, পরস্পরের সম্পর্কটা কেমন ছিল যদি বলেন।
কি বলব বলুন, বলতে লজ্জাও হয় দুঃখও হয়, আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা সুখের বা শান্তির ছিল না। অথচ আপনি শুনলে হয়ত অবাকই হবেন, পরস্পরকে ভালবেসেই আমাদের বিবাহ হয়েছিল।
বিবাহের পূর্বেই আপনাদের জানাশোনা হয়েছিল তাহলে?
হ্যাঁ, আমার শ্বশুরমশাই এবং শাশুড়ি জীবিত থাকা সত্ত্বেও আমার স্বামী তার কাকার কাছেই মানুষ–
আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি আজও বেঁচে আছেন কি?
জানি না, তাদের কখনও দেখিনি। আমার স্বামীও তার মা-বাবা সম্পর্কে কখনও কোন কথা বলতেন না বলে আমিও কখনও সে সম্পর্কে প্রশ্ন করিনি। তাদের নিয়ে কখনও কোন আলোচনা করিনি। কারণ আমি বুঝতে পেয়েছিলাম, যে কারণেই তোক তিনি তার মা-বাবা সম্পর্কে কোন আলোচনা করতে চান না। অবিশ্যি আমারও কোন দিন কোন আগ্রহই ছিল না সে সম্পর্কে জানবার।
আপনার মা-বাবাও ক্ষিতীন্দ্রবাবুর মা-বাবা সম্পর্কে কোন খোঁজখবর নেননি?
মা-বাবা আমার ছিল না, আমি আমার বড়দিদির কাছেই মানুষ। খুব ছোটবেলায় তারা মারা যান। আমার জামাইবাবু অসুস্থ মানুষ ছিলেন, অল্প বয়সেই সব কাজকর্ম ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অ্যাক্সিডেন্টের পর, কলকাতা শহরের ওপর খান দুই বাড়ি ছিল, তার আয় থেকেই তাদের চলে যেত ভাল ভাবেই দিদির পক্ষেও অত খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব ছিল না।
হুঁ। আপনার স্বামীর কাকা বেঁচে আছেন?