- বইয়ের নামঃ সুভদ্রা হরণ
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. কিরীটীর এমন একটা নিষ্ক্রিয়তা
এক এক সময় দেহে ও মনে কিরীটীর এমন একটা নিষ্ক্রিয়তা দেখা দিত যখন সে হয়ত দিনের পর দিন তার বসবার ঘরটা থেকে বেরুতই না। কেউ এলে দেখা পর্যন্ত করত না। দেহ ও মনের ঐ নিষ্ক্রিয় ভাবটা কোন কোন সময় একনাগাড়ে এক মাস দেড় মাস পর্যন্ত চলত। ও যেন ঐ সময়টায় শামুকের মতই নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখত।
বছর তিনেক আগেকার কথা—কিরীটীর সেই সময় ঠিক ঐ অবস্থা চলছিল। সময় তখন গ্রীষ্মকাল।
একে শহরে প্যাচপ্যাচে বিশ্রী গরম—তার উপরে সারা শহর জুড়ে চলেছে সে সময় প্রচন্ড এক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবাধ খুনোখুনি। একে অন্যকে হত্যা করাটা যেন এক শ্রেণীর রাজনৈতিক আশ্রয়পুষ্ট বেপরোয়া কিশোর যুবকদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।
কাউকে রিভলবারের গুলি চালিয়ে, কাউকে পাইপগান দিয়ে, কাউকে রাইফেলের গুলিতে, কাউকে ছোরা মেরে বা বোমার ঘায়ে কাউকে—যে যেমন পারছিল যেন নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল।
খবরের কাগজের পাতা খুললেই নিত্য ঐ ধরনের দুচারটে মর্মন্তুদ হত্যাসংবাদ চোখে পড়বেই।
জনজীবনের সে যেন এক বীভৎস চিত্র। কেবল কি তাই! জনজীবন যেন সর্বদা আতঙ্কিত-সন্ত্রস্ত। মৃত্যু যেন সর্বত্র সর্বক্ষণ ওৎ পেতে আছে।
সকালে হয়ত বেরুল-রাত ফুরিয়ে গেল, আর ফিরলই না।
কাউকে হয়ত চলন্ত বাস থেকে নামিয়ে দিনের আলোয় চারিদিকে মানুষজন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে গেল সকলের চোখের সামনে। রক্তাক্ত মৃতদেহটা তার রাস্তায়ই পড়ে রইল।
বাড়ির কেউ বের হলে না ফিরে আসা পর্যন্ত দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সন্ধ্যার পরই যে যার বাড়িতে ফিরে যায়। সহজ জীবনযাত্রাটাই যেন কেমন থমকে গিয়েছে।
কিরীটীর গড়িয়াহাট অঞ্চলটা কিছু শান্ত। দ্বিপ্রহরে ঘরের মধ্যে বসে কিরীটী ও কৃষ্ণার মধ্যে সেই কথাই হচ্ছিল।
ভৃত্য জংলী এসে ঘরে ঢুকল।
এই জংলী, চা কর! কিরীটী বললে।
চায়ের জল চাপিয়েছি। জংলী বললে, বাইরে একজন বাবু এসেছেন—
বলে দে দেখা হবে না।
কিরীটী কথাটা বলতে জংলী বললে, বলেছিলাম, কিন্তু বাবু শুনছেন না। বলছেন ভীষণ জরুরী দরকার তাঁর–
বলেছিস বুঝি আমি আছি বাড়িতে? কিরীটী খিঁচিয়ে ওঠে।
হ্যাঁ।
ভেংচে ওঠে কিরীটী, হ্যাঁ! তোকে না বলে দিয়েছি কেউ এলে বলবি বাবু বাড়িতে নেই!
কৃষ্ণা বলে, দেখই না কে। নিশ্চয়ই খুব বিপদ, নচেৎ এই প্রচন্ড রোদে এই গরমে কেউ তোমার কাছে আসে! যা জংলী, বাবুকে এই ঘরেই পাঠিয়ে দে।
জংলী চলে গেল। তার ওষ্ঠপ্রান্তে চপল হাসি। মনে হল মনিব-গৃহিণীর হুকুম পেয়ে সে যেন খুশিই হয়েছে।
খুশি হবার জংলীর কারণ আছে। কিরীটীর যখন ঐ ধরনের নিষ্ক্রিয়তা চলতে থাকে জংলীর ব্যাপারটা আদৌ ভাল লাগে না। কেবল একা একা ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকবে বাবু। কারও সঙ্গে দেখা না, কথা পর্যন্ত না—এমন কি মাঈজীর সঙ্গেও কদাচিৎ এক-আধটা কথার বেশী নয়।
কৃষ্ণা উঠে দাঁড়াল। কৃষ্ণা চলে যাবার পরেই সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। সতর্ক জুতোর শব্দ। দরজা ঠেলে আগন্তুক ঘরে প্রবেশ করলেন।
কিরীটী চোখ তুলে তাকাল আগন্তুকের দিকে।
লম্বা ঢ্যাঙা দড়ির মত পাকানো চেহারা। পরনে দামী শান্তিপুরী ফাইন ধুতি ও গায়ে পাতলা আদ্দির পাঞ্জাবি। সারা গা থেকে ভুরভুর করে একটা কড়া দিশী সেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে। গা যেন কেমন গুলিয়ে ওঠে। হাতে একটা মোষের শিংয়ের লাঠি।
নমস্কার। আমার নাম হরিদাস সামন্ত।
কিরীটী নিরাসক্ত কণ্ঠে বললে, বসুন।
হরিদাস সামন্ত বসতে বসতে বললেন, আপনাকে এ সময় বিরক্ত করবার জন্য আমি সত্যিই খুবই লজ্জিত, দুঃখিত রায় মশায়। কিন্তু নেহাত প্রাণের দায়ে—
কিরীটী দেখছিল আগন্তুকের চেহারা ও মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।
বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বেই হবে বলে মনে হয়। রগের দুপাশের চুলে পাক ধরেছে স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু কেশ বেশ সযত্নে ছাঁটা। মাঝখানে টেরি। কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত কেশ। দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। লম্বাটে ধরনের মুখ। চওড়া কপাল। কপালের রেখা স্পষ্ট। কপালের রেখায়, চোখের কোণে, ভাঙা গালে যেন একটা অমিতাচারের চিহ্ন সুস্পষ্ট। নাকটা সামান্য যেন ভোঁতা, ভাঙা গাল। ধারালো চিবুক। চোখে সোনার দামী ফ্রেমের চশমা।
বড় বিপদে পড়েছি রায় মশাই। দেখুন, আপনি হয়ত সব শুনে বলবেন পুলিসের কাছে। গেলাম না কেন। গেলাম না কারণ তাদের দ্বারস্থ একবার হলে গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকে না। তাছাড়া অন্যপক্ষ যদি জানতে পারে যে পুলিসের সাহায্য আমি নিচ্ছি তাহলে হয়ত সঙ্গে সঙ্গে প্রাণেই শেষ করে দেবে আমাকে। তাই বুঝলেন কিনা—
কথাগুলো বলতে বলতে হরিদাস সামন্ত পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিলেন। দেখা গেল দুহাতের আঙুলে গোটা চারেক আংটি। তার মধ্যে বোধ হয় একটা রক্তমুখী নীলা মনে হল কিরীটীর।
কিরীটী চেয়ে চেয়ে দেখছিল হরিদাস সামন্তকে।
মুখটা যেন চেনা-চেনা, কবে কোথায় দেখেছে—ঝাপসা ঝাপসা মনে হচ্ছে।
মাপ করবেন হরিদাসবাবু, আপনাকে যেন আগে কোথাও দেখেছি—
দেখেছেন বইকি রায় মশাই।
দেখেছি?
হ্যাঁ।
এককালে স্টেজে অভিনয় করতাম তো।
রঙমহল মঞ্চে—
হ্যাঁ। ছিলাম অনেক দিন।
উল্কা নাটকে আপনি অভিনয় করেছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ। রাজীব ঘোষের ভূমিকায়। মনে আছে আপনার সে অভিনয়?
হ্যাঁ। মনে আছে বৈকি। তা মঞ্চ ছেড়ে দিয়েছেন বুঝি?
হ্যাঁ।
কেন, মঞ্চ ছেড়ে দিলেন কেন?
আমাদের যুগ যে চলে গিয়েছে।
যুগ চলে গিয়েছে কি রকম?
তাছাড়া কি? আমরা তো এখন ডেড়-ফসিল। তবে ওই অ্যাটিংয়ের নেশা জানেন তো কি ভয়ানক! তাই থিয়েটারের মঞ্চ ছেড়ে গিয়ে যোগ দিলাম যাত্রার দলে।
যাত্রার দলে?
হ্যাঁ। যাত্রা। তারপর একদিন পার্টনারশিপে আধাআধি হিস্যায় নবকেতন যাত্রা পার্টি গড়ে তুললাম।
কতদিন হল যাত্রার দলে অভিনয় করছেন?
তা ধরুন বছর সাত-আট তো হলই প্রায়। প্রথমটায় বছর দুয়েক এ-দলে ও-দলে গাওনা গেয়ে বেড়িয়েছি। তারপর দেখলাম এ লাইনে বাঁচতে হলে নিজের দল গড়া ছাড়া উপায় নেই। তাই–
নিজের দল খুললেন?
হ্যাঁ। নবকেতন যাত্রা পার্টি—
নবকেতন যাত্রা পার্টি আপনি গড়েছিলেন?
ঠিক আমি একা নই। আমি আর রাধারমণ পাল মশাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বছর দুই বাদে শেয়ার বেচে দিয়ে পাল মশাইয়ের দলেই বর্তমানে চাকরি করছি।
জংলী ঐ সময় দুকাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।
থিয়েটারে অভিনয় ব্যাপারে কিরীটীর বরাবর একটা নেশা আছে। নতুন নাটক কখনও কোনও মঞ্চে সে বড় একটা বাদ দেয় না। হরিদাস সামন্তর অভিনয় সে রঙ্গমঞ্চে বার দুই দেখেছে। সেও বছর সাত-আট আগে। কিন্তু সে চেহারা নেই হরিদাস সামন্তর। সে চেহারা যেন শুকিয়ে গিয়েছে। তাহলেও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চেনা-চেনা মনে হয়েছিল সেই কারণেই।
নিন সামন্ত মশাই, চা খান।
চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে হরিদাস সামন্ত বললেন, আমার অভিনয় আপনি তো দেখেছেন রায় মশাই?
দেখেছি।
প্রথম যুগের অভিনয় হয়ত আমার দেখেননি।
দেখেছি। আপনার সিরাজদৌল্লায় সিরাজের পার্ট।
আর কিছু?
রত্নদীপে সোনার হরিণ।
দেখেছেন?
হ্যাঁ।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন হরিদাস সামন্তর বুক কাঁপিয়ে বের হয়ে এল।
বললেন, হ্যাঁ—সে সময় হিরো থেকে ক্যারেক্টার রোল পর্যন্ত করতাম—
আবার যেন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল সামন্তর।
তারপর ধীরে ধীরে বললেন, আশ্চর্য! এখনও আপনার সে কথা মনে আছে? আপনি গুণী ব্যক্তি, তাই অন্যের গুণের কথা আজও স্মরণ রেখেছেন। কেউ মনে রাখে না রায় মশাইনটনটীদের কেউ মনে রাখে না। গিরিশচন্দ্র ঠিকই বলে গিয়েছেন—দেহপটসনে নট সকলই হারায়। কথাগুলো বলতে বলতে হরিদাস সামন্তর চোখের কোণ দুটো সজল হয়ে ওঠে।
কিন্তু আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন তা তো কই এখনও বললেন না সামন্ত মশাই।
হ্যাঁ—বলব। আর সেই জন্যই তো এসেছি। রায় মশাই, আপনার রহস্য উদঘাটনের অদ্ভুত ক্ষমতার, শক্তির কথা আমি জানি। আর তাতেই সর্বাগ্রে আপনার কথাই মনে হয়েছে। আমার সামনে যে বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, তা থেকে মুক্ত যদি কেউ করতে পারে আমাকে একমাত্র আপনিই হয়ত পারবেন।
সামন্ত মশাই, জানি না আপনার কি ধরনের বিপদ উপস্থিত হয়েছে, তবে আমার যদি সাধ্যাতীত না হয়, যথাসাধ্য আপনার আমি নিশ্চয়ই সাহায্য করবার চেষ্টা করব।
কিরীটীর বিরক্তির ভাবটা ততক্ষণে অনেকখানি কেটে গিয়েছে। বলতে কি সে যেন একটু কৌতূহলই বোধ করে সামন্ত মশাইয়ের কথায়।
পারবেন রায় মশাই, কেউ যদি পারে তো একমাত্র আপনিই পারবেন। আপনাকে সব কথা খুলে না বললে গোড়া থেকে আপনি বুঝতে পারবেন না। তাই গোড়া থেকেই বলছি।
০২. হরিদাস সামন্ত অতঃপর
হরিদাস সামন্ত অতঃপর বলতে শুরু করলেন তাঁর কাহিনী।
থিয়েটারে নতুন নতুন সব ছেলেছোকরা অভিনেতাদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই হরিদাস সামন্তদের মত বয়স্ক অভিনেতাদের চাহিদা কমতে শুরু করেছিল।
তার অবিশ্যি আর একটা কারণও ছিল। নতুন অভিনেতারা সব নতুন ঢঙে অভিনয় করে যা আগের দিনের অভিনেতাদের সঙ্গে আদৌ মেলে না।
পাবলিকও চায় নতুন ধরনের অভিনয় আজকাল।
অবিশ্যি হরিদাস সামন্তর ডিমান্ড কমে যাওয়ার আরও একটা কারণ ছিল। অতিরিক্ত মদ্যপান ও আনুষঙ্গিক অত্যাচারে শরীরটা যেন কেমন তাঁর ভেঙে শুকিয়ে গিয়েছিল, বয়সের আন্দাজে বেশ বুড়োই মনে হত তাঁকে।
বয়সের জন্যই তাঁকে হিয়োর রোল থেকে আগেই সরে আসতে হয়েছিল। শেষে ক্যারেক্টার রোল থেকেও ক্রমশঃ তাঁকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল।
এবং শেষ পর্যন্ত একদিন যখন হরিদাস বুঝতে পারলেন মঞ্চের প্রয়োজন তাঁর জন্য ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে—এবং হয়ত শীঘ্রই একদিন নোটিশ পেতে হবে-হরিদাস সামন্ত নিজেই স্টেজ থেকে সরে গেলেন।
একটা সুযোগও তখন এসে গিয়েছিল।
নিউ অপেরা যাত্রাপার্টি থেকে তাঁর ডাক এল। মাইনেটাও মোটা রকমের। হরিদাস সামন্ত সঙ্গে সঙ্গে আগত লক্ষ্মীকে সাদরে বরণ করে নিলেন।
ঐ সময়টায় যাত্রার দলগুলো আবার নতুন করে বাঁচবার চেষ্টা করছিল। মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তারা দলে মোটা মাইনে দিয়ে টানতে শুরু করেছিল। অনেকে সেজন্য যাত্রার দলে নাম লেখাতে শুরু করেছিল। সেখানেই অভিনেত্রী সুভদ্রার সঙ্গে পরিচয়।
অভিনেত্রী বললে ভুল হবে, কারণ সুভদ্রা তখন মাত্র মাস আষ্টেক ঐ যাত্রার দলে যোগ দিয়েছে। নয়া রিক্রুট। রেফিউজী কলোনীর মেয়ে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা। সুভদ্রার বয়স তখন কুড়ি-একুশের বেশী নয়। পাতলা দোহারা, গায়ের বর্ণ শ্যাম কিন্তু চোখ-মুখের ও দেহের গড়নটি ভারি চমৎকার। যৌবন যেন সারা দেহে উপচে পড়ছে।
ওকে দেখে ও ভাবভঙ্গি দেখে ঝানু অভিনেতা হরিদাস সামন্ত বুঝতে পেরেছিলেন—মেয়েটির মধ্যে পার্টস আছে। ঠিকমত তালিম দিয়ে খেটেখুটে তৈরী করতে পারলে মেয়েটির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
দলের প্রোপ্রাইটার রাধারমণ পাল মশাইকে কথাটা বললেন হরিদাস সামন্ত।
পাল মশাই বললেন, বেশ তো, দেখুন না চেষ্টা করে সামন্ত মশাই।
তাহলে ওকে আমার হাতে ছেড়ে দিন, আমি তৈরী করে দেব।
বেশ, করুন।
একটা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন হরিদাস সামন্ত এবং তাঁর অনুমান যে মিথ্যা নয় সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। সুভদ্রার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তার অভিনয়ের দ্যুতি ঝিলমিল করে উঠল।
অভিনয়ের তালিম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার যে তলে তলে ঘটে যাচ্ছিল সেটা আর কেউ দলের না বুঝলেও রাধারমণ পাল মশাই সেটা বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। কারণ যাত্রার দলে ঐ ধরণের ব্যাপার ঘটেই থাকে। এক-একজন অভিনেতার সঙ্গে এক-একজন অভিনেত্রী কেমন যেন জোট বেঁধে যায়। ক্রমশঃ হরিদাস তাঁর বাড়িঘরের সঙ্গে সম্পর্কই প্রায় তুলে দিলেন।
বাড়িতে স্ত্রী চিররুগ্না।
দুটি ছেলে। বড়টি তেইশ-চব্বিশ বৎসরের, একটি ফ্যাক্টরিতে মেকানিক—সুশান্ত। কুড়ি-একুশ বৎসরের ছোটটি প্রশান্ত পাড়ায় মস্তানী করে বেড়ায়।
প্রৌঢ় বয়সে কোন পুরুষের চোখে যদি কোন নারী পড়ে, তখন তার সাধারণ লাজ-লজ্জার বালাইটাও বোধ হয় থাকে না। প্রৌঢ় হরিদাসেরও সুভদ্রার প্রতি নেশাটা যেন তাঁকে একেবারে বেপরোয়া করে তুলেছিল। যাত্রার দলে তিনি বেশ ভাল মাইনেই পেতেন এবং প্রোপ্রাইটার পাল মশাইয়েরও বোধ হয় হরিদাসের প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল। সেই কারণেই হরিদাস সুভদ্রাকে নিয়ে ঘর বাঁধলেন।
হরিদাস নেবুতলায় একটা বাসা ভাড়া নিলেন, সুভদ্রা তাঁর সঙ্গে সেখানেই থাকতে লাগল।
ক্রমশঃ দলের মধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল।
কেউ কেউ আড়ালে মুখ টিপে হেসেছিল প্রৌঢ় হরিদাস ও যুবতী সুভদ্রার ব্যাপার-স্যাপার দেখে। বছর দুয়েক হরিদাসের বেশ আনন্দেই কেটে গেল। তারপরই হরিদাস সামন্তর ভাগ্যাকাশে যেন ধূমকেতুর উদয় হল।
তরুণ অভিনেতা, বছর ছাব্বিশ হবে বয়েস, শ্যামলকুমার এসে দলে যোগ দিল। শ্যামলকুমার দেখতে শুনতেও যেমন চমৎকার তেমনি কণ্ঠস্বরটিও ভরাট মাধুর্যপূর্ণ। অভিনয়েও পটু। পাল মশাই শ্যামলকুমারকে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে যেন লুফে নিলেন।
কিছুদিন পরে নতুন বই খোলা হল। শ্যামলকুমার নায়ক—সুভদ্রা নায়িকা। পালা দারুণ জমে গেল।
শ্যামলকুমার আসার কিছু আগে থাকতেই হরিদাস আর নায়কেররোল করতেন না। ক্যারেকটার বোলগুলো করতেন। দলের অন্য একটি ছেলে নায়কের রোল করত।
শ্যামলকুমারের কিন্তু দলে এসেই সুভদ্রার প্রতি নজর পড়েছিল। সুভদ্রার যৌবন তাকে আকৃষ্ট করেছিল—এবং দেখা গেল সুভদ্রাও পিছিয়ে নেই। যোগাযোগটা স্বাভাবিকই।
হরিদাস সামন্ত তখনও কিছু বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারেননি যে, সুভদ্রার মনটা ধীরে ধীরে শ্যামলকুমারের দিকে ঝুঁকছে। বুঝতে যখন পারলেন তখন নাটক অনেকখানি গড়িয়ে গিয়েছে।
স্ত্রী সুধাময়ীর অসুখটা হঠাৎ বাড়াবাড়ি হওয়ায় হরিদাস সামন্ত কটা দিন নেবুতলার বাসায় যেতে পারেননি। তারপর স্ত্রী মারা গেল। শ্রাদ্ধ-শান্তি চুকবার পর এক রাত্রে আটটা নাগাদ হরিদাস নেবুতলার বাসায় গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলেন।
ভিতরে থেকে একটু পরে সুভদ্রার সাড়া এল, কে?
আমি হরিদাস-দরজা খোল।
আজ আমার শরীরটা ভাল নেই। তুমি বাড়ি যাও, কাল এস।
তা দরজাটা খুলছ না কেন? দরজাটা খোল।
বলছি তো শরীরটা খারাপ। জবাব এল সুভদ্রার ভিতর থেকে।
হরিদাসের মনে কেমন সন্দেহ জাগে। ইদানীং কিছুদিন ধরে সুভদ্রার ব্যবহারটাও যেন কেমন ঠেকছিল। তাই তিনি বললেন, দরজা খোল সুভদ্রা—
দরজা অতঃপর খুলে গেল। কিন্তু খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সুভদ্রা নয়-শ্যামলকুমার।
কয়েকটা মুহূর্ত হরিদাসের বানিষ্পত্তি হয় না। তিনি যেন বোবা। পাথর।
শ্যামলকুমার পাশ কাটিয়ে বেরুবার উপক্রম করতেই সামন্ত বললেন, দাঁড়াও শ্যামল—
শ্যামলকুমার দাঁড়াল।
তুমি এত রাত্রে এখানে কি করছিলে?
কেন বলুন তো?
শ্যামলকুমারের গলার স্বরটা যেন ধক্ করে হরিদাসের কানে বাজে।
এটা আমার বাসাবাড়ি, জান?
জানি বইকি। আর কিছু আপনার বলবার আছে?
তোমার এতদূর স্পর্ধা!
সামন্ত মশাই, ভুলে যাবেন না, আমি আপনার মাইনে করা ভৃত্য নই। কথাটা বলেই আর শ্যামলকুমার দাঁড়াল না, একপ্রকার যেন হরিদাসকে ধাক্কা দিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল সুভদ্রা। শ্যামলকুমারের ঠিক পিছনেই।
হরিদাস সামন্ত এবার ডাকলেন, সুভদ্রা–
কি?
সুভদ্রা অন্ধকার থেকে এগিয়ে এল হরিদাসের সামনে।
এসবের মানে কি?
মানে আবার কি? দেখতেই তো পাচ্ছ। সুভদ্রার স্পষ্ট জবাব, বলায় কোন দ্বিধা বা সংকোচ নেই। লজ্জা বা কোন অনুতাপের লেশমাত্রও নেই যেন।
তাহলে যা কানাঘুষায় শুনছিলাম তা মিথ্যে নয়?
মাঝরাত্রে চেঁচিয়ো না।
কি বললি হারামজাদী, চেঁচাব না? একশবার চেঁচাব—হাজারবার চেঁচাব। আমারই ভাড়াবাড়িতে বসে আমারই খাবি, আমারই পরবি–
কিন্তু হরিদাস সামন্তকে কথাটা শেষ করতে দিল না সুভদ্রা, বললে, আমি তোমার বিয়ে-করা সাতপাকের ইস্তিরী নই হরিদাসবাবু। অত চোখ রাঙারাঙি কিসের?
কি হল হরিদাসের—দপ করে যেন মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। বাঘের মতই সুভদ্রার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাথাড়ি সুভদ্রাকে কিল চড় ঘুষি লাথি চালাতে লাগলেন হরিদাস।
সুভদ্রা মাটিতে পড়ে ককিয়ে কাঁদতে লাগল।
হরিদাস সামন্ত ঐ পর্ষন্ত বলে থামলেন।
.
তারপর? কিরীটী জিজ্ঞাসা করলে।
পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলে তারপর বললেন হরিদাস সামন্ত।
তাহলে বলুন ব্যাপারটা মিটে গেল?
মিটল আর কোথায় রায় মশাই! আমিও ভেবেছিলাম বুঝি প্রথমটায় মিটে গেল। কিন্তু তারপর দিন পনেরো না যেতেই বুঝলাম–
কি বুঝলেন?
সুভদ্রা বাইরে শান্ত ও চুপ করে থাকলেও গোপনে ওদের দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ হয়নি। আবার একদিন ধরা পড়েও গেল—আবার ধোলাই দিলাম।
আবার মারধোর করলেন?
করব না?
কি বলছেন আপনি রায় মশাই—এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা! কিন্তু যেন সমস্ত ব্যাপারটা অন্যদিকে বইতে শুরু করল।
কি রকম?
বুঝলাম ওরা দুজনে তলে তলে আমাকে সরিয়ে দেবার জন্য বদ্ধপরিকর। কিন্তু মুখে অন্য রকম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তারপর একটু থেমে হরিদাস সামন্ত বললেন, একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি—শ্যামলকুমার যে নাটক লিখতে জানে জানতাম না। হঠাৎ একদিন ঐ ঘটনার দিন পনেরো পরে পাল মশাই আমাকে ডেকে বললেন- সামন্ত মশাই, একটা চমৎকার পালা হাতে এসেছে।
তাই নাকি? জিজ্ঞাসা করলাম।
হ্যাঁ। নতুন লেখক—আর কে জানেন?
কে?
আমাদেরই দলের একজনের লেখা।
কার লেখা?
কে আবার আমাদের দলের নাটক লিখল?
বলুন তো কে? অনুমান করুন তো?
মশাই, পারলাম না।
পারলেন না তো! শ্যামলকুমার।
বলেন কি!
হ্যাঁ। ছেলেটার মধ্যে সত্যিই একটা পার্টস আছে। পালাটা সত্যি চমৎকার হয়েছে। এক কামুক-প্রৌঢ়ের পাটটা দারুণ। ঠিক করেছি সেই প্রৌঢ়ের রোলটাই আপনি করবেন। নায়িকা হবে সুভদ্রা আর নায়ক শ্যামলকুমার। কাল থেকেই রিহার্শেল শুরু করছি। গল্পটি মোটামুটি হচ্ছে প্রৌঢ়ের কাছেই থাকত সুভদ্রা। পরে সেখানে এল গল্পের নায়ক জ্যোর্তিময় বলে ছোকরাটি—তারপর আসল ও সত্যিকারের নাটকের শুরু। একেবারে জমজমাট। আপনি শ্যামলকুমার আর সুভদ্রা যদি তিনটে রোল নেন তো দেখতে হবে না—একেবারে বাজিমাত।
তারপর? কিরীটী শুধাল।
আমি কি তখন জানি নাটকের বিষয়বস্তুটা কি এবং কতখানি। বললাম, বেশ তো, নাটকটা যদি ভাল হয়—
ভাল কি বলছেন মশাই, একেবারে সত্যিকারের একখানি নাটক। এখন বলুন কাল থেকে রিহার্শেল শুরু করবেন তো? সামনের রথযাত্রার দিন থেকেই মহলা শুরু করা যাক। কি বলেন?
বেশ তো।
হরিদাস সামন্ত বলতে লাগলেন, নাটকের মহলা শুরু হল। নাটকের নাম কি জানেন রায় মশাই?
কি? কিরীটী প্রশ্ন করল।
সুভদ্রা হরণ।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। সামাজিক পালার ঐ ধরনের নাম কখনও শুনেছেন? তার চাইতেও বড় কি জানেন রায় মশাই?
কি?
নাটকের বিষয়বস্তু অবিকল আমার ও সুভদ্রার মধ্যে যেমন শ্যামলকুমারের আবিভাব ঠিক তেমনি। তবে অত্যন্ত কুৎসিত ভাবে।
কি রকম?
রাখালকে করা হয়েছে নাটকে সুভদ্রার পালিত বাপ—যে বাপ শেষ পর্যন্ত মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হল। ভাবতে পারেন কি জঘন্য মনোবৃত্তি! পাল মশাইকে আমি বলেছিলাম ঐ ধরনের বিশ্রী ব্যাপার পালায় আদৌ থাকা উচিত নয়। কিন্তু পাল মশাই হেসেই উড়িয়ে দিলেন আমার কথাটা। বললেন—আধুনিকতা আছে ব্যাপারটার মধ্যে।
নাটকের শেষ কি?
নাটকের শেষ দৃশ্যে রাখাল বিষপান করবে—ঘৃণায়, অপমানে। কাল বাদে পরশু সেই পালার প্রথম অভিনয় রজনী—চন্দননগরে।
তা এ ব্যাপারে আপনার দিক থেকে বিপদের বা আশঙ্কার কি আছে?
রায় মশাই, আমি বুঝতে পারছি–
কি?
ওরা আমাকে শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই হত্যা করার মতলব করছে।
হত্যা করবে? বলেন কি? কিরীটী বললে।
হ্যাঁ। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, ঐ যে নাটকের মধ্যে বিষপ্রয়োগের ব্যাপারটা আছে—আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ঠিক ঐ থেকেই সত্যিসত্যিই আমাকে ওরা হত্যা করার–
না, না —তা কখনও সম্ভব?
সম্ভব। ওদের পক্ষে সবই এখন সম্ভব। ওরা মরীয়া হয়ে উঠেছে।
তা এতই যদি আপনার ভয়, দল ছেড়ে দিন না।
ছাড়তে চাইলেও ছাড়া পাব না, কারণ বেশ কিছু টাকা ধারি পাল মশাইয়ের কাছে আমি। অথচ পুলিসকে একথা বললে তারা হেসেই উড়িয়ে দেবে। তাই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি রায় মশাই। আমাকে আপনি বাঁচান।
কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে, সুভদ্রার মনোভাব এখন আপনার প্রতি কেমন? সে এখনও আপনার সঙ্গেই আছে তো?
তা আছে। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তলে তলে ও ছুরি শানাচ্ছে।
সামন্ত মশাই, কিছু যদি মনে করেন তো একটা কথা বলব?
কি বলুন?
সুভদ্রাকে আপনি ছেড়ে দিন না—
সুভদ্রাকে ছাড়াও যা মৃত্যুবরণ করাও তা। তা যদি পারতাম তবে আর আপনার শরণাপন্ন হব কেন?
কথাগুলো বলতে বলতে সামন্ত পকেট থেকে দশ টাকার দশখানা নোট বের করে এগিয়ে ধরলেন।–গরীব অভিনেতা আমি রায়মশাই, আপনার যোগ্য পারিশ্রমিক দেবার সাধ্য বা ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই। আপাততঃ এটা—
টাকা থাক সামন্ত মশাই। কারণ আমি নিজেই এখনও বুঝতে পারছি না কিভাবে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি। আচ্ছা পরশু তো চনন্দনগরে আপনাদের অভিনয়?
হ্যাঁ—প্রথম গাওনা।
আমি যাব। আপনাদের গ্রীনরুমের আশেপাশেই থাকব। তবে—
তবে?
আমাকে হয়ত চিনে ফেলবে শ্যামলকুমার আর সুভদ্রা। তাই ভাবছি—
বলুন?
এক প্রৌঢ়র ছদ্মবেশে—আপনার বন্ধুর পরিচয়ে যাব।
বেশ। খুব ভাল প্রস্তাব।
তাহলে সেই কথাই রইল। আমার নাম বলবেন ধূর্জটি রায়। এককালে অভিনয় করতাম। আপনার পুরাতন বন্ধু।
ঠিক আছে, তাই হবে।
অতঃপর হরিদাস সামন্ত বিদায় নিলেন।
০৩. হরিদাস সামন্ত বিদায় নেবার পর
হরিদাস সামন্ত বিদায় নেবার পরই কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল।
কেন এসেছিলেন গো ভদ্রলোক?
লোকটা কে জান কৃষ্ণা?
না। ‘এককালে মঞ্চের নামকরা অভিনেতা ছিল, এখন যাত্রার দলে অভিনয় করে। বয়েস হয়েছে। বোধ করি তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন হবে?
তা কি চান উনি তোমার কাছে?
কিরীটী সংক্ষেপে হরিদাস-বৃত্তান্ত কৃষ্ণাকে শোনাল।
কৃষ্ণা সব শুনে বললে, বুড়োর এখনও এত রস!
বুড়ো বয়সেই তো রসাধিক্য হয়, বুঝতে পারছ না আমাকে দিয়ে?
তা কিছু কিছু বুঝতে পারছি বৈকি।
অতএব হে নারী, সতর্ক হইও।
বয়ে গেছে আমার।
বটে! এত সাহস!
যাও না, একবার দেখ না চেষ্টা করে।
পাচ্ছি না যে।
ওহো, কি দুঃখ রে!
দুজনেই হেসে ওঠে।
কিরীটী হরিদাস সামন্তর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই স্থির করেছিল—যাত্রার দলের মানুষগুলো যারা হরিদাস সামন্তর জীবনে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী—বিশেষ করে শ্যামলকুমার ও সুভদ্রা তাদের সে দেখবে। ওদের অফিসে গিয়েও পরিচয় হতে পারে। কিন্তু একজন উটকো লোক দেখলে—বিশেষ করে কোনক্রমে যদি তারা পরিচয় জানতে পারে, তারা হয়ত কিছুটা সচেতন হয়ে যেতে পারে। তাই সে মনে মনে স্থির করে যাত্রার আসরে গিয়ে যাত্রাও দেখা হবে, লোকগুলোকে দেখাও হবে। চাই কি পরিচয়ও হতে পারে।
এবং তাতে করে হয়ত তাদের মনের খবরাখবরও কিছু আঁচ করাও যেতে পারে। সেই ভেবেই চন্দননগরে যেদিন পালাগান সেদিন সেখানে সে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়।
চন্দননগর শহরে এক বনেদী ধনীগৃহের বিরাট নাটমঞ্চে যাত্রার আসর বসেছে।
আর সে যুগ নেই—এখন কৃষ্টির অন্যতম ধারক ও বাহক যাত্রাপালা। আজকাল টিকিট কেটে যাত্রা-গান হয়। শ্রোতাও হয় প্রচুর। তাছাড়া নবকেতন যাত্রা পার্টির নাম খুব ছড়িয়েছিল এ সময়। বিশেষ করে তাদের অভিনেতা-অভিনেত্রী শ্যামলকুমার ও সুভদ্রার জুটির জন্য।
পালা শুরু হবে রাত আটটায়। কিরীটী সন্ধ্যার মুখোমুখিই গিয়ে চন্দননগর স্টেশনে নামল ট্রেন থেকে। গ্রীষ্মকাল। কিন্তু শহরের প্যাচপেচে গরম এদিকটায় নেই যেন। কিরীটীর চেহারা ও বেশভূষা দেখে তাকে কারও চিনবার উপায় ছিল না। মাথার মাঝখানে টেরি। অনেকটা সেকেলে কলকাতা শহরের বনেদী লোকেদের মত বেশভূষা।
পরনে শান্তিপুরের মিহি ধৃতি, গায়ে গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবি, চোখে চশমা—পুরুষ্ট একজোড়া গোঁফ মোম দেওয়া। গলায় একটি পাকানো চাদর-গিঁট দেওয়া। পায়ে চকচকে পাম্পসু। হাতে বাহারে ছড়ি।
এককালে ঐ ধরনের বাবুদের কলকাতা শহরে প্রায়ই দেখা যেত।
স্টেশনের বাইরে এসে একটা সাইকেল-রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করতেই কিরীটী জানতে। পারল যাত্রার আসর কোথায় বসেছে।
রিকশাওয়ালা শুধায়, যাত্রা দেখবেন বাবু?
কিরীটী হেসে বলে, আমার এক বন্ধু ঐ দলে অভিনয় করে। শ্রীরামপুরে থাকি। অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। তার সঙ্গেও দেখা হবে, যাত্রাও দেখা হবে ঐ সঙ্গে।
উঠুন বাবু, পৌঁছে দিচ্ছি। এক টাকা ভাড়া লাগবে।
তাই পাবে। চল।
উঠুন।
কিরীটী উঠে বসল সাইকেল-রিকশায়। রিকশাওয়ালা একটা হিন্দী ফিল্মের গান গুন গুন। করে গাইতে গাইতে রিকশা চালাতে লাগল।
মিনিট পনেরো লাগল যাত্রার আসরে পৌঁছতে।
মস্ত বড় সেকেলে পুরাতন জমিদারবাড়ি।
বিরাট নাটমঞ্চ। চারিদিক ঘিরে সেখানে আসরের ব্যবস্থা হয়েছে।
গেটের সামনে সাইকেল-রিকশা থেকে নেমে কিরীটী রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভেতরের দিকে এগুল।
অল্পবয়সী যাত্ৰর দলের একটি ছোকরা গেটের সামনে বসেছিল। শ্রোতাদের আসা তখনও ভাল করে শুরু হয়নি।
কিরীটী সেই ছেলেটিকেই শুধাল, হরিদাস সামন্ত মশাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে?
এখন তো তিনি গ্রীনরুমে আছেন।
তা জানি, তাঁকে যদি একটা খবর দেন বলবেন তাঁর অনেক কালের বন্ধু ধূর্জটি রায় তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চান—
আসুন আমার সঙ্গে। তারপর আবার কি ভেবে ছেলেটি অন্য একটি তরুণকে ডেকে বললে, ওরে সুবল, এই বাবুটিকে সামন্ত মশাইয়ের কাছে নিয়ে হ্যাঁ।
সুবল একবার কিরীটীর আপাদমস্তক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললে, চলুন।
বিরাট নাটমঞ্চে কতকগুলো পাশাপাশি টিনের পাটিশান তুলে ছোট ছোট ঘরের মত করে সাজঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারই একটার সামনে এসে সুবল বললে, যান ভেতরে, সামন্তদা এই ঘরেই আছেন।
কিরীটী ভিতরে প্রবেশ করল। কিন্তু ভিতরে পা ফেলেই থমকে দাঁড়াল। ঘরের মধ্যে একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বৎসরের যুবতী। উভয়েই পিছন ফিরেছিল বলে কিরীটীক ওরা দেখতে পায়নি।
মেয়েটির সারা দেহে যৌবন টলমল করছে। মেয়েটি বিশেষ লম্বা নয় বরং একটু বেঁটেরই দিকে। কিন্তু ছিপছিপে গড়নের জন্য বেমানান দেখায় না। পরনে একটা মুর্শিদাবাদ সিল্কের শাড়ি। একমাথা চুল, এলো খোঁপা করে। খোঁপাটা পিঠের উপর যেন ঝুলছে।
মেয়েটি দাঁড়িয়ে—সামন্ত মশাইও দাঁড়িয়ে। তাঁর পরনে একটা লুঙ্গি ও আদ্দির পাঞ্জাবি। ওঁদের কথাবাত কিরীটীর কানে আসে।
কেন, ডাকছ কেন? মেয়েটি বলল।
সুভদ্রা, আজ পালা শেষ হলে আমরা বের হয়ে পড়ব। হরিদাস সামন্ত বললেন।
না, আমি কাল ভোররাত্রের টেনে বর্ধমান যাব। সুভদ্রা বললে।
বর্ধমান! বর্ধমান কেন?
সবই তোমাকে বলতে হবে নাকি? সুভদ্রার কণ্ঠে যেন বিদ্রোহের সুর।
তা বলতে হবে না! সঙ্গে বোধ হয় শ্যামলকুমার চলেছে?
চলেছে কি না চলেছে যাওয়ার সময়ই দেখতে পাবে।
সুভদ্রা, তুমি ভাব, আমি কিছুই বুঝি না।
কি বুঝেছ শুনি?
সেদিনকার পিটুনির কথা নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওনি?
শোন, তোমাকেও আমি স্পষ্ট করে আজ বলে দিচ্ছি, তোমার নেবুতলার বাসায় আর আমি যাব না।
উঃ! তলে তলে তাহলে বাসাও ঠিক হয়ে গিয়েছে?
সুভদ্রা কোন জবাব দিল না, যাবার জন্যই বোধ করি ঘুরে দাঁড়াল। আর দাঁড়াতেই কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল।
কে আপনি?
হরিদাস সামন্তরও দৃষ্টি ইতিমধ্যে পড়েছিল কিরীটীর উপরে।
কি হে সামন্ত, চিনতে পার।
কে?
ধূর্জটি—আমি ধূর্জটি রায় হে!
ধূর্জটি?
চিনতে পারছ না? সেই যে–
হরিদাস সামন্ত প্রথমটায় সত্যিই কিরীটীকে চিনতে পারেনি। কিরীটীর চোখ টিপে ইশারা করায় দুদিন আগেকার সব কথা তাঁর মনে পড়ে যায়। বলে ওঠেন—ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ধূর্জটি! কোথা থেকে হে?
শুনলাম তুমি পালা-গান গাইতে এসেছ—তাই ভাবলাম অনেককাল দেখাসাক্ষাৎ নেই, দেখা করে যাই।
হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার চিনেছি। উঃ, কতদিন পরে দেখা! তা বেশ—বেশ করেছ।
আজ তোমাদের পালা তো সুভদ্রা হরণ?
কথাটা বলে আড়চোখে একবার কিরীটী সুভদ্রার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ।
উনিও বুঝি তোমাদের দলে অভিনয় করেন?
হ্যাঁ। ওই-ই তো নায়িকা সাজে। ওর নাম সুভদ্রা মন্ডল।
নমস্কার। কিরীটী হাত তুলে নমস্কার করে।
সুভদ্রাও প্রতিনমস্কার জানায়।
কিরীটী বললে, পালার নামটির সঙ্গে আপনার নামটিও তো বেশ মিল করাই। পালাটা কে লিখেছে হে সামন্ত? পৌরাণিক?
না, সামাজিক জবাব দিল সুভদ্রা।
সামাজিক?
হ্যাঁ। দেখবেন না পালাটা! ভাল লাগবে পালাটা আপনার। কথাগুলো বলতে বলতে বার দুই সুভদ্রা আড়চোখে হরিদাস সামন্তর দিকে তাকাল।
কিরীটীর মনে হল সুভদ্রার ওষ্ঠের প্রান্তে যেন একটা বাঁকা হাসির চকিত বিদ্যুৎ খেলে গেল।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই দেখব, এসেছি যখন! কিরীটী বললে।
সুভদ্রা, ওকে এক কাপ চা পাঠিয়ে দাও।
তা ওহে সামন্ত, শুনেছি তোমাদের শ্যামলকুমার নাকি অদ্ভুত অভিনয় করে। তার সঙ্গে একটিবার আলাপ হয় না?
জবাব দিল সুভদ্রা, কেন হবে না? শ্যামলই তো এ নাটকের নাট্যকার। আমি এক্ষুনি শ্যামলকে ডেকে আনছি।
খুশিতে যেন ডগমগ হয়ে সুভদ্রা লঘুপদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সুভদ্রার পদশব্দ মিলিয়ে গেল বাইরে।
০৪. কিরীটী হরিদাস সামন্তর দিকে
কিরীটী হরিদাস সামন্তর দিকে ফিরে তাকাল।
এই আপনার সুভদ্রা, সামন্ত মশাই?
হ্যাঁ। কি মতলব করেছে ওরা জানেন? আজই ওরা ভোরাত্রের গাড়িতে বর্ধমান যাবে।
শুনলাম তো।
শুনেছেন?
হ্যাঁ। ঘরে ঢোকার মুখে আপনাদের শেষের কথাগুলো কানে এল।
কিন্তু আমারও প্রতিজ্ঞা, তা হতে দিচ্ছি না। সামন্ত বললেন।
সামন্ত মশাই, ও কালনাগিনী। মিথ্যে শুধু ছোবল খাবেন। যাক সেকথা। আপনাদের পালা। শুরু হচ্ছে কখন?
রাত ঠিক আটটা। এখন সাড়ে ছটা। আর দেড় ঘণ্টা বাদে।
আমাকে আসরে বসবার একটা জায়গা করে দেবেন? নিশ্চয়ই।
ভাল কথা, আপনাদের এই নাটকে কোন অঙ্কে যেন রাখালকে বিষ দেবার কথা!
বিষ কেউ দিচ্ছে না। পালায় আছে বিষ, আমিই নিজে স্বেচ্ছায় পান করব সুভদ্রা তার প্রেমিকের সঙ্গে চলে যাচ্ছে জানতে পেরে।
ওঃ, তাহলে জেনেশুনেই বিষপান? বিষপ্রয়োগ নয়? কিরীটী বললে।
হ্যাঁ, জেনেশুনেই বিষপান।
তবে—
কি তবে?
দৃশ্যটা কি রকম বলুন তো?
আমি একটা গ্লাস হাতে আসরে যাব, তাতে বিষ রয়েছে।
তারপর?
আসরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করব বিষটা, তারপর গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টলতে টলতে বের হয়ে আসব আসর থেকে।
তাহলে আসরের মধ্যে পতন ও মৃত্যু নয়?
না। নেপথ্যে।
তাহলে আর আপনার এত ভয় কেন?
মানে?
গ্লাস তো আপনিই নিয়ে যাবেন নিজে হাতে আসরে?
না।
তবে?
সুভদ্রাকে ডেকে বলব গ্লাসটা নিয়ে আসতে। সে এনে দেবে গ্লাস আসরে।
তাই নাকি! এ যে দেখছি—
কিরীটীর কথা শেষ হল না।
সুভদ্রা ও শ্যামলকুমার এসে সাজঘরে ঢুকল।
সুভদ্রার হাতে এক কাপ চা। কিরীটী দেখল, শ্যামলকুমারের বয়স আটাশ-ঊনত্রিশের বেশী হবে না।
ভারি সুশ্রী চেহারাটি। যেমন নায়কোচিত দেহের গঠন, তেমনি পুরুষোচিত স্বাস্থ্য ও যৌবন যেন কানায় কানায় উপচে পড়ছে।
কালো রং হলেও দেখতে সুন্দর। যাকে বলে সত্যিকারের সুপুরুষ। অভিনেতার মতই চেহারা বটে।
সুভদ্রা হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে কিরীটীর দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললে, এই নিন চা। এই আমাদের শ্যামলকুমার, নাটকও এরই লেখা।
আপনিই নাট্যকার?
আজ্ঞে।
এই বুঝি আপনার প্রথম নাটক? কিরীটী শুধায়।
হ্যাঁ। বিনীতভাবে জবাব দিল শ্যামল। শুনলাম আপনি সামন্তবাবুর বন্ধু। আজ আমাদের নাটকটা দেখে যান না।
এসেছি যখন দেখে যাব বৈকি।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী আবার বললে, কিন্তু নাটকের অমন একটা অদ্ভুত পৌরাণিক প্যাটার্নের নাম রাখলেন কেন শ্যামলবাবু?
শ্যামলকুমার মৃদু হেসে বললে, নাটকটা না দেখলে বুঝতে পারবেন না। আগে দেখুন, তারপর আপনার সঙ্গে আলোচনা করব। আচ্ছা তাহলে আমরা চলি। প্রথম দৃশ্যেই আমার আর সুভদ্রার প্রবেশ আছে। এস সুভা–
শ্যামলকুমার সুভদ্রাকে ডেকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী গোড়া থেকেই লক্ষ্য করছিল আড়চোখে, শ্যামলকুমার আর সুভদ্রার দিকে জ্বলন্ত অগ্নিক্ষরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন হরিদাস সামন্ত।
মনে হচ্ছিল যেন এখুনি ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন এবং পারলে ওদের দুজনের টুটি ছিঁড়ে ফেলেন।
ওরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই হরিদাস সামন্ত যেন ফেটে পড়লেন, দেখলেন—দেখলেন তো স্বচক্ষে রায় মশাই! এরপরও বলবেন, ওরা মনে মনে আমাকে হত্যা করবার সঙ্কল্প আঁটছে না? উঃ কি সাঙ্ঘাতিক, কি ভয়ানক শয়তানী!
অধীর হবেন না সামন্ত মশাই।
অধীর হব না, কি বলছেন রায় মশাই? আমি তো একটা মানুষ, না কি?
ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তাহলেও একটা কথা কি জানেন? ওরা মনে মনে যদি কোন মতলব এঁটেই থাকে কৌশলে ওদের পথ থেকে আপনাকে সরাবার, রাগারাগি করে চেঁচামেচি করলে বা এমন করে অধৈর্য হলে ওদের তাতে করে সুবিধাই হবে।
পারছি না, এত অত্যাচার আর আমি সহ্য করতে পারছি না রায় মশাই। তাছাড়া আপনাকে তো এখনও একটা কথা বলিইনি।
কি কথা?
আজ আবার ঐ রাস্কেলটার সঙ্গে দুপুরে আমার একচোট হয়ে গিয়েছে।
কার কথা বলছেন? কিরীটী শুধাল।
কার কথা বলছি বুঝতে পারছেন না? ঐ শ্যামলকুমার!
কি হল তার সঙ্গে আবার?
জানেন, ও আমাকে আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছে আজ।
আলটিমেটাম?
হ্যাঁ। দুপুরের ট্রেনে আসতে আসতে শ্যামলকুমার আমাকে বলেছে—
কি বলেছে?
ওদের পথ থেকে যদি আমি না সরে দাঁড়াই তো ওরাই আমাকে সরাবার ব্যবস্থা করবে।
তাই নাকি!
কথাটা কয়েকদিন আগেও শ্যামলকুমার আমাকে একবার বলেছিল।
ওরাই—মানে কি? আপনার কি মনে হয়, ঐ ষড়যন্ত্রের মধ্যে সুভদ্রাও আছে?
নিশ্চয়ই আছে।
কিরীটী ক্ষণকাল যেন কি ভাবল। তারপর বলে, ঠিক আছে।
বাইরে ঐ সময় পালা শুরু হবার প্রথম বেল পড়ল।
ঐ যাঃ, প্রথম বেল পড়ল—প্রথম দৃশ্যের শেষের দিকে আমার অ্যাপিয়ারেন্স আছে। হরিদাস। সামন্ত বলে উঠলেন।
আপনি প্রস্তুত হয়ে নিন।
আপনি?
আসরে আমার বসবার একটা জায়গা করে দিন সামনের রোতে, যাতে করে ওদের দুজনকে আরও ভাল করে দেখে নাটকটা ভাল করে শুনতে পারি।
ঠিক আছে। চলুন, আপনাকে আমি বসিয়ে দিয়ে আসি। তারপর মেকআপে বসব, চলুন।
চলুন।
সামন্ত মশাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী ওঁর গ্রনরুম থেকে বেরুল।
গমগম করছিল যেন আসর।
দর্শনাথীতে একেবারে যেন ঠাসাঠাসি আসর তখন।
তিল-ধারণেরও স্থান নেই। হরিদাস সামন্ত পাল মশাইকে বলে প্রথম সারিতেই আসরের একেবারে সামনাসামনি একটা চেয়ারে কিরীটীকে বসিয়ে দিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষন পরে পালা শুরু হল।
.
কিরীটী তন্ময় হয়ে পালা শুনছিল।
নাটকটি বেশ লাগে কিরীটীর। চমৎকার লিখেছে ছেলেটি। কে বলবে একটি তরুণের ঐ প্রথম প্রয়াস।
যেমন ঘটনার বাঁধুনী তেমনি নাটকীয় সংঘাত, আর তেমনি নাটকের সংলাপ।
আরও আশ্চর্য লাগছিল কিরীটীর, হরিদাস সামন্তর কাছে কয়েকদিন আগে শোনা তাঁর জীবনকাহিনীই যেন নাটকের কাহিনীর মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে।
এক বৃদ্ধের এক তরুণীর প্রতি আকর্ষণ,—যে আকর্ষণের টানে সে তার নিজের সংসারকে ভাসিয়ে দিল, অথচ ঐ বৃদ্ধ ঐ তরুণীর সম্পর্কে পালিত পিতার মতই। এমন সময় নাটকে শুরু হল ওদের সংসারে এক তরুণকে নিয়ে সংঘাত।
মেয়েটি সহজেই তরুণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল স্বভাবতই, আর তাইতেই সংঘাত। এক ত্রিকোণ সংঘাত।
শেষ পর্যন্ত পালিত পিতার নিজের বিকৃত বাসনার জন্য মেয়েটির প্রতি জেগে ওঠে এক গভীর অনুশোচনা, যার ফলে সে স্থির করল সে নিজেই স্বেচ্ছায় ওদের পথ থেকে সরে দাঁড়াবে।
সে বিষপান করবে।
বিষ সংগ্রহ করে নিয়ে এল বৃদ্ধ এবং সেই বিষ সে এনে জলের পাত্রের মধ্যে ঢেলে দিল এবং মনস্থ করল মেয়েটির হাতের থেকে বিষ-মেশানো জল পান করবে, যাতে করে
সেই জল পান করলেই মৃত্যু হয়।
ক্রমশঃ নাটকের সেই দৃশ্য এল।
সুভদ্রা (নাটকের নায়িকা) কোথায় বের হয়েছিল, অনেক রাত্রে ফিরে এসে দেখে সেই বৃদ্ধ ঘরের মধ্যে একাকী চুপ করে বসে আছে।
সুভদ্রা বললে, পাশের ঘরে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছিলাম, খেয়েছ?
আজ আর কিছু খাব না সুভদ্রা। খাবে না?
না।
শুধু এক গ্লাস জল। টেবিলের ওপরে আছে, এনে দাও তো জলের গ্লাসটা।
শুধু জল খাবে?
হ্যাঁ।
সুভদ্রা চলে গেল এবং একটু পরে এক গ্লাস জল নিয়ে এল, এই নাও জল।
যাও, তুমি শুয়ে পড়ো গে।
সুভদ্রা চলে গেল।
নিজের হাতে বিষমিশ্রিত সেই জল পানের পূর্বে বৃদ্ধের সংলাপ : সুভদ্রা, তুমি সুখী হও। আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। একটা চিঠি রেখে যাব, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
এই জলে বিষ মিশিয়ে রেখেছি তুমি জান না, তোমরা হাত দিয়েই এই বিষ আমি পান করছি। আর তাই তো তোমরা মনে মনে চেয়েছিলে—তাই হোক, তাই হোক।
সংলাপগুলো উচ্চারণ করতে করতে টলতে টলতে হরিদাস সামন্ত জলটুকু পান করে গ্লাসটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর আসর থেকে প্রস্থান করলেন।
শেষ দৃশ্য।
রাখাল-বেশী হরিদাসের প্রস্থানের পরই সুভদ্রা আর নায়কের প্রবেশ।
কিরীটী যেন নাটকের কাহিনীর মধ্যে ড়ুবে গিয়েছিল।
সুভদ্রা।
বল জ্যোতির্ময়!
আর এই খাঁচার মধ্যে বন্দী হয়ে থাকতে পারছি না।
কি করতে চাও?
এ যেন সত্যি আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আমারও।
আমি ঠিক করেছি—
কি ঠিক করেছ?
আজ রাত্রেই আমরা পালাব।
আমি প্রস্তুত।
ইচ্ছে ছিল না আদৌ আমার এভাবে তোমাকে অপহরণ করে চোরের মত রাতের অন্ধকারে সরে পড়বার, কিন্তু–
কিন্তু কি?
সামনে দিয়ে গেলে ঐ বৃদ্ধ মনে নিদারুণ আঘাত পাবে। সুখের ঘর বাঁধতে চলেছি, কারও মনে কোন দুঃখ দেব না। ভাল করে শেষবারের মত ভেবে দেখ, তোমার মনে কোন চিন্তা বা সংকোচ নেই তো?
এতটুকুও না। ওর কুৎসিত দৃষ্টি আমাকে যেন লোভীর মত সর্বক্ষণ লেহন করছে। অথচ ও আমার পালিত বাপ। মুক্তি চাই আমি—মুক্তি চাই।
চল।
দুজনে হাত ধরাধরি করে আসর থেকে বের হয়ে যাবার উপক্রম করবে, আর ঠিক বেরুবার আগেই বাড়ির ভৃত্য এসে বলবে, দিদিমণি, শিগ্রী চলুন, বাবু কত্তাবাবু বোধ হয় মারা গেছেন।
কিন্তু ভৃত্য আর আসে না।
ভৃত্যও আর আসে না, ওরাও নাটকের সংলাপগুলো বলতে পারে না। ওরা ঘন ঘন ভৃত্য আসার প্রবেশপথের দিকে তাকাতে থাকে। নিজেদের মধ্যেই অস্ফুট কণ্ঠে বলাবলি করে ওরা। কিরীটী সামনে বসেই শুনতে পায়।
কি ব্যাপার, চাকর আসছে না কেন?
দু মিনিট, চার মিনিট, পাঁচ মিনিট কেটে গেল। অথচ ভৃত্য আসছে না আসরে।
সুভদ্রা আর শ্যামলকুমার পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
দুজনেরই চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি।
দর্শকরা প্রথমটায় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি, কিন্তু প্রায় যখন আট দশ মিনিট ঐ অবস্থায় কেটে যাবার উপক্রম হল তখন তাদের মধ্যেও একটা ফিসফিসানি, চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।
লে বাবা, এরা দুটি সঙের মত দাঁড়িয়ে রইল কেন? কে একজন বললে।
আর একজন টিপ্পনী কাটল, কি বাবা, ভাগব বলে এখনও দাঁড়িয়ে কেন? কেটে পড় বাপু, দুটিতে তো বেশ জোট মানিয়েছে!
ওরাও বোধ হয়—সুভদ্রা আর শ্যামলকুমার কেমন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। বৃদ্ধের ভৃত্যের আবির্ভাবের পর যে সংলাপ তাও বলতে পারছে না, এদিকে ভৃত্যেরও দেখা নেই।
অবশেষে বুদ্ধি খাটিয়ে শ্যামলকুমার বললে, চল সুভদ্রা, আর দেরি করা উচিত নয়।
হ্যাঁ, চল।
ওদের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে সারা প্যান্ডেল যেন এক অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল।
কিরীটী নাটকের শেষটুকু জানত। হরিদাসের মুখেই শুনেছিল।
কিরীটীও ঠিক বুঝতে পারে না, ব্যাপারটা ঠিক কি ঘটল!
ভৃত্যের আসরে আবির্ভাব হল না কেন?
হঠাৎ কি একটা কথা মনে হওয়ায় তাড়াতাড়ি কিরীটী উঠে পড়ল এবং দ্রুতপদে সাজঘরের দিকে পা বাড়াল।
দর্শকরাও ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না।
তারা তখন হাসি থামিয়ে রীতিমত চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, এটা কি হল? এ কেমন পালা রে বাবা?
০৫. হরিদাস সামন্তর সাজঘরে
হরিদাস সামন্তর সাজঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল কিরীটী।
সেখানে তখন যাত্রাদলের আট-দশজন জমায়েত হয়েছে, পাল মশাইও উপস্থিত। শ্যামলকুমার ও সুভদ্রাও পৌঁছে গিয়েছে সে ঘরে।
একটা চাপা গুঞ্জন ঘরের মধ্যে যেন বোবা একটা আতঙ্কের মত থমথম করছে। ভিড় ঠেলে সামনের দিকে দুপা এগুতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল কিরীটীর।
সামন্ত মশাই চেয়ারের উপর বসে আছেন। পরনে তাঁর অভিনয়েরই সাজপোশাক। মাথাটা বুকের উপর ঝুলে পড়েছে ঘাড়টা ভেঙে যেন।
দুটো হাত অসহায় ভাবে চেয়ারের দুপাশে ঝুলছে। পায়ের সামনে একটা কাচের গ্লাস।
কি ব্যাপার? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
বুঝতে পারছি না রায় মশাই, অধিকারী রাধারমণ পাল বললেন, ঘরে ঢুকে দেখি ঐ দৃশ্য। ডেকেও সাড়া না পেয়ে আপনার বন্ধুর—
কিরীটী এগিয়ে গেল। ঝুলে-পড়া হরিদাস সামন্তর মুখটা তোলবার চেষ্টা করল। কিন্তু সেটা আবার ঝুলে পড়ল বুকের উপরে।
মুখটা নীলচে। ঠোঁট দুটিও নীলচে। কশের কাছে সামান্য রক্তাক্ত ফেনা।
হাতটা তুলে নাড়ি পরীক্ষা করল কিরীটী। তারপর রাধারমণ পালের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে
বললে, উনি বেঁচে নেই।
বেঁচে নেই? সে কি?
একটা চাপা আর্তনাদের মতই যেন রাধারমণ পালের কণ্ঠ হতে কথাগুলো উচ্চারিত হল।
হ্যাঁ, মারা গেছেন। কিরীটী আবার কথাটা উচ্চারণ করল।
মারা গেছেন?
কিরীটী ঐ সময় মাটি থেকে গ্লাসটা তুলে একবার নাকের কাছে নিয়ে শুকল।
তারপর সেটা পাশের একটা টুলের উপরে নামিয়ে রেখে বললে, মনে হচ্ছে কোন তীব্র বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে।
বিষ!
কথাটা কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে যেন উচ্চারিত হল শ্যামলকুমারের মুখ থেকে।
কিরীটী শ্যামলকুমারের মুখের দিকে তাকাল। শ্যামলকুমারের সমস্ত মুখে যেন একটা বিব্রত ভয়ের কালো ছায়া।
আমার তাই মনে হচ্ছে, কিরীটী বললে, পুলিসে এখুনি একটা খবর দেওয়া দরকার।
পুলিস! পুলিস কি করবে? রাধারমণ একটা ঢোক গিলে কথাটা বললেন।
স্বাভাবিক মৃত্যু নয় যখন তখন পুলিসে একটা সংবাদ দিতে হবে বৈকি।
ঘরের মধ্যে যাত্রাদলের সবাই তখন ভিড় করেছে, সবার কানেই বোধ করি সংবাদটা পৌঁছে গিয়েছিল।
জনা ষোল-সতেরো মেয়ে-পুরুষ যাত্রার দলে।
ইতিমধ্যে বোধ করি বাড়ির কর্তা রমণীমোহন কুণ্ডুর কানেও সংবাদটা পৌঁছে গিয়েছিল। ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন।
কি হয়েছে পাল মশাই? ব্যাপার কি?
রমণীমোহনের বয়স খুব বেশী নয়—পঞ্চাশ-একান্নর মধ্যেই। বেশ স্বাস্থবান দেহ। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখলে বোঝা যায় ভদ্রলোক রীতিমত শৌখিন। পরনে কাঁচির কোঁচানো ধুতি, চওড়া কালোপাড়, সাদা গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবি, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি।
আপনি? কিরীটী প্রশ্ন করে রমণীমোহনের দিকে তাকিয়ে।
আমি এ বাড়ির মালিক–রমণীমোহন কুণ্ডু।
ওঃ, ইনি সামন্ত মশায়ের বন্ধু। রাধারমণ বললেন।
শুনলাম সামন্ত মশাইয়ের নাকি কি হয়েছে?
রাধারমণ পাল চুপ করে ছিলেন। কিরীটীই প্রশ্নটার জবাব দিল, মারা গেছেন। মনে হচ্ছে কোন তীব্র বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটেছে।
সর্বনাশ! পয়জনিং?
হ্যাঁ।
এখন উপায়?
থানায় একটা সংবাদ পাঠাতে হবে।
হ্যাঁ, এখুনি পাঠাচ্ছি। হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন রমণীমোহন কুণ্ডু।
কিরীটী আবার পাল মশাইয়ের দিকে তাকাল। ভদ্রলোকের মুখটা যেন এর মধ্যেই কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। মধ্যে মধ্যে পুরু ঠোঁটটা জিভ দিয়ে চেটে ভিজিয়ে নিচ্ছেন।
পাল মশাই!
আজ্ঞে?
আপনাদের দলের সর্বশেষ আজ রাত্রে কার সঙ্গে সামন্ত মশাইয়ের দেখা হয়েছিল, সেকথা জানতে পারলে হত!
পাল মশাই একটা ঢোঁক গিলে বললেন, আমার সঙ্গে—মানে পালা শুরু হবার পর থেকে আমি এখানে আসিইনি।
তাহলে আপনার সঙ্গে পালা শুরু হবার পর আর সামন্ত মশাইয়ের দেখা হয়নি?
না।
হুঁ। আপনারা? কিরীটী পর্যায়ক্রমে সকলের দিকে তাকাল।
তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পর্যায়ক্রমে একে একে সকলের মুখের উপরই ঘুরে এলো।
চিত্রার্পিতের মত যেন সব দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কথা নেই।
কেউ আপনাদের মধ্যে আজ পালা শুরু হবার পর এখানে আসেননি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
রোগা মত এক ব্যক্তি এগিয়ে এল। বয়স বত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে বলে মনে হয়।
কিরীটী পুনরায় তাকে প্রশ্ন করে, আপনি এসেছিলেন?
না। তবে তৃতীয় অঙ্ক শুরু হবার পর একবার আমি এখানে শ্যামলকুমারকে আসতে দেখেছি। আর তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি-সামন্ত মশাই তখন আসরে, সুভদ্রা দেবীকে এই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছিলাম।
কিরীটী বক্তার মুখের দিকে তাকাল।
রোগা পাকানো চেহারা। চোখের কোল বসা। ভাঙা গাল। নাকটা খাঁড়ার মত উঁচু। মাথায় একমাথা ঢেউ-খেলানো বাবরি চুল। মুখে প্রসাধনের চিহ্ন। পরনে তখনও অভিনয়ের পোশাক।
কিরীটীর মনে পড়ল, লোকটি ভাল অভিনেতা। বর্তমান নাটকে ভিলেনের পার্ট করছিল। পালায় নায়িকার অন্যতম প্রেমিক। হতাশায় সে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিল।
কি নাম আপনার?
আজ্ঞে সুজিতকুমার মিত্র।
এই দলে আপনি কতদিন আছেন?
কতদিন—মানে, ধরুন গে বছর ছয়েক তো হবেই। আগে তো আমিই এ দলে হিরোর রোল করতাম। রোগে রোগে চেহারাটা ভেঙে যাওয়ায় পাল মশাই আর আমাকে হিরোর পার্ট দেন না, ভিলেনের পার্ট করি।
হুঁ। তা আপনি দেখেছেন শ্যামলকুমার আর সুভদ্রা দেবীকে এই ঘরে আসতে?
আজ্ঞে বললাম তো এইমাত্র, শ্যামলকুমারকে আমি ঢুকতে দেখেছি, কিন্তু বের হয়ে যেতে দেখিনি। আর, সুভদ্রা দেবীকে বেরোতে দেখেছি কিন্তু ঢুকতে দেখিনি।
শ্যামলকুমার ভিড়ের মধ্যে এক পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিরীটী শ্যামলকুমারের মুখের দিকে তাকাল।
শ্যামলবাবু, তৃতীয় অঙ্কের গোড়ায়—কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনি এসেছিলেন এ ঘরে?
হ্যাঁ। সামন্ত মশাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন—একটা চিরকুট দিয়ে।
চিরকুট!
হ্যাঁ।
বলতে বলতে পকেটে হাত চালিয়ে ছোট একটুকরো কাগজ বের করল শ্যামলকুমার।
দেখি—কিরীটী চিরকুটটা হাতে নিল।
ছোট একটুকরো প্রোগ্রাম-ছেঁড়া কাগজ—তাতে পেনসিলে লেখা,শ্যামল, একবার আমার ঘরে এস।
নীচে কোন নামসই নেই।
এতে তো দেখছি কারুর নামসই নেই। তা এটা যে সামন্তরই পাঠানো, বুঝলেন কি করে?
আজ্ঞে দলের চাকর ভোলা আমাকে চিরকুটটা দেয়।
ভোলা? কোথায় সে?
ভোলা ভিড়ের মধ্যে সবার আড়ালে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, এগিয়ে এল।
কালো বেঁটে নাদুস-নুদুস চেহারা। পরনে একটা ধুতি ও গায়ে গেঞ্জি। বয়স বছর ত্রিশেক হবে। চোখের দৃষ্টিতে বেশ যেন একটা সতর্কতা।
তোমার নাম ভোলা? কিরীটী শুধাল।
আজ্ঞে।
বাবুকে তুমি ঐ চিরকুটটা দিয়েছিলে?
আজ্ঞে।
সামন্ত মশাই তোমাকে দিতে দিয়েছিলেন?
আজ্ঞে নিজের হাতে দেননি—
তবে! চিরকুটটা তুমি কোথায় পেলে?
রাধারাণী দিদিমণি চিরকুটটা আমায় দিয়েছিলেন।
তিনি কে?
এবার একটি বছর ত্রিশ বয়সের রমণী এগিয়ে এল।
আমার নাম রাধারাণী।
আপনি দিয়েছিলেন ওকে চিরকুটটা? কিরীটী প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ।
আপনাকে সামন্ত মশাই দিয়েছিলেন?
না। দ্বিতীয় অঙ্কের শেষের দিকে আমি যখন আসর থেকে সাজঘরের দিকে যাচ্ছি, কে যেন আমাকে চিরকুটটা দিয়ে বললে, এটা ভোলাকে দিয়ে বলবেন শ্যামলবাবুকে দিয়ে যেন বলে সামন্ত মশাই তাঁকে এ ঘরে ডেকেছেন।
কে সে?
প্যাসেজে ভাল আলো ছিল না আর আমারও তাড়াতাড়ি ছিল, ভাল করে চেয়ে দেখিনি, নজরও দিইনি।
তার গলাও চেনেননি?
না। ঠিক তাড়াতাড়িতে—
হুঁ, তারপর?
ভোলা আমাদের সাজঘরের বাইরেই ছিল—তাকে চিরকুটটা দিয়ে বলি শ্যামলবাবুকে দিয়ে আসতে, সামন্ত মশাই দিয়েছেন। শ্যামলবাবুর সাজঘরটা আমাদের পাশের ঘরেই।
ঐ সময় হঠাৎ দণ্ডায়মান অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের মধ্য থেকে মধ্যবয়সী কালো গাঁট্টাগোট্টা এক ভদ্রলোক, যিনি সুভদ্রা হরণ পালায় সুভদ্রার মামার পার্ট করেছিলেন—তিনি এগিয়ে এসে বেশ যেন একটু রুক্ষ কর্কশ গলাতেই বললেন, কিন্তু মশাই, আপনার পরিচয় জানতে পারি কি? আপনি কে? পুলিসের মত আমাদের এই জেরা করছেন কেন? আপনি কে? আপনি তো বাইরের লোক। পুলিসকে আসতে দিন, তাদের কাজ তারাই করবে।
রাধারমণ পাল তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, দোলগোবিন্দবাবু, উনি সামন্ত মশাইয়ের বন্ধু।
বন্ধু তো হয়েছে কি?
ঠিক সেই সময় স্থানীয় থানার অফিসার-ইন-চার্জ মণীশ চক্রবর্তী হন্তদন্ত হয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর পিছনে পিছনে রমণীমোহন কুণ্ডু।
মণীশ চক্রবর্তীর বয়স চল্লিশের কিছু ঊর্ধ্বে বলেই মনে হয়। রীতিমত পালোয়ানের মত চেহারা। পাকানো একজোড়া গোঁফ। থুতনিতে নূর দাড়ি। পরনে পুসির ইউনিফর্ম।
কোথায় কোথায় ডেড় বডি?
ঐ যে—বললে কিরীটী।
মণীশ চক্রবর্তী এগিয়ে গিয়ে ডেড় বডির সামনে দাঁড়ালেন। নানা ভঙ্গিতে দেখলেন দূর থেকে, সামনে থেকে, কখনও ঝুঁকে পড়ে, কখনও সামান্য একটু হেলে দাঁড়িয়ে।
কখন মারা গিয়েছে? I mean কখন ব্যাপারটা আপনারা জানতে পেরেছেন?
কথাগুলো বলে পর্যায়ক্রমে মণীশ চক্রবর্তী ঘরের মধ্যে উপস্থিত দণ্ডায়মান সকলের দিকেই তাকালেন।
সবাই চুপ, কারও মুখে কোন কথা নেই।
কি হল? সবাই আপনারা ডে অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলের ছাত্র হয়ে গেলেন নাকি? শুনতে পাচ্ছেন না কথাটা আমার, না জবাব দিতে পারছেন না?
তবু কারও মুখে কোন শব্দ নেই। পূর্ববৎ সবাই যেন বোবা—সবাই পুতুলের মত দাঁড়িয়ে।
ঐভাবে ধমক দিয়ে কি ওদের কারও মুখে কোন কথা বের করতে পারবেন অফিসার? এক এক করে আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞাসা করুন। কিরীটী মৃদু গলায় বললে, দেখছেন তো ঘটনার আকস্মিকতায় ওঁরা সব ঘাবড়ে গিয়েছেন।
কিরীটীর দিকে তাকালেন মণীশ চক্রবর্তী। বার কয়েক যেন তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে কিরীটীকে জরীপ করলেন। তারপর বললেন, আপনি?
রাধারমণ পাল বললেন, সামন্ত মশাইয়ের উনি বন্ধু।
বন্ধু?
আজ্ঞে।
তা উনিও কি যাত্রাদলের! কিরীটীর বেশভূষা লক্ষ্য করেই মণীশ চক্রবর্তী কথাটা বললেন।
না–উনি এসেছিলেন ওঁর বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তারপর পালা শুনছিলেন।
অফিসার, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। ঐ সময় কিরীটী বললে।
কি কথা?
আগে সকলকে ঘর থেকে একটু বেরুতে বলুন, তারপর বলছি।
মণীশ চক্রবর্তী জ কুঁচকে যেন কি ভাবলেন মুহূর্তকাল, তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা একটু বাইরে যান।
সকলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
ঘর থেকে বের হয়ে গেল সবাই। ঘর খালি হয়ে গেল।
কি বলছিলেন বলুন?
কিছু বলবার আগে বলতে চাই, আজকের ব্যাপারটার একটা উপক্রমণিকা আছে মিঃ চক্রবর্তী।
উপক্রমণিকা! সে আবার কি?
কিরীটী তখন তাঁর কাছে হরিদাস সামন্তর যাওয়া থেকে আজকের সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলে গেল, তারপর বললে, মানুষগুলোকে স্বচক্ষে দেখবার জন্য ও বোঝবার জন্যই আমি আজ এখানে এসেছিলাম। একবারও ভাবতে পারিনি সত্যিই এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটবে।
কিন্তু এখনও আপনার আসল পরিচয়টা তো পেলাম না?
কিরীটী মৃদু গলায় নিজের নামটা উচ্চারণ করল।
মণীশ চক্রবর্তী যেন আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীকে জরীপ করলেন।
তারপর বললেন, ও, আপনিই সেই বেসরকারী গোয়েন্দা কিরীটী রায়! হ্যাঁ, নামটা আপনার শুনেছি দু-একবার।
আজ্ঞে তবে গোয়েন্দা ঠিক নয়—
তবে? রহস্যের সন্ধান করে আমি বিশেষ আনন্দ পাই। বলতে পারেন ওটা আমার একটা নেশা।
নেশাটা দেখছি বড় জব্বর নেশা! তা আপনি এ ব্যাপারে কি মনে করেন?
মণীশ চক্রবর্তীর কথা বলার ভঙ্গি ও কথাগুলোর মধ্যে স্পষ্টই যেন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ পায়।
কিরীটী সেটা বুঝতে পেরেই মৃদু হেসে বলে, আমি আর কি বলব মিঃ চক্রবর্তী? আপনিই যখন এসে পড়েছেন—আপনার কি আর কিছু জানতে বা বুঝতে বাকি থাকবে?
কিরীটীর তোষামোদে মণীশ চক্রবর্তী একটু যেন প্রসন্ন হলেন।
নেহাত লোকটা অবাচীন নয় বোধ হয়, মনে হয় তাঁর।
তবু আপনি তো প্রথম থেকেই এখানে উপস্থিত ছিলেন, তা সত্যিই কি আপনার ব্যাপারটা একটা মার্ডার বলেই মনে হয়? সত্যিই লোকটাকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন কিরীটীবাবু?
এত তাড়াতাড়ি কি কিছু বলা যায়? আপনিই বলুন না মিঃ চক্রবর্তী, আপনার তো এই লাইনে প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে!
তা ঠিক, তবে জবানবন্দি না নিয়ে কিছু বলতে পারছি না; তবে এটা ঠিক—ওঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করাই হয়েছে। আর ঐ শ্যামলকুমার আর
তারপরই একটু থেমে বললেন, কি নাম যেন মেয়েটির বললেন?
সুভদ্রা।
হ্যাঁ, সুভদ্রা—ওরা দুজনেই এর মধ্যে আছে। বুঝলেন মিঃ রায়, আপনার সব কথা শোনবার পর মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্ত্রীলোক-ঘটিত ঈষা। আর সেই ঈর্ষা থেকেই হত্যা।
অসম্ভব নয় কিছু।
০৬. সকলের জবানবন্দি নেওয়া
তাহলে এবার ওদের সকলের জবানবন্দি নেওয়া যাক, কি বলেন মিঃ রায়? কথাটা বলে মণীশ চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে তাকালেন।
নিন না। তবে আপনি যদি অনুমতি দেন তো—
কি, বলুন?
এই ঘরে আমি—
থাকবেন জবানবন্দি নেওয়ার সময়?
হ্যাঁ।
থাকুন, থাকুন। আপত্তির কি আছে এতে?
ধন্যবাদ। আপনাদের কাছে কত কিছুর শিখবার আছে। কেমন করে আপনারা জবানবন্দি। নেন, তার process–
শিখতে চান? বেশ, বেশ। কিউরিয়সিটি থাকা ভাল–ওতে জ্ঞানবৃদ্ধি পায়।
কিরীটীর বোধ হয় নোকটার পাকামি সহ্য হচ্ছিল না, তাই বললে, হ্যাঁ, আপনাদের বর্তমান আই.জি. মিঃ মল্লিক তাই বলেন।
মিঃ মল্লিক! তাঁকে আপনি চেনেন নাকি? সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা প্রকাশ পায় মণীশ চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বরে।
সুকান্ত মল্লিক আমার বিশেষ বন্ধু।
আ–আপনার বন্ধু আমাদের বড়সাহেব, তা এ কথাটা এতক্ষণ বলেননি কেন?
আপনার কাছে কি সেকথা বলতে পারি?
পারবেন না কেন? হাজারবার পারেন। তা আপনি দাঁড়িয়ে কেন-বসুন। মণীশ চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বর ও চেহারা যেন সম্পূর্ণ পাল্টে যায় মুহূর্তেই, ভদ্রলোক যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।
কুণ্ডু মশাই, ও কুণ্ডু মশাই? চেঁচিয়ে ওঠেন মণীশ চক্রবর্তী।
গৃহকর্তা রমণীমোহন কুণ্ডু হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন, কিছু বলছিলেন স্যার?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওঁর বসবার জন্য একটা চেয়ার এনে দিন।
এখুনি এনে দিচ্ছি স্যার।
হ্যাঁ, তারপর পাল মশাইকে এ ঘরে পাঠিয়ে দিন।
রমণীমোহন কুণ্ডু যেমন হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলেন, তেমনি আবার হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।
মিঃ চক্রবর্তী?
বলুন।
আমি যদি আপনার জবানবন্দি নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দু-একটা প্রশ্ন করি?
একশোবার করবেন। হাজারবার করবেন।
কিরীটী মনে মনে হাসল, চাকরির কি মহিমা! আই.জি. সুকান্ত মল্লিকের সঙ্গে আলাপ আছে শুনেই মণীশ চক্রবর্তী একেবারে যেন বিনয়াবনত, বশংবদ।
.
আরও মিনিট দশেক পরে।
প্রথম জবানবন্দি নেওয়া হচ্ছিল দলের অধিকারী রাধারমণ পালের। মণীশ চক্রবর্তী প্রশ্নাদি করবার পর কিরীটী মুখ খুলল।
পাল মশাই, শুনেছি হরিদাস সামন্ত একদিন আপনার পার্টনার ছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ।
তা পার্টনারশিপ ছেড়ে দিলেন কেন?
আপনি তো তার বন্ধুজন ছিলেন, জানেন না তার চরিত্রের কথা?
দীর্ঘদিন দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না—
ওর দুটি বিশেষ ব্যাধি ছিল।
ব্যাধি?
হ্যাঁ। একটি মদ্যপান, আর—
আর?
স্ত্রীলোক সম্পর্কে ওর একটা বিশ্রী দুর্বলতা, তাই তো–
কি?
একের নম্বরের যাকে বলে লম্পট। ঐ দুটি রোগই ওর সর্বনাশ করেছিল। নচেৎ অভিনয়-প্রতিভা যেমন ছিল লোকটার তেমনি অন্য দিক দিয়ে সৎও ছিল। কিন্তু ঐ যে মদ্যপান ও স্ত্রীলোক-ব্যাধি, সর্বগুণ হরে নিয়েছিল। নইলে মনে করুন কিনা, সুভদ্রা মেয়েটা তো ওর মেয়ের বয়সী, না কি–
বাধা দিল কিরীটী, থাক ওকথা। আচ্ছা সবার আগে আপনিই তাহলে সামন্ত মশাইকে মৃত আবিষ্কার করেন?
আজ্ঞে।
এ ঘরে কি করতে এসেছিলেন, উনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন।?
না।
তবে?
কিছু টাকা চেয়েছিলেন, সেই টাকা দিতে এসেই তো—
আপনি ঘরে ঢুকে দেখলেন, ঐভাবে বসে আছেন?
হ্যাঁ, প্রথমটা তো বুঝতেই পারিনি, তারপর—
পাল মশাই?
আজ্ঞে?
নাটকের শেষ দৃশ্যে ছিল ভৃত্য গিয়ে আসরে খবর দেবে কর্তবাবুর মৃত্যু হয়েছে, তাই না?
হ্যাঁ।
ভৃত্য কে সেজেছিল?
ভৃত্য যে সাজত সে অনুপস্থিত আজ। তাই দোলগোবিন্দবাবুকে বলেছিলাম। দ্বিতীয় অঙ্কের পর তার তো পার্ট ছিল না, তাই বলেছিলাম সে-ই যেন ভৃত্যের মেকআপ নিয়ে আসরে গিয়ে কথাগুলো বলে আসে।
পাল মশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, কিন্তু তিনি তো যাননি।
যাননি! সে কি! দোলগোবিন্দবাবু যাননি?
না। ফলে যা হবার তাই হয়েছিল। নাটকটি শেষ হতে পারেনি। কিরীটী অতঃপর দৃশ্যের শেষ ব্যাপারটা খুলে বললে।
দাঁড়ান তো, দোলগোবিন্দবাবুকে ডাকি।
ব্যস্ত হবেন না পাল মশাই, পরেও কথাটা জিজ্ঞাসা করলে চলবে।
কেন গেল না—
এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন তো?
কি প্রশ্ন?
মণীশ চক্রবর্তী খিঁচিয়ে ওঠেন, যা জানতে চান উনি তার জবাব দিন।
আজ্ঞে?
পাল মশাই? কিরীটী ডাকল, এই ব্যাপারে আপনার দলের কাউকে কি সন্দেহ হয়?
সন্দেহ? সন্দেহ কাকে করব? না না, আমার দলের মধ্যে কেউ এমন কাজ করতে পারেই না। তাছাড়া সামন্ত মশাইকে দলের সকলেই শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত, ভক্তি করত।
মণীশ চক্রবর্তী ঐ সময় প্রশ্ন করলেন, শ্যামলকুমার? শ্যা
মলকুমার!
হ্যাঁ, তার সঙ্গে তো শুনলাম সুভদ্রা বলে আপনার দলের মেয়েটিকে নিয়ে সামন্তর সঙ্গে রীতিমত একটা রেষারেষি চলছিল ইদানীং।
না না, রেষারেষি আবার কি! সামন্ত মশাইয়ের অবিশ্যি মনে তাই হয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, সুভদ্রা সেরকম মেয়ে নয়, ওটা সামন্ত মশাইয়ের মনের ভুল। তাছাড়া শ্যামল ছেলেটি যেমন ভদ্র তেমনি ধীরস্থির, এসব খুনখারাপির মধ্যে সে থাকতেই পারে না।
ঠিক আছে। মণীশ চক্রবর্তী বললেন।
কিন্তু পাল মশাই, আমাদের ধারণা, কিরীটী বললে, আপনাদের দলেরই কেউ সামন্ত মশাইকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে।
এ আপনি কি বলছেন? না না, হয়তো—
কি?
সামন্ত মশাই আত্মহত্যা করেছেন।
আত্মহত্যা!
কেন, পারেন না?
তা পারেন–তবে বোধ হয় তা করেননি। ঠিক আছে, আপনি দয়া করে শ্যামলকুমারকে এখন একবার পাঠিয়ে দিন।
রাধারমণ পাল ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। একটু পরে শ্যামলকুমার এসে ঘরে ঢুকল।
মণীশ চক্রবর্তীই প্রথমে তাকে নানাবিধ প্রশ্ন শুরু করলেন, একটার পর একটা। অবশেষে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে একসময় বললেন, ওঁকে জিজ্ঞাসা করবেন নাকি কিছু? জিজ্ঞাসা করবার আর কিছু আছে?
কিরীটী তাকাল শ্যামলকুমারের দিকে।
শ্যামলকুমার যেন কেমন একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে।
হাতের আঙুলগুলো নিয়ে কেবলই নাড়াচাড়া করছে।
শ্যামলবাবু!
আজ্ঞে?
সুজিতবাবু বলছিলেন তখন—
কি—কি বলছিলেন সুজিতবাবু?
আজকের তৃতীয় অঙ্কের শুরু হবার পর একবার আপনি এই ঘরে এসেছিলেন।
হ্যাঁ, এসেছিলাম। সামন্তদা ডেকে পাঠিয়েছিলেন, সে কথা তো তখুনি আপনাকে বললাম।
হ্যাঁ বলেছেন, তা কেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন তা বলেননি।
সামন্তদার মনে ইদানীং একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল–
জানি। আপনার ইদানীং সুভদ্রা দেবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার জন্য। তিনি আদপেই ব্যাপারটা সহ্য করতে পারছিলেন না, তাই না?
হ্যাঁ।
আপনি—আপনি কি করে জানলেন? শ্যামলকুমার প্রশ্ন করে।
জানি। তারপর একটু থেমে—এবার বলুন শ্যামলবাবু, সুভদ্রা দেবীর সঙ্গে সত্যিই কি আপনার–
হ্যাঁ, আমি তাকে ভালবাসি।
আর সুভদ্রা দেবী?
সেও আমাকে ভালবাসে।
হুঁ। তা কি কথা হয়েছিল আপনাদের মধ্যে?
ঘরে এসে ঢুকতেই আজ উনি আমাকে বললেন, শেষবারের মত তোমাকে বলছি শ্যামল, আমাদের ভিতর থেকে তুমি সরে দাঁড়াও, নচেৎ এমন শিক্ষা তোমাকে পেতে হবে যে জীবন দিয়ে তোমাকে তা শোধ করতে হবে।
আপনি কি জবাব দিলেন?
আমি বলেছিলাম, এই জন্যই যদি ডেকেছেন জানলে আসতাম না—যা বলবার আপনি সুভদ্রাকে বলবেন। সে যদি আমাকে না চায় তো আমি নিশ্চয়ই সরে দাঁড়াব।
আর কোন কথা হয়নি?
না।
তারপর আর এ ঘরে আপনি আসেননি?
না।
আচ্ছা, এ ব্যাপারে আপনার দলের কাউকে সন্দেহ হয়?
না।
আর কারও সঙ্গে দলের মধ্যে হরিদাসবাবুর কোন মনোমালিন্য বা ঝগড়াঝাঁটি কখনও হয়েছে বলে জানেন?
সুজিতের সঙ্গে তো ওঁর খিটিমিটি লেগেই ছিল।
তাই নাকি? কেন?
তা জানি না, তবে—
তবে?
এককালে শুনেছি ওর অবস্থা নাকি খুব ভাল ছিল, রেস খেলে ও মদ্যপান করে সব খুইয়েছে। সুজিতবাবু! তাছাড়া–
তাছাড়া?
শুনেছি সুভদ্রাকে ও-ই দলে এনেছিল। একসময় সুভদ্রার সঙ্গে ওর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতাও ছিল। সামন্তদা আসার পর থেকেই সামন্তদার সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল সুভদ্রা।
আচ্ছা, সুভদ্রাকে আপনার কি রকম মনে হয়?
খুব ভাল মেয়ে।
আজ পালা শেষ হবার পর রাত্রে সুভদ্রা বলছিল বর্ধমান যাবে। আপনি জানেন সেকথা?
হ্যাঁ, আমাকে ও বলেছিল।
আপনারও সঙ্গে যাবার কথা ছিল কি?
না।
কেন যাবে বলেছিল সুভদ্রা বর্ধমানে, জানেন কি?
তার এক মাসী বর্ধমানে নাকি থাকে, তার অসুখ, তাকেই বলেছিল দেখতে যাবে বর্ধমানে।
আপনাকে সঙ্গে যেতে বলেনি?
বলেছিল, কিন্তু আমি বলেছিলাম যাব না।
ঠিক আছে, আপনি যান, সুজিতবাবুকে একবার পাঠিয়ে দিন।
শ্যামলকুমার চলে গেল।
মণীশ চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে তাকালেন, ছেলেটাকে কি রকম মনে হল কিরীটীবাবু?
আপনার কি মনে হল?
গভীর জলের মাছ। তা বাছাধন জানেন না যে আমারও এ লাইনে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। তাছাড়া ও সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। এ আপনাকে আমি বলে রাখছি, ঐ—ঐ হচ্ছে—
মণীশ চক্রবর্তীর কথা শেষ হল না। সুজিতকুমার এসে ঘরে ঢুকল।
সুজিতকে প্রথমে মণীশ চক্রবর্তী প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।
কিরীটী তখন ঘরের চারিদিকে আবার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ঘরটা ভাল করে দেখা হয়নি। হঠাৎ কিরীটীর নজরে পড়ল, দরজার গোড়ায় একটা সিগারেটের পোড়া টুকরো। কিরীটী গিয়ে নীচু হয়ে সিগারেটের টুকরোটা তুলে নিতে গিয়ে নজরে পড়ল যে চেয়ারের উপরে হরিদাস সামন্তর মৃতদেহটা উপবিষ্ট, তার নীচে কি একটা পড়ে আছে, চকচক করছে।
মণীশ চক্রবর্তী তখন সুজিতকে নিয়ে ব্যস্ত, সেদিকে নজর দেবার মত অবকাশ ও মন কোনটাই ছিল না। সে তাকালও না কিরীটীর দিকে।
কিরীটী নীচু হয়ে চকচকে বস্তুটি তুলে নিয়ে দেখল একটা শৌখিন গালার চুড়ির ভগ্নাংশ, আয়না কাচের চুমকি বসানো। সেই আয়না কাচের উপরেই আলো পড়ে ঝিলিক দিচ্ছিল।
সিগারেটের শেষাংশটাও পরীক্ষা করল।
চারমিনার সিগারেট এবং সেই সিগারেটটা যে খাচ্ছিল সে নিশ্চয়ই পান খেয়েছিল, কারণ শেষাংশে পানের ছোপ শুকিয়ে আছে।
দুটো বস্তুই কিরীটী পকেটে রেখে দিল সযত্নে।
মিঃ রায়—
মণীশ চক্রবর্তীর ডাকে কিরীটী ওর দিকে তাকাল।
ওঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন নাকি?
দু-একটা প্রশ্ন করব। সুজিতবাবু, আপনি বলেছিলেন তৃতীয় অঙ্ক শুরু হবার পর আপনি একবার শ্যামলকুমারকে এ ঘরে আসতে দেখেছিলেন!
হ্যাঁ।
তখন রাত কটা হবে বলে আপনার মনে হয়?
কত আর হবে, রাত সোয়া দশটা কি সাড়ে দশটা।
শ্যামলবাবু এ ঘরে কতক্ষণ ছিলেন জানেন?
তা মিনিট পনের-কুড়ি হতে পারে।
বুঝলেন কি করে? আপনি বুঝি ততক্ষণ দরজার বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন?
তা কেন! আমি—আমি চলে গিয়েছিলাম।
তাহলে জানলেন কি করে শ্যামলবাবু এ ঘরে মিনিট পনের-কুড়িছিলেন?
মানে মিনিট পনের-কুড়ি বাদে এদিকে আসছিলাম, তখন তাকে বেরুতে দেখেছিলাম এই ঘর থেকে।
হুঁ। তাদের পরস্পরের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছিল বলতে পারেন?
তা কেমন করে বলব! আমি তো আর ঘরে যাইনি।
তা ঠিক। তবে অনুমান তো করতে পারেন?
অনুমান!
হ্যাঁ, অনুমান।
না। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে—
কি?
দরজার বাইরে দাঁড়িয়েও তো তাদের দু-একটা কথা আপনার কানে আসতে পারে?
না মশাই, তাছাড়া কোথাও আড়ি পাতা আমার অভ্যাস নেই।
হঠাৎ কিরীটী বলে, আপনি খুব পান খান সুজিতবাবু মনে হচ্ছে?
সুজিত একমুখ পান নিয়ে চিবোচ্ছিল। দোক্তাসিক্ত লালচে এবড়োখেবড়ো দুপাটি দাঁত বার করে সুজিত বললে, হ্যাঁ, সর্বক্ষণ পান-দোক্তা না হলে আমার চলে না।
আর কোন কিছুর প্রতি আসক্তি নেই আপনার সুজিতবাবু?
আসক্তি তো অনেক কিছুর উপরেই ছিল, কিন্তু একে একে সবই ছেড়েছি।
তাই নাকি!
হ্যাঁ, বড় বদ অভ্যাস। আর বদ অভ্যাসের উপর একবার আসক্তি জমলে তা সে যেমনই হোক না কেন ছাড়তে বড় কষ্ট হয়।
তা তো হবারই কথা। তা ড্রিঙ্ক-ট্রিঙ্ক করেন না?
একসময় করতাম, এখন পেলে করি, না পেলে করি না, বুঝলেন না—মানে ঐ আর কি, পরের পয়সায় বলতে বলতে সুজিত পানের রসে রাঙানো লালচে দাঁতগুলো বের করে হাসল।
কিরীটীর যেন সে হাসি দেখে গা ঘিনঘিন করে।
আর সিগারেট?
ধূমপান?
পানের সঙ্গে ওটা ঠিক জমে না, বুঝলেন না!
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তবে মিথ্যে বলব না, খাই। মানে ধূমপানে অভ্যস্ত আমি।
কি ব্র্যান্ড খান?
যা পাই।
আপনার পকেটে সিগারেটের প্যাকেট আছে?
হ্যাঁ। সুজিত পকেটে হাত চালিয়ে একটা দোমড়ানো সিগারেটের প্যাকেট বের করল। অর্ধেক খালি বাক্সটার।
কিরীটী সিগারেটের প্যাকেটটা দেখে ফিরিয়ে দিল।
সুজিতবাবু, আচ্ছা হরিদাস সামন্ত পান খেতেন?
সুজিত লালচে দাঁতগুলো বের করে বললে, হ্যাঁ। তবে পাতা পান নয়, বোতল পান করতেন, মাত্রাধিক্যেই।
আর সিগারেট?
হ্যাঁ, তাও খেতেন।
কি ব্র্যান্ড খেতেন বলতে পারেন?
চারমিনার।
আচ্ছা সুজিতবাবু?
আজ্ঞে!
শ্যামলকুমার লোকটি কেমন!
ছুঁচো।
কি রকম?
ছুঁচো যেমন সর্বদা ছোঁকছোঁক করে, তারও অভ্যাসটি তেমনি।
কি রকম? কিসের জন্য ছোঁকছোঁক করতেন?
বুঝলেন না?
না।
স্ত্রীলোক-বুঝলেন, স্ত্রীলোক!
হুঁ। তা এ দলে কোন মেয়ের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল নাকি?
কেন—হরিদাস সামন্ত মশাইয়ের বন্ধু আপনি, শোনেননি তার কাছে কিছু?
না।
তার স্ত্রীলোকটির উপরেই যে নজর ছিল শ্যামলকুমারের!
তাই নাকি? একটু থেমে কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা সুজিতবাবু, হরিদাস সামন্তর সঙ্গে শ্যামলকুমারের কি রকম সদ্ভাব ছিল বলুন তো?
সাপে-নেউলের সম্পর্ক যেমন তেমনি ধরনের সদ্ভাব ছিল বলতে পারেন।
কেন বলুন তো?
ঐ যে একটু আগেই বললাম-বুঝলেন না!
মানে?
মানে সামন্ত মশাইয়ের মেয়েমানুষ ছিল সুভদ্রা, শ্যামলকুমার এসে সেই মেয়েমানুষটিকে হাতিয়ে নিয়েছিল। তার ফলে যা হবার তাই হয়েছিল।
হুঁ। আচ্ছা আর একটা কথা—
কি, বলুন?
আগে তো, মানে শ্যামলকুমার আসার আগে এ দলে বোধ হয় হিরোর পার্ট আপনিই করতেন, তাই না?
করতাম, আর এখনও করতে পারি। শুধু তো মাকাল ফলের মত চেহারাই হলে হয় না মশাই, অভিনয়-বস্তুটি হচ্ছে একটা আর্ট, বুঝলেন, গড়গড় করে তোতাপাখীর মত খানিকটা শেখানো বুলি আওড়ে গেলেই সেটা অভিনয়—acting হয় না। শ্যামল অভিনয়ের কি বোকে? কিন্তু পাল মশাইয়ের কি সে খেয়াল আছে?
আপনার অভিনয় কিন্তু আজ আমার সত্যি চমৎকার লেগেছে।
লেগেছে তো? লাগতেই হবে। আপনাদের মত অভিনয়রসিক বলেই বুঝেছেন?
আচ্ছা, হরিদাস সামন্ত কেমন অভিনয় করতেন?
এককালে ভাল অভিনয়ই করত। কিন্তু ঐ যে মহা দুটি ব্যাধি—মদ আর স্ত্রীলোক, এতেই ওর সর্বনাশ হল।
আপনি বলতে চান তাহলে মেয়েমানুষের জন্যই ওর প্রাণটা গেল?
নির্ঘাত।
মেয়েমানুষটি তাহলে আপনার মনে হয়—
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের সুভদ্রা দেবী। সাক্ষাৎ কালনাগিনী, বুঝলেন—বিষকন্যা!
০৭. বিষকন্যা কেন বলছেন
বিষকন্যা কেন বলছেন?
যে কন্যার সংস্পর্শই বিষ, সে-ই তো প্রাণঘাতিনী বিষকন্যা।
তা বটে। তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, সুজিতবাবু, এবারে সত্যি করে বলুন তো, আজ অভিনয় শুরু হবার পর একবারও কি এ ঘরে আপনি আসেননি?
না।
ঠিক বলছেন?
নিশ্চয়ই।
মনে করে আবার ভাল করে ভেবে বলুন?
ভাবাভাবির বা মনে করবার কি আছে? আসিনি।
কিন্তু আমি যদি বলি—
কি?
আজ অভিনয় শুরুর পরে এ ঘরে আপনি এসেছিলেন!
না।
সুজিতবাবু, আমার হাতে প্রমাণ আছে যে আপনি এ ঘরে এসেছিলেন।
প্রমাণ? এ কি বলছেন মশাই?
কিরীটীর মনে হল গলাটা যেন কেমন বসে গেছে হঠাৎ সুজিতকুমারের।
গলার স্বরটা যেন ঠিক স্পষ্ট নয়।
কিরীটী বুঝতে পারে তার নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যভেদ করেছে।
অস্বীকার করে কোন লাভ নেই। বলুন, কেন এসেছিলেন?
আমি আসিনি।
আপনার জামার পকেটে ওটা কি উঁচু হয়ে আছে? দেখি বের করুন তো?
ওটা একটা হাফ পাই বোতল।
বোতলটা বের করুন।
সুজিত পকেট থেকে একটা কালো চ্যাপ্টা মত হাফ পাই বিলিতি মদের বোতল বের করল।
কি আছে ওতে?
হুইসকি।
দেশী না বিলিতি?
দেশী।
বোতলটা তো দেখছি অর্ধেকের বেশী খালি। এটা কি পরস্মৈপদী নাকি?
মানে?
কেউ কি দিয়েছে?
হ্যাঁ।
কে দিল?
পাল মশাই। তারপরই একটু থেমে বলল, অভিনয়ের রাত্রে বিশেষ করে অভিনয়ের সময় মধ্যে মধ্যে না পান করলে আমি অভিনয় করতে পারি না। তাই পাল মশাই অভিনয়ের রাত্রে একটা পাইন্ট বোতল আমাকে দিয়ে থাকেন।
কিরীটী ক্ষণকাল অতঃপর সুজিতকুমারের দিকে চেয়ে রইল।
আমি এবারে যেতে পারি?
হ্যাঁ। কিন্তু বোতলটা আমার চাই, দিন।
বোতলটা।
হ্যাঁ, দিন।
নিন।
সুজিত বোতলটা কিরীটীর হাতে তুলে দিল। কিরীটী বোতলটা চোখের সামনে তুলে ধরে দেখল, তারপর সেটা সামনের টেবিলের উপরে রেখে দিল।
আচ্ছা, এবারে আপনি যেতে পারেন।
সুজিতকুমার ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মণীশ চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন, ও কি সত্যিই আজ রাত্রে একবার এ ঘরে এসেছিল বলে আপনার মনে হয় মিঃ রায়?
মনে হয় নয়, এসেছিল। কিন্তু একটা ব্যাপার কেমন যেন খটকা লাগছে।
কি বলুন তো?
কিছু না। সুভদ্রা দেবীকে এবারে ডাকান তো!
এখুনি ডাকছি।
মণীশ চক্রবর্তী ঘরের দরজার বাইরে গিয়ে সুভদ্রাকে ঐ ঘরে পাঠিয়ে দেবার জন্য বললেন।
একটু পরে সুভদ্রা এল। কেঁদে কেঁদে তার দুচোখের পাতা ফুলে উঠেছে। চোখের পাতায় তখনও জল বোঝা যায়। সুভদ্রা ইতিমধ্যেই তার অভিনয়ের সাজপোশাক ছেড়ে ফেলেছে। পরনে সাধারণ একটি লাল রংয়ের চওড়াপাড় তাঁতের শাড়ি। কিরীটী লক্ষ্য করল মুখের প্রসাধনও তুলে ফেলেছে সুভদ্রা ইতিমধ্যেই।
মণীশ চক্রবর্তী প্রথমে তার প্রচলিত ভঙ্গীতে প্রশ্ন শুরু করলেন, আপনিই সুভদ্রা দেবী?
জলে ভরা চোখ দুটি তুলে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে সুভদ্রা সম্মতি জানাল।
অনেক দিন এ দলে আছেন?
হ্যাঁ।
সুজিতবাবু বলছিলেন আপনাকে তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি সময়ে একবার নাকি এ ঘরে আসতে দেখেছিলেন।
সুজিতবাবু ঠিকই দেখেছিলেন। এসেছিলাম।
কেন?
সামন্ত মশাই আমাকে ডেকেছিলেন।
কিরীটী নিঃশব্দে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুভদ্রার সারা দেহ।
মণীশ চক্রবর্তী আবার প্রশ্ন করেন, কেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
বলেছিলাম বর্ধমানে যাব, তাই বারণ করলেন যেন না যাই।
বর্ধমানে কেন যেতে চেয়েছিলেন?
মাসীর খুব অসুখ।
তারপর কতক্ষণ ছিলেন?
মিনিট দশেক।
ঐ সময় কিরীটীর দিকে তাকিয়ে মণীশ চক্রবর্তী বললেন, কিছু জিজ্ঞাসা করবেন ওঁকে?
কিরীটী সুভদ্রার দিকে তাকিয়ে বললে, সুভদ্রা দেবী, শুনলাম সুজিতবাবুই আপনাকে একদিন এই যাত্রাদলে এনেছিলেন?
হ্যাঁ।
সুজিতবাবুর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
আমি এই যাত্রার দলে আসার আগে মধ্যে মধ্যে অ্যামেচার ক্লাবে প্লে করতাম। সুজিতবাবু একবার আমার প্লে দেখে আলাপ করেন। তারপর আমি যাত্রার দলে যোগ দিতে চাই কিনা জিজ্ঞাসা করলে আমি বলি, হ্যাঁ। তখন উনি নিয়ে আসেন আমাকে। সেই থেকেই আমাদের পরিচয়।
তার আগে পরিচয় ছিল না? ওঁকে জানতেনও না?
না।
আপনার মা বাবা ভাই বোন নেই?
না।
ছোটবেলায় মা-বাবা মারা যায়, তারপর মাসীর কাছেই আমি মানুষ।
বর্ধমান থেকে কলকাতায় যাতায়াত করতেন?
তা কেন!
তবে?
আমি পনের বছর বয়সেই কলকাতায় চলে আসি আমার স্বামীর সঙ্গে।
আপনার বিয়ে হয়েছিল?
হয়েছিল।
স্বামী এখন কোথায়?
কোথায় চলে গিয়েছে কেউ জানে না।
কতদিন আগে?
বছর দশেক আগে, বুঝতেই পারছেন। তারপর লেখাপড়া শিখিনি, বাঁচতে তো হবে, কাজেই এখানে-ওখানে অভিনয় শুরু করলাম।
ইদানীং হরিদাস সামন্তর সঙ্গেই বোধ হয় ঘর করছিলেন?
সুভদ্রা মাথা নীচু করল।
সুভদ্রা দেবী!
বলুন?
আপনি যখন তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি সময় এ ঘরে আসেন, সামন্ত মশাই তখন কি করছিলেন মনে আছে আপনার?
চুপচাপ বসেছিলেন।
তিনি মদ্যপান করছিলেন, না?
ঠিক মনে নেই। বোধ হয় করছিলেন।
তাহলে ঘরে বোতল একটা নিশ্চয়ই থাকত, বোধ হয় তিনি মদ্যপান করছিলেন না! মনে করে বলুন তো?
কি বললেন?
বলছি তিনি তখন মদ্যপান করছিলেন না বোধ হয়!
তা হবে। আমি ঠিক লক্ষ্য করিনি।
কোন গ্লাস ঘরে ছিল?
গ্লাস!
হ্যাঁ, ঐ কাচের গ্লাসটা–কিরীটী অদূরে টুলের উপরে রক্ষিত শূন্য কাচের গ্লাসটা দেখাল।
দেখিনি।
হুঁ। আচ্ছা, ইদানীং আপনার সঙ্গে তাঁর মন-কষাকষি চলছিল, তাই না?
অত্যন্ত সন্দেহ বাতিক ছিল লোকটির—
স্বাভাবিক। নিম্নকণ্ঠে কিরীটী কথাটা উচ্চারণ করল।
কিছু বললেন?
না। আচ্ছা, কে আপনাদের মধ্যে সামন্ত মশাইকে বিষ দিয়ে হত্যা করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
বিষ!
হ্যাঁ, তীব্র কোন বিষপ্রয়োগেই ওঁর মৃত্যু হয়েছে।
না না, ওঁর হার্টের ব্যামো ছিল, ব্লাড-প্রেসারও ছিল।
তা হয়তো ছিল, তবে তাঁর মৃত্যু বিষের ক্রিয়াতেই হয়েছে বলেই আমাদের ধারণা।
কিন্তু কে তাঁকে বিষ দেবে? কেউ তো তাঁর শত্রু এখানে ছিল না?
কার মনে কি আছে আপনি জানবেন কি করে? তারপরই হঠাৎ কিরীটী বললে, আপনার ডান হাতের কবজির কাছে রক্তের দাগ কিসের দেখি। দেখি হাতটা আপনার?
রক্তের দাগকই! না তো, ও কিছু না। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, সন্ধ্যার সময় সাজঘরের টিনের পার্টিশনের একটা পেরেকে হাতটা কেটে গিয়েছিল কবজির কাছে।
অভিনয়ের সময় দেখেছিলাম, আপনার দুহাতে কাচের আয়নার চুমকি বসানো দুটি চুড়ি। চুড়ি দুটো বুঝি খুলে রেখেছেন?
হ্যাঁ। সাজঘরে বাক্সর মধ্যে।
নিয়ে আসতে পারেন চুড়ি দুটো?
সুভদ্রা কেমন যেন এবারে একটু থতমত খেয়ে যায়। চুপ করে থাকে। কেমন যেন একটু মনে হয় ইতস্তত ভাব একটা।
কই, যান? নিয়ে আসুন চুড়ি দুটো?
সুভদ্রা বেরুচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী তাকে আবার কি ভেবে বাধা দিল, না, আপনি না। মণীশ চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে বলল, মিঃ চক্রবর্তী, বাইরে কাউকে বলুন তো, সুভদ্রা দেবীর সাজঘর থেকে চুড়ি দুটো নিয়ে আসতে।
মণীশ চক্রবর্তী বের হয়ে গেলেন।
ঘরে এবারে একা সুভদ্রা।
সুভদ্রা যেন বেশ একটু বিব্রতই বোধ করে, অথচ মুখে সেটা প্রকাশ না করলেও কিরীটীর বুঝতে কিন্তু অসুবিধা হয় না।
কিরীটী সুভদ্রার মুখের দিকে তাকাল।
সুভদ্রা দেবী!
অ্যাঁ! আমায় কিছু বলছিলেন?
সুভদ্রা দেবী, আমার নামটা বোধ হয় আপনি জানেন না—
সামন্ত মশাই যে বলছিলেন, ধূর্জটি রায় আপনার নাম!
নামটা আপনার মনে আছে দেখছি। কিন্তু ওটা তো আমার আসল নাম নয়।
তবে?
ওটা আমার অন্য একটি নাম, বিশেষ করে নামের আড়ালে যখন আমি আমাকে কিছুটা গোপন করতে চাই। বলতে পারেন ছদ্মনাম।
ছদ্মনাম!
হ্যাঁ।
সুভদ্রা তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ—কিরীটী রায় নামটা কখনও শুনেছেন?
কিরীটী রায়! আপনি কি তবে সেই বিখ্যাত রহস্যানুসন্ধানী—একটা ঢোঁক গিলে কেমন যেন শুকনো গলায় থেমে থেমে কথাগুলো টেনে টেনে উচ্চারণ করল সুভদ্রা।
হ্যাঁ, আমিই সেই।
তবে আপনি–
না। সামন্ত মশাইয়ের বন্ধু আমি কোনদিনও ছিলাম না—তাঁর সঙ্গে পরিচয় মাত্র আমার কয়েকদিন আগে। এবং আরও বোধ হয় আপনার একটা কথা জানা দরকার, তিনি মৃত্যু-আশঙ্কা করছিলেন বলেই আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
মৃত্যু আশঙ্কা!
হ্যাঁ, তাঁর ধারণা হয়েছিল তাঁকে হত্যা করা হবে।
কে—কে তাঁকে হত্যা করবে?
হত্যা যে কেউ তাঁকে করেছে সে তো দেখতেই পাচ্ছেন, ঐ সামনে তাঁর বিষ-জর্জরিত মৃতদেহ—আর এও আমি জানি–
কি—কি জানেন?
আপনারা যাঁরা আজ রাত্রে এখানে উপস্থিত হয়েছেন অভিনয়ের ব্যাপারে—সেই আপনাদের মধ্যেই কেউ একজন তাঁকে হত্যা করেছেন।
কিরীটী শান্ত ধীর গলায় কথাগুলো বলে গেল।
কে—কে তাঁকে হত্যা করেছে?
আপনিই অনুমান করুন না, কে তাঁকে হত্যা করতে পারে!
ঐ সময় মণীশ চক্রবর্তী পুনরায় এসে ঘরে ঢুকলেন, হাতে তাঁর একটি গালার চুড়ি।
একটিই পেয়েছেন—জোড়ার অন্যটা পাননি তো? কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
না, একটিই পেলাম।
জানতাম পাবেন না। সুভদ্রা দেবী, জোড়ার অন্য চুড়িটা কোথায় গেল? সুভদ্রার দিকে ফিরে তাকিয়ে কিরীটী তার কথাটা প্রশ্নের ভিতর দিয়ে শেষ করল।
জা—জানি না, ওখানেই তো খুলে রেখেছিলাম!
না, রাখেননি।
রাখিনি—কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি—অন্যটা ভেঙে গিয়েছে!
ভেঙে গিয়েছে।
হ্যাঁ, তৃতীয় অঙ্ক শুরু হবার পরই কোন এক সময় ভেঙে গিয়েছিল। কারণ তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি সময় আমার এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে, হাতে আপনার চুড়ি ছিল। তা কি করে ভাঙল?
সুভদ্রা চুপ। একেবারে যেন বোবা, বিমূঢ়।
জবাব দিন—এই ঘরের মধেই, না? কিন্তু ভাঙল কি করে?
হ্যাঁ, এই ঘর থেকে বেরুবার সময় দরজায় ধাক্কা লেগে চুড়িটা ভেঙে যায়।
আপনি মিথ্যে কথা বলছেন, যেমন একটু আগে বলেছিলেন, পেরেকে হাত কেটেছেন!
কিন্তু—
বলুন সত্যি কথাটা?
মিথ্যে আমি বলিনি।
বলেছেন। এবার বলুন তো—আপনি সন্তানসম্ভবা, তাই—
হ্যাঁ। মাথাটা আবার নীচু করল সুভদ্রা।
কার সন্তার আপনার গর্ভে?
সামন্ত মশাইয়ের।
তিনি জানতেন কথাটা?
জানতেন।
আশ্চর্য! অস্ফুট স্বরে কথাটা কিরীটী উচ্চারণ করল।
কি বললেন?
কিছু না। আপনি যেতে পারেন। পাল মশাইকে এ ঘরে পাঠিয়ে দিন।
সুভদ্রা ঘর ছেড়ে চলে গেল।
রাত শেষ হয়ে আসছিল। গ্রীষ্মের স্বল্পায়ু রাত্রি। খোলা জানলাপথে একটা ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে হাওয়া আসছিল।
রাধারমণ পাল এসে ঘরে ঢুকলেন।
ইতিমধ্যেই কিরীটীর পরামর্শে মণীশ চক্রবর্তী একটা চাদরে মৃতদেহটা ঢেকে দিয়েছিলেন চেয়ার থেকে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেন পাল মশাইয়ে মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে।
আমায় ডেকেছেন?
পাল মশাই!
কিরীটীর ডাকে রাধারমণ পাল ওর মুখের দিকে তাকালেন।
একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।
বলুন?
সুজিতবাবুকে আজ আপনি একটা পাইণ্ট বোতল দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
অভিনয়ের রাত্রে আপনি প্রত্যেক বারই দিতেন?
আজ্ঞে।
পাল মশাই, একটা কাজ আপনাকে করতে হবে। কিরীটী বললে।
কি বলুন?
আপাতত যতদিন না সামন্ত মশাইয়ের মৃত্যুরহস্যের একটা মীমাংসায় পুলিস পৌঁছায় ততদিন আপনার দলের কয়েকজন কলকাতার বাইরে কোথাও যেতে পারবেন না। ভাল কথা, দোলগোবিন্দবাবু আছেন তো, তাঁকে একবার যদি ডেকে দেন, কয়েকটা প্রশ্ন তাঁকে করতে চাই।
না মশাই, তার কোন সন্ধানই পাচ্ছি না।
সন্ধান পাচ্ছেন না?
না।
আপনি জানেন না তিনি কোথায় গিয়েছেন?
না। হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়ার কারণও তো কিছু বুঝতে পারছি না।
কিরীটী একটু যেন কি ভাবল, তারপর বললে, তিনি তো অনেক দিন আপনার দলে আছেন?
হ্যাঁ, তা ধরুন প্রায় বছর সাতেক তো হবেই। তবে মনে হচ্ছে—
কি?
ফ্রেঞ্চ লিকারের সন্ধানে বোধ হয় গিয়েছে। সারাটা দিনই উসখুস করছিল। কিন্তু আমি যেতে দিইনি। নেশা করলে ওর হুঁশ থাকে না। পার্ট করতে পারবে না। নচেৎ সে পালাবার লোক নয়। নেশা একটু বেশি করে বটে—লোকটা সাদাসিধে, ঘোরপ্যাঁচ তেমন কিছু নেই।
আপনার দলের সকলেরই বোতল-প্রীতি রয়েছে। কিরীটী বললে।
আজ্ঞে।
আর কে কে মদ্যপান করে থাকেন এ দলে?
সবাই করে অল্পবিস্তর।
শ্যামলকুমার?
বলতে পারি না।
আপনি?
না, জীবনে আজ পর্যন্ত মদ স্পর্শ করিনি।
হুঁ। তাহলে ঐ কথাই রইল, ওরা যেন কলকাতার বাইরে না যায়।
কিন্তু আপনি দলের কাদের কথা বলছিলেন যারা পুলিসের বিনানুমতিতে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না?
শ্যামলকুমার, সুজিতকুমার, সুভদ্রা দেবী আর আপনি ও দোলগোবিন্দবাবু।
রাধারমণ পাল যেন কেমন ফ্যালফ্যাল করে বোবা অসহায় দৃষ্টিতে কয়েকটা মুহূর্ত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর কিছুক্ষণ বাদে শুকনো গলায় প্রশ্ন করেন জিভটা দিয়ে ঠোঁট চেটে, কেন, আমাদের কি আপনি সন্দেহ করেন?
আপনাদের সকলের উপরই যে পুলিসের সন্দেহ পড়েছে তা নয়—
তবে?
বুঝতেই পারছেন আপনারা যাঁরা যাঁরা মৃত হরিদাস সামন্তর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এ হত্যারহস্যের মীমাংসায় একটা পোঁছতে হলে আপনাদের প্রত্যেকেরই, যাঁদের নাম করলাম আমাদের প্রয়োজন।
কিন্তু—ইতস্তত করলেন রাধারমণ পাল।
বলুন, থামলেন কেন?
সতিই কি আপনারা মনে করেন হরিদাস সামন্তকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে?
পুলিসের ধারণা আপাতত তাই, তবে ময়নাতদন্তে যদি অন্য কিছু প্রকাশ পায়।
কিন্তু আমরা আমাদের এককালের একজন সহকর্মীকে হত্যা করতে যাবই বা কেন?
সেটা জানতে পারলে তো সব কিছুর মীমাংসা হয়েই যেত পাল মশাই। যাক, যা বললাম, সেই মত সকলকে বলে দিন। আর পরশু বা তরশু বিকেলের দিকে আপনাদের চিৎপুরের অফিসে যাব, ওদের সকলকে উপস্থিত থাকতে বলবেন।
আর উপস্থিত থাকা! দল বোধ হয় আমার ভেঙেই গেল রায় মশাই!
রাধারমণ পালের গলার স্বরটা যেন বুজে আসে।
না না, দল ভাঙবে কেন?
কি বলেন, এর পরও দল আর থাকবে—তাছাড়া যা আপনারা বলেছেন তা যদি সত্যিই হয়-উঃ, আমি আর ভাবতে পারছি না রায় মশাই, এ কি সর্বনাশ হল! এখন দেখতে পাচ্ছি সামন্ত মশাইয়ের কথাটা শুনলেই বোধ হয় ভাল হত, বার বার করে আমাকে বলেছিলেন সামন্ত মশাই, এ নাটক করবেন না, অন্য নাটক দেখুন। কিন্তু কি যে মাথায় তখন ভূত চাপল! সামন্ত মশাই নিজে তো গেলেনই, আমাকেও ড়ুবিয়ে দিয়ে গেলেন অগাধ জলে।
কুণ্ডু ভবন থেকে সকলের বিদায় নিতে পরের দিন বেলা দশটা হয়ে গেল।
কিরীটী আগেই চলে গিয়েছিল।
মণীশ চক্রবর্তীও লাস মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য চালান করে দিয়ে একসময় বিদায় নিলেন। রাধারমণ পাল সকলকে নিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হলেন দশটায়। বেলা এগারোটায় একটা কলকাতাগামী ট্রেন আছে সেটাই ধরবেন।
০৮. গৃহে পৌঁছাতে কৃষ্ণা বললে
গৃহে পৌঁছাতে কৃষ্ণা বললে, একেবারে রাত কাবার করে এলে, ব্যাপার কি? যাত্রা শুনছিলে নাকি? খুব ভাল যাত্রা হয়েছে বুঝি?
সুভদ্রা হরণ যাত্ৰা আর শেষ হল কোথায়? একটা সোফার উপরে গা এলিয়ে দিতে দিতে কিরীটী বললে, শেষ হওয়ার আগেই যবনিকাপাত।
কি রকম?
সামন্ত মশাই-সেদিনের সে ভদ্রলোককে মনে আছে? প্রাণভয়ে ভীত হয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন! শেষ পর্যন্ত তাঁর আশঙ্কাটাই সত্য হল।
মানে?
কিরীটী তখন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বিবৃত করে গেল।
সব শুনে কৃষ্ণা বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, বল কি! শেষ পর্যন্ত তাহলে সত্যি-সত্যিই—
হ্যাঁ, বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু।
কে বিষ দিল?
সব তো তোমাকে বললাম–কে দিতে পারে বলে মনে হয়?
তুমি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছ?
একেবারে যে পারিনি তা নয়, তবে—
তবে? কৃষ্ণা সকৌতুক দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল।
হত্যার একটা মোটিভ থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমানে হাতের কাছে যে মোটিভটা পাচ্ছি সেটা তেমন যেন খুব একটা জোরালো মনে হচ্ছে না।
আমার কি মনে হচ্ছে জান?
কি?
তোমার ঐ সুভদ্রা না কি যেন নাম বলেছিলে মেয়েটির—
তুমি কি সুভদ্রাকেই—কিরীটীর কথাটা শেষ হল না।
কৃষ্ণা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, কোন মেয়েছেলে যখন ভালবাসা নিয়ে খেলায় মাতে তখন তার কাছে নীতি বলে কিছুই থাকে না, আর–
আর কি? মেয়েদের স্বার্থে ঘা লাগলে তখন তারা একজন পুরুষের চাইতে অনেক নীচে নামতে পারে।
নারী হয়ে তুমি একজন নারীর এত বড় অপযশ গাইছ কৃষ্ণা?
অপযশ গাইব কেন, সত্য যা তাই বলছি। তাছাড়া কোন পুরুষমানুষ কি কোন নারীর সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে পারে নাকি?
পারে না বুঝি?
না।
কেন?
কেন কি, সেইটেই তো পুরুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা।
কিন্তু এক্ষেত্রে তোমার যুক্তিটা কি? ঐ স্বার্থে ঘা লেঘেছে বলেই কি?
আমার কথাই বা তুমি মেনে নেবে কেন?
আর একটু প্রাঞ্জল যদি হতে দেবী—
আমার মনে হয় সুভদ্রার অনেকখানি অভিনয় আছে—
সে যে একজন পাকা অভিনেত্রী সেটা অবিশ্যি আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু—
একটা কথা ভুলো না।
কি?
তোমায় বলেছি একটু আগে সুভদ্রা অন্তঃসত্ত্বা।
কৃষ্ণা মৃদু হাসল। বলল, বস, চা নিয়ে আসি।
কৃষ্ণা সোফা ছেড়ে উঠে লঘু পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটীর চিন্তাধারাটাকে কিন্তু কৃষ্ণা যেন অন্য এক খাতে বইয়ে দিয়ে গেল। তবে কি সে ভুল পথে চলেছে!
স্ত্রীলোকের মন বিচিত্র পথে আনাগোনা করে মিথ্যা নয়, এমনিতেই মেয়েদের সহজাত একটা অভিনয়-প্রবৃত্তি থাকে–তার উপরে সুভদ্রা তো রীতিমত অনুশীলনের দ্বারা এত বছর ধরে সেই অভিনয়-প্রতিভাকেই তার ঝালিয়ে তুলেছিল।
সামান্য ইস্পাত আজ ঘষায় ঘষায় ধারালো হয়ে উঠেছে।
একটু পরে কৃষ্ণা দুকাপ কফি নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল।
একটা কাপ কিরীটীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্যটা নিজে নিয়ে মুখোমুখি বসল।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে কিরীটী বললে, কৃষ্ণা, আজ একবার বর্ধমান যাব।
হঠাৎ বর্ধমান?
একটু ঘুরে আসি।
সুভদ্রার মাসীর খোঁজ নিতে?
হ্যাঁ। বোনঝিটির পরিচয় পেলাম, মাসীটির সঙ্গে যদি পরিচয় করা যায়—
কখন যাবে?
দুপুরে।
.
রাত নটা নাগাদ বর্ধমান থেকে ফিরে দেড়তলার ঘরে প্রবেশের মুখে দরজার গোড়ায় নজর পড়ল একজোড়া ভারী জুতোর।
মনে হচ্ছে মণীশ চক্রবর্তীর আগমন হয়েছে।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখল তার অনুমান মিথ্যা নয়, বাইরে মণীশ চক্রবর্তীর জুতোই সে দেখেছে।
মণীশ চক্রবর্তী একটা চেয়ারে বসেছিলেন, সামনে একটা খালি চায়ের কাপ।
মণীশবাবু যে! কতক্ষণ?
তা প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হবে। মল্লিক সাহেবকে আপনি ফোন করেছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ।
তাঁকে বলেছেন কেসটার কথা?
কথায় কথায় বলেছিলাম।
আমি কি আপনাকে কোন অসম্মান করেছি বা কোনরকম অসহযোগিতা করেছি আপনার সঙ্গে?
না, না। সে কি কথা?
মল্লিক সাহেব মনে হলে যেন একটু ক্ষুন্ন হয়েছেন।
না না, ফোন করে দেবখন। বরং আমি আপনার দক্ষতার প্রশংসাই করছিলাম তাঁর কাছে। যাক, পোস্টমর্টেমের রিপোটা পেয়েছেন?
হ্যাঁ, সন্ধ্যায় পেয়েছি। এই যে দেখুন। আপনার অনুমানই ঠিক—a case of poisoning, stomach contents-এর মধ্যে লিকারের সঙ্গে মনে হচ্ছে কোন তীব্র বিষ ছিল। কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্য পাঠানো হয়েছে ফরেনসিক ল্যাবরেটরীতে স্টমাক কনটেন্টস–
খুব ভাল করছেন। কাচের গ্লাস আর বোতলটাও পাঠিয়েছেন তো?
হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে বললেন, আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানেন কিরীটীবাবু?
কি বলুন তো?
ঐ দোলগোবিন্দ না কি যেন নাম—যে সে রাত্রে হঠাৎ গা-ঢাকা দিয়েছে, এ তারই কীর্তি। নিশ্চয় তারই কীর্তি।
হতে পারে। তা হঠাৎ তারই উপরে সন্দেহটা পড়ছে কেন বিশেষ করে?
নচেৎ ব্যাটা হঠাৎ গা-ঢাকা দিলে কেন? কিন্তু যাবে কোথায়? আমি লোক লাগিয়েছি—ঠিক ধরবই ব্যাটাকে।
ব্যাপারটা স্রেফ ভয় বা নার্ভাসনেসও তো হতে পারে মিঃ চক্রবর্তী।
না, না কিরীটীবাবু—আপনি যাই বলুন, এতকাল খুনে ডাকাতদের নিয়ে কারবার করছি—ও মশাই সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। আরও একটি লোককে আমার সন্দেহ হয়, ব্যাটা একটি বাস্তু ঘুঘু–
কার কথা বলছেন?
কার আবার—ঐ রাধারমণ পাল, দলের অধিকারী, কেমন ভিজে বেড়ালটির মত হাবভাব দেখাচ্ছিল!
ভদ্রলোক প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছিল বুঝতে পারেননি?
ওটা স্রেফ অভিনয়। বুঝতে পারলেন না, ও দুটোকেই আমি ভাবছি অ্যারেস্ট করব। অ্যারেস্ট করে থানায় এনে চাপ দিলেই দেখবেন স্বীকার করতে পথ পাবে না। হুঁ, বলে কত দেখলাম। মল্লিক সাহেবকে আমি বলে দিয়েছি দুটো দিন অপেক্ষা করুন স্যার, ও রহস্যের মীমাংসা। আমি করে এনেছি প্রায়।
হুঁ, তাহলে শ্যামলকুমারের উপর থেকে সন্দেহটা আপনার গেছে? হঠাৎ কিরীটী বলল।
যায়নি একেবারে, তবে—
তবে?
অতটা আর নেই, তবু তার উপরে আমার চোখ আছে বৈকি।
কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ঐ ধরনের হত্যার একটা মোটিভ—উদ্দেশ্য থাকে, আপনার মনে হয় এ ক্ষেত্রে মোটিভটা কি?
মোটিভ? বুঝতে পারলেন না—কথাটা বলে একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে মণীশ চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে তাকালেন।
না, ঠিক বোধ হয় এখনও বুঝিনি।
ওদের দুজনেরই strong motive আছে।
যথা?
আজ সকালে দোলগোবিন্দর ছোট ভাইকে থানায় ডেকে আনিয়েছিলাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। সে কি বললে জানেন? দোলগোবিন্দ লোকটা নাকি যেমন মাতাল তেমনি একের নম্বরের জুয়াড়ি।
মাতাল, জুয়াড়ি?
হ্যাঁ।
Rare combination বলতেই হবে। তবে পাল মশাইও যেন অমনিই কিছু বলছিলেন।
জানেন শনিবার শনিবার ঘোড়দৌড়ের মাঠে সে যেত, আর সেই ব্যাপারেই হরিদাস সামন্তর কাছে তাকে হাত পাততে হত।
হরিদাস সামন্ত টাকা দিত?
দিত।–হ্যাঁ, খেপে খেপে অনেক টাকা তাকে দিয়েছিল ধার সামন্ত, যার একটা পয়সাও নাকি শোধ করেনি আজ পর্যন্ত দোলগোবিন্দ।
টাকা ধার দিত? টাকা ফেরত পাবে না জেনেও টাকা ধার দিত? আশ্চর্য!
তাই তো শুনলাম। পাল মশাইকেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনিও তাই বললেন। এখন বুঝতে পারছেন, সেই টাকা যাতে কোনদিন দোলগোবিন্দকে শোধ করতে না হয় তাই কৌশলেই হয়তো সে হরিদাস সামন্তকে-and that was the motive–
সরিয়ে দিয়েছে বলতে চান?
ব্যাপারটা কি খুব অসম্ভব!
হুঁ, আর রাধারমণ পাল—তার কি স্বার্থ?
আমার কি মনে হয় জানেন?
কি?
লোকটার ঐ সুভদ্রা মেয়েটার উপরে লোভ ছিল।
লোভ?
কেন, থাকতে পারে না? অমন ডবগা ছুঁড়ি, চেহারাখানা ভাবুন তো একবার।
মনে হচ্ছে আপনারও মনে যেন দোলা লাগিয়েছে সুভদ্রা! মৃদু হেসে কিরীটী সকৌতুকে বললে।
যাঃ, কি যে বলেন।
আহা, এতে লজ্জার কি আছে মিঃ চক্রবর্তী! ভাল জিনিস সকলের মনকেই আকর্ষণ করে।
মণীশ চক্রবর্তী সলজ্জ হাসি হাসেন।
০৯. সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হবার পরে
পরের দিন।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হবার পরেই কিরীটী চিৎপুরে রাধারমণ পালের যাত্রা-পার্টির অফিসে গিয়ে হাজির হল। গ্রীষ্মের রাত আটটা—সন্ধ্যাও বলা চলে সবে।
ঐ অঞ্চলটা যেমন ঘিঞ্জি, তেমনি নোংরা, তেমনি মানুষের ভিড়। ট্রাম-বাস-ট্যাক্সি-রিকশা ও ঠেলাগাড়িতে যেন গিজগিজ করছে।
গাড়ি থেকে নেমে কিরীটী হীরা সিংকে বলে, আশেপাশে কোথাও পার্ক করে রাখ।
এ অঞ্চলটা শহরের বোধ হয় সবচাইতে বেশী পুরনো। সেকেলে ধরনের সব দোতলা তিনতলা বাড়ি, গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যে মধ্যে সরু গলি। গলির মোড়ে চা
ও পান-সিগারেটের দোকান। রাস্তাটা যেমন সংকীর্ণ তেমনি নোংরা।
নবকেতন যাত্রা-পাটির অফিস খুঁজে পেতে বেশ একটু সময়ই লাগল। তিনতলা একটা বাড়ি, তার মধ্যে অনেক ঘর। দোতলায় নবকেতন যাত্রা পার্টির অফিস। নীচের তলাটা অন্ধকার। ভাঙা সরু সিঁড়ি, অন্ধকার। বারোয়ারী সিঁড়িতে আলোর বলতে গেলে কোন ব্যবস্থাই নেই।
পকেট থেকে সরু পেনসিল-টচটা বের করে তারই সাহায্যে কোনমতে কিরীটী দোতলায় উঠে গেল।
আরও দুটি যাত্রা-পাটির অফিস দোতলায়। হৈ-চৈ করে গান-বাজনা আর অভিনয়ের মহলা চলেছে। সরু রেলিং-ঘেরা বারান্দা বারান্দাটা দক্ষিণ-উত্তর ঘুরে পশ্চিম-উত্তরে চলে গিয়েছে। দক্ষিণের শেষ দুটো ঘরেই নবকেতন যাত্রা-পাটির অফিস। একটা ছোকরা একগাদা মাটির ভাঁড় ও একটি চায়ের কেতলী দিয়ে বারান্দা দিয়ে আসছিল, তাকেই কিরীটী শুধাল, নবকেতন যাত্রা-পাটির অফিস কোষ্টা?
ঐ যে স্যার, এগিয়ে যান না।
ছোকরাটি কিরীটীকে কথাটা বলে নিজের কাজে চলে গেল।
কিরীটী এগিয়ে গেল।
দরজা খোলাই ছিল। ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছিল।
দরজার পাশে দেওয়ালে টিনের সাইনবোর্ড লাগানো–নবকেতন যাত্রা-পার্টি।
ভিতরে প্রবেশ করল কিরীটী।
ঘরের মধ্যে দুটি লোক ছিল।
চিনতে তাদের কষ্ট হয় না কিরীটীর, একজন অধিকারী রাধারমণ পাল মশাই, আর একটি স্ত্রীলোক।
চন্দননগরে সে রাত্রে ঐ অভিনেত্রীটিকেও কিরীটী দেখেছিল। নাম কৃষ্ণভামিনী।
বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে, মোটাসোটা গড়ন।
দুজনে মুখোমুখি দুটি তক্তপোশের উপর বসে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে যেন কি আলোচনা করছিল, কিরীটীর পদশব্দে মুখ তুলে তাকাল।
কিরীটীর আজ ছদ্মবেশ ছিল না।
তাই বোধ হয় প্রথমটায় কিরীটীকে চিনতে পারেন না পাল মশাই। কুঞ্চিত করে তাকালেন, কি চাই?
পাল মশাই, নমস্কার।
নমস্কার। কোথা থেকে আসছেন?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, চিনতে পারছেন না বোধ হয়?
না।
আমি ধূর্জটি রায়।
আপনি—বিস্ময়ে পাল মশাইয়ের গলাটা যেন বাকরোধ হয়ে যায়।
হ্যাঁ, সেটা ছিল আমার ছদ্মবেশ!
ছদ্মবেশ!
হ্যাঁ, সামন্ত মশাইয়ের আমন্ত্রণেই ঐ ছদ্মবেশে সেদিন চন্দননগরে আমায় যেতে হয়েছিল।
বুঝলাম না ঠিক। আমার আসল নামটা হয়তো শুনে থাকবেন—কিরীটী রায়।
রহস্যানুসন্ধানী কিরীটী রায়!
হ্যাঁ।
তা আপনি–
বললাম তো, সামন্ত মশাইয়ের কেমন ধারণা হয়েছিল তাঁর জীবন বিপন্ন, তাই তিনি আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
তথাপি রাধারমণ পালের নিজেকে সামলে নিতে একটু সময় লাগল। কৃষ্ণভামিনীও চেয়ে ছিল কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটা আবার বললে, সেদিন বলেছিলাম আসব এখানে—
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বসুন, বসুন।
ঘরটি মাঝারি সাইজের, একধারে একটি তক্তপোশ পাতা সতরঞ্চি বিছানো, গোটাকয়েক তাকিয়া, মাঝখানে একটি টানাওয়ালা নীচু ডেস্ক।
অন্য পাশে একটি কাঠের আলমারি। খানকয়েক চেয়ার ও টুল।
দেওয়ালে দু-তিনটে ক্যালেণ্ডার, একটি গ্রুপ ফটো।
ঘরের মধ্যে বেশ একটি উজ্জ্বল শক্তির বাতি জ্বলছিল।
রাধারমণ পাল তক্তপোশ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন ইতিমধ্যে। বললেন, বসুন রায় মশাই।
আপনার দলের আর সবাইকে দেখছি না?
সবাই আছে পাশের ঘরে। রাধারমণ পাল বললেন, ভামিনী, শঙ্করকে ডেকে চায়ের কথা বল।
ব্যস্ত হবেন না পাল মশাই। চায়ের এখন প্রয়োজন নেই। কিরীটী বললে।
দল বোধ হয় উঠেই যাবে রায় মশাই। রাধারমণ বললেন এরপর।
কেন?
আর কেন—শ্যামল চলে যাচ্ছে, নোটিস দিয়েছে, সামন্ত মশাই নেই, বুঝতেই পারছেন শ্যামলও চলে গেলে–
সুভদ্রাও কি নোটিস দিয়েছে নাকি? কিরীটী শুধাল।
না, দেয়নি এখনও, তবে শ্যামল না থাকলে সুভদ্রাও যে থাকবে না সে তো জানা কথাই। তা বটে! আর সুজিতবাবু?
না, ও বোধ হয় যাবে না। হরিদাস চলে গেল, শ্যামল আর সুভদ্রা চলে গেলে কাকে নিয়ে আর পালা গাওয়াব?
ভাল কথা, দোলগোবিন্দবাবুর কোন সংবাদ পেলেন?
সে ফিরে এসেছে। এসেছে!
তা সেদিন রাত্রে হঠাৎ গা-ঢাকা দিয়েছিলেন কেন?
ভয়ে।
কিরীটী মৃদু হাসল।
সেই আলোচনাই করছিলাম ভামিনীর সঙ্গে বসে। একদিন আমি, হরিদাস আর কৃষ্ণভামিনী তিনজনে মিলে দল গড়েছিলাম। আমার আর হরিদাসের আধাআধি বখরা। শেষ পর্যন্ত হরিদাস বখরা বেচে দিল আমাকে।
হরিদাসবাবুর মুখে সে-কথা শুনেছি।
শুনেছেন!
হ্যাঁ।
কি যে হল, হঠাৎ বখরা বেচে দিল।
সবাইকে আজ এখানে উপস্থিত থাকতে বলেছিলাম—
সবাই এসেছে—সবাই পাশের ঘরে আছে, কার কার সঙ্গে আপনি কথা বলতে চান বলুন, আমি ডাকছিনা, সবাইকে ডাকব?
সবাইকে ডাকার একসঙ্গে প্রয়োজন নেই, সকলকে আমার প্রয়োজনও নেই। আচ্ছা সেরাত্রে হরিদাসবাবুর সাজঘরের পাশের দুটি সাজঘরে কারা কারা ছিল বলতে পারেন?
হরিদাসের সাজঘরের ডান দিকের সাজঘরে ছিল সুজিত আর কৃষ্ণধন।
কৃষ্ণধন?
হ্যাঁ, কৃষ্ণধন চাটুজ্যে। ঐ যে লম্বা ঢ্যাঙা মত, নায়কের বন্ধুর রোল করেছিল নাটকে!
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আর বাঁদিককার ঘরে?
সুভদ্রা আর এই কৃষ্ণভামিনীর সাজঘর ছিল। আর বাকি সব একটা বড় সাজঘরে ছিল। মধ্যবর্তী দরজা ছিল একটা দুঘরের মধ্যে।
কিরীটী কি যেন চিন্তা করে।
ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী হরিদাস সামন্তর মৃত্যু হয়েছিল রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে, অর্থাৎ তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে। পালা শুরু হয়েছিল ঠিক রাত সাড়ে সাতটায়।
পাল মশাই!
আজ্ঞে?
রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত—আপনি কোথায় ছিলেন ঐ এক ঘণ্টা সময়?
ঠিক মনে পড়ছে না।
তৃতীয় অঙ্ক শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টা কোথায় ছিলেন মনে করে দেখুন!
আমি প্রথম দিকে আসরেই ছিলাম, তারপর হঠাৎ মনে পড়ল হরিদাস একশো টাকা চেয়েছিল, সেই টাকাটা দেবার জন্য নিজের ঘরে চলে আসি।
সেই সময় সে ঘরে আর কে ছিল?
আমি আর দোলগোবিন্দবাবু।
দোলগোবিন্দবাবু তাঁর সাজঘরে না থেকে আপনার ঘরে ছিলেন কেন?
তার পার্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই তার সাজঘরে না থেকে আমার ঘরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিল বোধ হয়।
ভাল কথা, পাল মশাই—
বলুন?
দোলগোবিন্দবাবুর রেস খেলা অভ্যাস আছে, তাই না?
হ্যাঁ, ঐ ঘোড়া রোগেই তো ওর সব খেয়েছে। হরিদাসের ছিল মদ আর মেয়েমানুষ, আর দোলগোবিন্দর মদ আর ঘোড়া। নচেৎ দুজনেরই অসাধারণ অভিনয়-প্রতিভা ছিল।
দুজনের মধ্যে খুব সদ্ভাব–মানে সম্প্রীতি ছিল বুঝি?
তা তো ছিল বলেই মনে হয়।
দোলগোবিন্দবাবুকে হরিদাসবাবু প্রায়ই টাকা ধার দিতেন, তাই না?
দিত, কিন্তু শুনলেন কোথায়?
শুনেছি। এবং সে টাকা তিনি শোধ করতেন না।
রেস খেলে সব ওড়াত, টাকা শোধ করবে কোথা থেকে?
টাকা কখনও দোলগোবিন্দবাবু শোধ করতেন না, অথচ হরিদাসবাবু তাঁকে টাকা দিয়েই যেতেন!
কি জানি মশাই, তাই তো দিত।
আচ্ছা পাল মশাই, সুজিতবাবুর সঙ্গে দোলগোবিন্দবাবুর সম্প্রীতি কেমন ছিল?
দুজনের বলতে পারেন সাপে-নেউলের সম্পর্ক, ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত।
আর একটা কথা–বলতে বলতে কিরীটী পকেট থেকে কাগজের একটা ভাঁজ-করা টুকরো বের করল, আপনি তো হরিদাস সামন্তর অনেক দিনের পরিচিত, দেখুন তো এই লেখাটা—তাঁরই হাতের লেখা কিনা?
দেখি। রাধারমণ পাল ভাঁজ-করা কাগজটা হাতে নিলেন, চোখে চশমা দিয়ে বেশ ভাল করে দেখলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, এটা কোথায় পেলেন?
মনে নেই। সে-রাত্রে শ্যামলবাবু দিয়েছিলেন—এই সেই চিরকুট যেটা রাধা দেবী শ্যামলের হাতে দেবার জন্য চাকর ভোলাকে দিয়েছিল।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। চিরকুটে লেখা-শ্যামল, একবার দেখা করবে সময় পেলেই, জরুরী দরকার।
কি মনে হয় পাল মশাই, লেখাটা সামন্ত মশাইয়েরই তো?
সেই রকমই তো হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে।
ঠিক বলতে পারছেন না? আচ্ছা, হরিদাসবাবুর কোন হাতের লেখা আপনার কাছে আছে?
সে রকম কিছু নেই।
কোন চিঠি বা—
দাঁড়ান, মনে পড়েছে, সুভদ্রা হরণ নাটকের পাণ্ডুলিপির মধ্যে মধ্যে হরিদাসের হাতে correction ও suggestion লেখা আছে, যা সে রিহার্সেলের সময় লিখেছিল!
দেখতে পারি একবার নাটকের পাণ্ডুলিপিটা?
নিশ্চয়ই। ভামিনী, আলমারি থেকে পাণ্ডুলিপিটা বার করে দাও তো। এই নাও চাবি।
পাল মশাই পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বের করে দিলেন।
কৃষ্ণভামিনী নিঃশব্দে উঠে গিয়ে চাবি দিয়ে আলমারি খুলে নাটকের পাণ্ডুলিপিটা বের করে
র করে এনে দিল।
কিরীটী উল্টে-পাল্টে কিছুক্ষণ কয়েকটা পাতা দেখল, তারপর বললে, পাল মশাই!
বলুন।
পাণ্ডুলিপিটা আমি নিয়ে যাব।
নিয়ে যান ও অভিশপ্ত পাণ্ডুলিপি, ও এঘরে থাকলে হয়ত আরও অমঙ্গল হবে।
কৃষ্ণভামিনী দেবী!
কিরীটীর ডাকে মহিলাটি ওর মুখের দিকে তাকাল।
এক কাপ চা খাওয়ান।
কৃষ্ণভামিনী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
পাল মশাই!
আজ্ঞে?
আমার দুটো ঠিকানা চাই।
ঠিকানা!
হ্যাঁ, সুভদ্রা ও হরিদাসবাবু কোথায় থাকতেন সেই বাড়ির ঠিকানা, আর সুজিতবাবুর বাসার ঠিকানা।
সুভদ্রা আর হরিদাস পাল স্ট্রীটে থাকত—তিন/দুই, আর সুজিত কালীঘাটে থাকে, মহিম হালদার স্ট্রীটে।
খাতা দেখে অতঃপর সঠিক ঠিকানা দুটো বলে দিলেন রাধারমণ, কিরীটী টুকে নিল নোটবুকে।
আর একটা কথা—
বলুন?
সুজিতবাবুই তো একদিন সুভদ্রাকে আপনার দলে এনেছিলেন?
হ্যাঁ।
এবারে দোলগোবিন্দবাবুকে একবার ডাকুন।
আর কাউকে?
না।
রাধারমণ পাল ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং একটু পরে দোলগোবিন্দকে নিয়ে এসে ঢুকলেন।
১০. রোগা প্যাঁকাটির মত চেহারা
রোগা প্যাঁকাটির মত চেহারা। তোবড়ানো গাল, কোটরগত চক্ষু দীর্ঘ অত্যাচারের সাক্ষ্য দেয়। দুই চোখে ভীত-সন্ত্রস্ত চাউনি।
আপনারই নাম দোলগোবিন্দ? কিরীটীর প্রশ্ন।
আজ্ঞে, সিকদার।
আপনার সেরাত্রে লাস্ট সিনে চাকরের পার্টে প্রক্সি দেওয়ার কথা ছিল না?
আজ্ঞে।
তবে যাননি কেন?
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘু
মিয়ে পড়েছিলেন!
হ্যাঁ, মানে, ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। ঘু
মোতে ঘুমোতেই বুঝি কোথাও চলে গিয়েছিলেন?
আজ্ঞে!
তবে সে রাত্রে অত খুঁজেও আপনাকে পাওয়া গেল না কেন?
আজ্ঞে, পুকুরের পাড়ে—
পুকুরের পাড়ে!
হ্যাঁ, বড্ড গরম, তাই পুকুরের ধারে সিঁড়ির উপরে গিয়ে বসেছিলাম একটু। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
তারপর ঘুম ভাঙল কখন?
পরের দিন সকালে?
তারপর কি করলেন?
তখন শুনলাম হরিদাসদা খুন হয়েছেন—সেই শুনে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।
কার কাছে শুনলেন?
রাধার কাছে।
পাল মশাই, রাধা দেবীকে ডাকুন তো!
রাধারমণ কিরীটীর নির্দেশে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন আবার। ঠিক ঐ সময় কৃষ্ণভামিনী এক কাপ চা হাতে ঘরে এসে ঢুকল।
চা—
রাখুন ওখানে।
কৃষ্ণভামিনী চায়ের কাপটা পাশের একটা টুলের উপরে নামিয়ে রাখল।
রাধারাণী এসে ঘরে ঢুকল রাধারমণ পালের সঙ্গে।
রাধারাণী দেবী আপনার নাম?
আজ্ঞে।
আপনি দোলগোবিন্দবাবুকে পরের দিন সকালবেলা দিঘির পাড়ে দেখেছিলেন?
কে বললে?
কেন উনি বলছেন?
ও মাগো, কোথা যাব গো—হ্যাঁরে হাড়হাবাতে অলপ্পেয়ে অনামুখখা, তোর সঙ্গে আমার দেখা হল পরের দিন সকালে কখন রে?
রাধা, মানে তুই–
দোলগোবিন্দর মুখের কথাটা শেষ হতে পারল না।
রাধা চোখ পাকিয়া চিৎকার করে উঠল, বদমায়েসী করবার আর জায়গা পাওনি হতচ্ছাড়া ড্যাকরা! খেংরে বিষ ঝেড়ে দেব তোমার!
সে কি রাধা, তুমি আমায় বললে না—দেখুন স্যার, ও মিথ্যে বলছে, নচেৎ আমি জানব কি করে যে হরিদাসদা খুন হয়েছে?
রাধারাণী প্রায় তখুনি ঝাঁপিয়ে পড়ছিল দোলগোবিন্দর উপর, কিরীটী বাধা দিল, থামুন। থামুন, কি করছেন আপনারা, যান রাধারাণী দেবী, আপনি এ ঘর থেকে চলে যান।
রাধারাণী গজরাতে গজরাতে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
দোলগোবিন্দবাবু! কিরীটী ডাকল।
কেঁদে ফেললে দোলগোবিন্দ, বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কিছু জানি না, কিছু দেখিনি সে-রাতে। ওসব খুনোখুনির মধ্যে আমি ছিলাম না।
আপনি সে-রাতে সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে কোথায় ছিলেন দোলগোবিন্দবাবু, অর্থাৎ তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি সময়?
ঠিক মনে পড়ছে না। কাঁদতে কাঁদতে বললে দোলগোবিন্দ।
মনে পড়ছে না?
আজ্ঞে না।
ঐ সময় হরিদাসবাবুর ঘরে গেছেন একবারও?
না তো!
কাউকে সে-ঘরে যেতে দেখেছেন?
কাকে দেখব।
কাউকে দেখেছেন কিনা তাই জিজ্ঞাসা করছি। মনে করে দেখুন না, কিংবা মনে করে দেখুন তো, কেউ আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছিল কিনা শ্যামলবাবুকে দিতে!
চিঠি?
হ্যাঁ, একটুকরো কাগজ?
কাগজ–শ্যামলকুমারকে দিতে!
হ্যাঁ, দিয়েছিল কেউ আপনাকে—তাই না?
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমাকে নয়, ভোলাকে-কে যেন একটা কি ভোলার হাতে দিয়ে বললে সেটা শ্যামলকুমারকে দিতে, হরিদাসদা দিয়েছেন।
কে সে?
অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারিনি, তাছাড়া আসরে তখন আমার যাবার কথা, আমার পার্ট ছিল।
মেয়েছেলে, না কোন পুরুষ?
মনে হচ্ছে মেয়েছেলে।
কে বলে মনে হয় সে আপনাদের দলের?
চিনতে পারিনি–ঠিক বুঝতে পারিনি।
রাধারমণবাবু?
আজ্ঞে?
আপনার দলের কজন স্ত্রীলোক আছেন?
চারজন। কৃষ্ণভামিনী, সুভদ্রা, রাধারাণী আর ফুল্লরা।
ফুল্লরা কে?
যে সে-রাত্রে নায়কের ছোট বোন সেজেছিল।
তাকে একবার ডাকবেন এ ঘরে?
রাধারমণ তখুনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
দোলগোবিন্দবাবু!
আজ্ঞে।
আপনার দেশ কোথায়?
বর্ধমানে।
টাউনে?
না, মেমারীতে-সুভদ্রার মাসী যেখানে থাকে।
সুভদ্রার মাসীকে আপনি চেনেন?
চিনব না কেন—একই পাড়ায় তো।
তাহলে সুভদ্রাকেও আপনি চেনেন?
ও যখন মেমারীতে ছিল তখন চিনতাম, তাছাড়া বাড়িতে তো আমি খুব একটা যাই না।
বাড়িতে আপনার কে কে আছে?
কেউ নেই, এক বিধবা পিসি।
বিয়ে-থা করেননি?
করেছি। স্ত্রী এখানেই আমার সঙ্গে বেলেঘাটায় থাকে।
শেষ কবে সুভদ্রাকে আপনি মেমারীতে দেখেন?
তা বছর দশেক আগে হবে। ও বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে।
পালিয়ে?
হ্যাঁ, শুনেছিলাম তাই।
কার সঙ্গে? ওখানকারই কারও সঙ্গে কি?
তা জানি না, স্ত্রীর মুখে পরে আমি কথাটা শুনেছিলাম।
সুভদ্রাকে তারপর কবে আবার দেখলেন?
এখানেই—বছর তিনেক আগে এ দলে এসে।
এ দলে কতদিন আপনি আছেন?
তিন বছর।
তার আগে?
অন্য দলে অভিনয় করতাম।
সে দল ছেড়ে দিলেন কেন?
মিথ্যে বলব না হুজুর, আপনি পুলিসের লোক, চুরির দায়ে আমার চাকরি যায়।
চুরি?
হ্যাঁ, সব মিথ্যে—কিন্তু প্রমাণ করতে পারলাম না।
রাধারমণ ঐ সময় ফুল্লরাকে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন।
ফুল্লরার বয়স বছর কুড়ি হবে। বেশ ফরসা গায়ের রং, দোহারা চেহারা। মুখটা গোল, চক্ষু দুটি চঞ্চল।
একই নাম ফুল্লরা, রায় মশাই। রাধারমণ বললেন।
তোমার নাম ফুল্লরা?
আজ্ঞে। গলাটি মিহি ও মিষ্টি সুরেলা।
কিরীটীর মনে পড়ল মেয়েটি পালায় সে-রাত্রে চমৎকার গান গেয়েছিল।
তুমি সে-রাত্রে শ্যামলবাবুর হাতে একটা চিঠি দিয়েছিলে?
কে বললে?
দিয়েছিলে কিনা তাই জিজ্ঞাসা করছি।
না তো!
দোলগোবিন্দবাবু, দেখুন তো—সে রাত্রে ও-ই কি শ্যামলবাবুর হাতে চিঠিটা দিয়েছিল?
দোলগোবিন্দ তাকাল ফুল্লরার দিকে। ফুল্লরাও তাকিয়ে থাকে – কুঞ্চিত করে দোলগোবিন্দর দিকে। কয়েকটা মুহূর্ত, তারপর দোলগোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে না।
ফুল্লরার ভ্রূযুগল সরল হয়ে আসে।
ঠিক আছে, তোমরা যেতে পার।
দোলগোবিন্দ আর ফুল্লরা ঘর ছেড়ে চলে গেল।
আর কাউকে ডাকব রায় মশাই? রাধারমণ শুধালেন।
না, থাক।
সবাই আছে ও ঘরে।
থাক, প্রয়োজন নেই।
চা-টা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেল রায় মশাই। আর এক কাপ চা আনি?
না, এবারে আমি যাব। আচ্ছা চলি, নমস্কার।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
দুই দিন পরে। দ্বিপ্রহরে কিরীটী ও কৃষ্ণার মধ্যে কথা হচ্ছিল। গতকাল সকালে আবার কিরীটী বর্ধমানে মেমারীতে গিয়েছিল, ফিরেছে রাত্রে।
কৃষ্ণা সেই সম্পর্কেই কথা বলছিল, কাল হঠাৎ আবার বর্ধমানে গিয়েছিলে কেন বললে তো?
আগের বার সুভদ্রার মাসীর খোঁজ পাইনি, তাই আবার গিয়েছিলাম যদি তার দেখা পাই।
দেখা হল?
না।
কেন, বাড়িতে ছিল না বুঝি?
বছরখানেক আগে তার মৃত্যু হয়েছে।
সে কি! তবে যে সুভদ্রা তোমাকে বলেছিল!
এখন দেখছি তোমার কথাই ঠিক কৃষ্ণা।
তোমাকে সেদিনই আমি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম না, সুভদ্রাকেই আমার সন্দেহ হয়।
সন্দেহ যে আমারও হয় না তা নয়, তবে—
তবে আবার কি?
তার গর্ভের সন্তানই সব যেন কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে।
ঐ মেয়েটি একটি সাংঘাতিক চরিত্রের এ তুমি জেনে রেখো।
সেটা যে বুঝিনি তা নয় কৃষ্ণা, কিন্তু তার গর্ভের সন্তানই যে আমার সব হিসাব গোলমাল করে দিচ্ছে।
ওদের মত মেয়ের আবার সন্তানধারণ!
তুমি যে দেখছি, না বিইয়েই কানাইয়ের মা হয়ে বসলে!
ঠাট্টা করছ?
পাগল! যাও গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে, এক কাপ চা আন তো।
১১. রাত তখন বোধ করি নটা হবে
রাত তখন বোধ করি নটা হবে।
সারাটা দিন প্রচণ্ড গরম গিয়েছে, যেমন রৌদ্রের তাপ তেমনি গরম হাওয়া, গা যেন ঝলসে দিচ্ছিল।
কিছুক্ষণ হল সবে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
খুঁজে খুঁজে কিরীটী শ্যামবাজারে পাল স্ট্রীটে রাধারমণ পালের দেওয়া ঠিকানামত একটা সরু গলির মুখে এসে দাঁড়াল।
পাল স্ট্রীট থেকেই সরু গলিটা একটা গলির মত যেন বের হয়ে গিয়েছে। দুপাশে গলিটার দোতলা-তিনতলা বাড়ির ভিতরকারের অংশ।
গলি-পথে আলোর তেমন ভাল ব্যবস্থা নেই। পকেট থেকে টচটা বের করে আলো ফেলে নম্বরটা দেখে চতুর্থ বাড়ির দরজার কলিং বেলটা কিরীটী টিপল, বার দুই টেপবার পর ভিতর থেকে সাড়া পাওয়া গেল।
একটু পরেই দরজা খোলার শব্দ, অন্ধকার।
নারী-কণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল অন্ধকারেই, এত তাড়াতাড়ি এলে, তোমার তো আসবার কথা—
সুভদ্রার কথা শেষ হল না।
কিরীটী সাড়া নিয়ে বললে, সুভদ্রা দেবী, আমি কিরীটী রায়।
মুহূর্তের যেন একটা স্তব্ধতা, তারপরই চাপা সতর্ক কিছুটা শঙ্কিত কণ্ঠে উচ্চারিত হল, কিরীটীবাবু।
হ্যাঁ, ভিতরে চলুন, আপনার সঙ্গে কিছু দরকারী কথা আছে।
দরকারী কথা! কিন্তু আমি যে এখুনি একবার বেরুব কিরীটীবাবু!
বেশী সময় নেব না, দু-চার মিনিট। চলুন না।
আসুন।
সরু একটা অন্ধাকার প্যাসেজ, কিরীটী টর্চ হাতে সুভদ্রার পিছনে পিছনে এগুতে এগুতে বললে, প্যাসেজে বুঝি আলো নেই?
ছিল। ফিউজ হয়ে গিয়েছে।
প্যাসেজের পরে একটা ছোট বারান্দা মত, তার একটার মধ্যে টিনের একটা শেড।
একটা ঘরের দরজা খোলা, আলো আসছিল খোলা দরজাপথে। পাশাপাশি দুটো ঘর। যে ঘরে আলো জ্বলছিল কিরীটীকে নিয়ে সুভদ্রা সেই ঘরেই এসে ঢুকল। ঘরটা বড় নয়, ছোটই আকারে। কিন্তু ছিমছাম করে সাজানো।
একপাশে একটি খাটে পরিপাটি করে শয্যা বিছানো, পাশাপাশি দুজোড়া মাথার বালিশ, বালিশের ওয়াড়ে ঝালর বসানন লেসের। মধ্যখানে একটা পাশবালিশ।
মাথার কাছে একটা নীচু টেবিলের ওপরে একটা টেবিল ফ্যান। ফ্যানটা ঘূর্ণায়মান, তার পাশে একটা কাচের প্লেটে কিছু বেলফুল, একটি ধূপদানীতে ধূপকাঠি প্রজ্বলিত। চন্দনধূপের মিষ্টি গন্ধ বেলফুলের সুগন্ধের সঙ্গে মেশামেশি হয়ে ঘরের বাতাস যেন স্নিগ্ধ রেখেছে।
অন্যদিকে আয়না বসানো একটি কাঠের আলমারি। একটি মিটসেফ, সেফের উপরে গোটা দুই ইন্ডিয়ান রামের বোতল, একটা কাচের জাগ জলভর্তি, গোটা দুই গ্লাস। খান-দুই চেয়ারও ছিল ঘরে।
বসুন কিরীটীবাবু!
কিরীটীর দৃষ্টি তখন সুভদ্রার উপর ন্যস্ত।
চমৎকার করে খোঁপা বেঁধেছে সুভদ্রা, খোঁপায় একটি বেলফুলের মালা জড়ানো। পরনে নীল রংয়ের লাল চাওড়াপাড় দামী তাঁতের শাড়ি। হাতে দুগাছি সোনার বালা। কপালে কুমকুমের টিপ।
এই বাড়িতেই আপনি হরিদাস সামন্তর সঙ্গে থাকতেন? কিরীটী শুধাল।
হ্যাঁ। এবারে ছেড়ে দিতে হবে।
ছেড়ে দেবেন কেন? শ্যামলবাবু বুঝি অন্য বাসা ঠিক করেছেন?
এখনও পায়নি, খুঁজছে বাসা।
হুঁ। তা আপনার মাসীর কোন সংবাদ পেলেন?
মাসী!
বলেছিলেন না সেদিন মাসী খুব অসুস্থ, তাকে দেখতে যাবেন?
যাওয়া আর হল কই! হঠাৎ যে ঝঞ্ঝাটে পড়া গেল!
তা ঠিক। তা যাবেন না?
দেখি, চিঠি দিয়েছি।
সুভদ্রা দেবী—
বলুন!
মাসীর কাছ থেকে আপনি কতদিন হল চলে এসেছেন?
তা বছর সাত-আট হবে।
মধ্যে মধ্যে যেতেন মাসীর কাছে, তাই না?
হ্যাঁ, আমি ছাড়া তো আর ওর কেউ নেই।
শেষ কবে গেছেন?
মাস দুই আগেও তো গিয়েছি।
কেমন ছিলেন তখন তিনি।
বিশেষ ভাল যাচ্ছে না মাসীর শরীরটা।
আপনার বিবাহ হয়েছিল বলেছিলেন সেদিন, আপনার স্বামীর নামটা কি কোথায় যেন দেশ-বাড়ি?
হুগলী জেলায়। নাম ছিল শ্যামাকান্ত।
শ্যামাকান্ত কি?
শ্যামাকান্ত ঘোষ।
বিয়ে বোধ হয় আপনার মাসীই দিয়েছিল?
হ্যাঁ, তাছাড়া আর কে দেবে!
বিয়ে কোথায় হয়েছিল, মেমারীতে?
হঠাৎ যেন চমকে তাকাল সুভদ্রা কিরীটীর মুখের দিকে। তারপর একটা ঢোঁক গিলে বলল, হ্যাঁ।
বিয়ে হয়েছিল আপনাদের কি মতে? হিন্দু-মতে না রেজেস্ট্রি করে?
হিন্দু-মতে।
আপনি কিন্তু সত্যি বললেন না, কারণ আমি যতদূর দেখছি আপনি পালিয়ে এসেছিলেন মাসীর কাছ থেকে, তারপর হয়ত বিয়ে করেছিলেন কাউকে।
কে বললে আপনাকে আমি পালিয়ে এসেছিলাম?
যদি বলি আপনার মাসী, এবং—
কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না, কলিং বেল ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল।
কে এল! আপনি একটু বসুন, দেখে আসি।
যান।
সুভদ্রা তড়িৎপদে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং কিরীটী শিকারী বিড়ালের মত সুভদ্রাকে অনুসরণ করে।
অন্ধকার প্যাসেজ।
দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল, ফিসফিস্ করে দুটো কথা, যাও, শীগগিরী যাও এখান থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করার শব্দ।
কিরীটী চকিতে ঘরে এসে প্রবেশ করে।
একটু পরে সুভদ্রা এসে ঘরে ঢুকল।
কে এসেছিল?
কেউ না। ভুল নম্বর, অন্ধকারে অন্য বাড়িতে বেল টিপেছিলেন ভদ্রলোক।
আচ্ছা, সুভদ্রা দেবী, আজ তাহলে আমি চলি।
কিরীটী আর দাঁড়াল না, ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
নিজেই সদর দরজা খুলে গলির মধ্যে পড়ে, বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে পাশেই অল্প দূরে একটা ঝুল-বারান্দা দেখে তার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টিতে রাস্তার এদিক-ওদিক নজর রাখতে লাগল।
প্রায় মিনিট কুড়ি-পঁচিশ বাদে দেখা গেল সুভদ্রা গলি থেকে বের হয়ে এল।
কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে সুভদ্রাকে অনুসরণ করে।
সুভদ্রা এদিক-ওদিক সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে ট্রাম রাস্তার সামনে যে নিউ স্টার রেস্টুরেন্ট তার সামনে এসে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক তাকাল, তারপর চট্ করে একসময় রেস্টুরেন্টের মধ্যে ঢুকে গেল সুভদ্রা।
কিরীটী চেয়ে থাকে।
রাস্তার অপর দিককার ফুটপাতে একটা খোলা জায়গায় মোটর রিপেয়ারিংয়ের কারখানা। লোকজন কারখানায় কাজ করছে, গোটা দুই গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে, তারই একটার আড়ালে কিরীটী নিজেকে গোপন করে উল্টো দিকের ফুটপাতে রেস্টুরেন্টের দিকে চেয়ে থাকে।
রেস্টুরেন্টের খোলা দরজাপথে এবং ভিতরের উজ্জ্বল আলোয় সব কিছুই স্পষ্ট চোখে পড়ে কিরীটীর।
ভিতরে খরিদ্দারের বিশেষ একটা ভিড় দেখা যায় না। জনা তিন-চার খদ্দের বসে আছে। কিরীটী দেখতে পায় সুভদ্রা গিয়ে একটা কোণের টেবিলে চেয়ার টেনে বসল। রেস্টুরেন্টের ছোকরাটা সামনে এসে দাঁড়াল, কি যেন তাকে বলল সুভদ্রা। সুভদ্রা মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়েছে। সুভদ্রার দৃষ্টি কিন্তু রাস্তায়, ঘন ঘন তাকাচ্ছে সে রাস্তার দিকে।
পনের মিনিট কুড়ি মিনিট প্রায় কাটতে চলেছে, সুভদ্রা কখন থেকে এক কাপ চা নিয়ে বসে আছে সেই কোণের টেবিলের চেয়ারটায়। হঠাৎ কিরীটীর দৃষ্টি সজাগ হয়ে উঠল।
একজন এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে রেস্টুরেন্টের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। এবং অল্পক্ষণ পরেই সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে এল।
সুভদ্রার সঙ্গের লোকটিকে চিনতে, অন্য ফুটপাতে দাঁড়িয়েও, রেস্টুরেন্টের উজ্জ্বল আলোয় কিরীটীর এতটুকু অসুবিধা হয় না।
চোখের তারা দুটো তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একটা আরামের নিঃশ্বাস নেয় কিরীটী এতক্ষণে যেন, তাহলে অনুমান তার মিথ্যা নয়।
কিরীটীর প্রয়োজন শেষ হয়ে গিয়েছিল।
হীরা সিংকে বাগবাজারের মোড়ে পেট্রোল পাম্পটার সামনে গাড়ি পার্ক করে রাখতে বলে এসেছিল, এগিয়ে গেল কিরীটী সেইদিকে।
গাড়িতে উঠে বসে কিরীটী বললে, চল হীরা সিং, কোঠি।
রাত প্রায় পৌনে এগারটায় কিরীটী তার গৃহে এসে পৌঁছল।
কোথায় গিয়েছিলে? কৃষ্ণা শুধায়, এত রাত হল যে?
সোফার উপরে আরাম করে বসতে বসতে কিরীটী বললে, দাঁড়াও, অনেকক্ষণ ধূমপান করিনি। বলতে বলতে পকেট থেকে একটা সিগার বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করল।
কফি খাবে?
মন্দ কি!
বসো, কফি আনি। ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা মেসিন চলার দরুন ঘরটা ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক।
১২. কফির শূন্য কাপটা নামিয়ে
মিনিট দশেক পরে কফির শূন্য কাপটা নামিয়ে রাখতেই কৃষ্ণা আবার প্রশ্ন করল, কোথায় গিয়েছিলে?
বল তো কোথায়?
মনে হয় সুভদ্রা-নিকেতনে!
বাঃ, চমৎকার কৃষ্ণা! তোমার দেখছি তৃতীয় নয়নটি রীতিমত খুলে গিয়েছে!
বাঃ, এত বড় একজন রহস্যভেদীর সঙ্গে এতকাল বাস করছি! কথায় বলে সাধুসঙ্গে স্বর্গবাস!
আর অসৎ সঙ্গে–বলতে বলতে কিরীটী হেসে ওঠে।
সত্যি বল না গো?
কি বলব?
আমার অনুমানটা কি মিথ্যে?
না, একেবারে মিথ্যে নয়। তবে—
তবে?
আর দুটো দিন অপেক্ষা কর দেবী, আশা করছি তারপরই হরিদাস সামন্ত হত্যারহস্যের উপরে যবনিকাপাত হয়ে যাবে। এখনও সামান্য বাকি, দুটি বা একটি দৃশ্য।
বিশ্বাস করি না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ কে হত্যাকারী!
সত্যের অপলাপ করা কর্তব্য নয়, তা বুঝতে পেরেছি বোধ হয়।
বোধ হয় না, বুঝতে তুমি পেরেছ ঠিকই।
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসে।
উঃ, তোমার পেট থেকে কথা বের করা না—ঠিক আছে, বলো না। তবে আমিও বুঝতে পেরেছি হত্যাকারী কে?
বুঝতে যদি পেরে থাক তবে আবার প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ কেন, দেবী?
মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম, আমার অনুমান ঠিক কিনা।
ঠিক আছে, তাহলে এস আমরা দুজনেই হত্যাকারীর নাম দুটো আলাদা আলাদা কাগজে লিখে আমার ড্রয়ারে রেখে দিই চাবি বন্ধ করে, তারপর চাবিটা
ঐ সময় জংলী এসে ঘরে ঢোকে শূন্য কফির কাপ দুটো নিয়ে যেতে।
কিরীটী জংলীর দিকে তাকিয়ে বললে, ড্রয়ারের চাবিটা থাকবে শ্রীমান জংলীর হেপাজতে। পরশু রাত ঠিক এগারোটা দশ মিনিটে চাবি নিয়ে কাগজ খুলে মিলিয়ে দেখা যাবে কার অনুমান সত্য। কেমন, রাজী?
রাজী।
জংলী হাঁ করে ওদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে কিছুক্ষণ পরে বলে, কি হল মাইজী!
কৃষ্ণা ততক্ষণে উঠে টেবিলের উপর থেকে দুটো কাগজ আর কলম এনে বললে, নাও, তুমি লেখো। আমিও লিখছি।
তথাস্তু দেবী।
জংলী তখনও বোকার মত ওদের দিকে তাকিয়ে।
দুজনের লেখা হলে, দুখানা কাগজ ভাঁজ করে চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে সে দুটো ড্রয়ারের মধ্যে ফেলে চাবি বন্ধ করে, ড্রয়ারের চাবিটা জংলীর হাতে দিয়ে কৃষ্ণা বললে, এই চাবিটা রাখ তোর কাছে জংলী।
কেন মাইজী?
যা বলছি—রাখ। আমি চাইলেও দিবি না, বাবু চাইলেও দিবি না, বুঝলি? ঘুষ দিলেও নয়।
জংলী বুঝতে পারে কোন একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। সে মিটিমিটি হাসতে হাসতে চাবিটা পকেটে রাখতে রাখতে বললে, ঠিক হ্যায় কিসিকো এ কুঞ্জী নেহী দুংগা।
.
পরের দিন সকালে চা-পানের পর কিরীটী যেন কার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে ফোনে।
কৃষ্ণা পাশেই সোফায় বসে একটা স্কার্ফ বুনছিল, কিরীটীর ফোন শেষ হলে বললে, সুব্রতর খবর কি বল তো?
কিরীটী একটা সোফায় বসে সামনের সুদৃশ্য একটি কাশ্মীরী কৌটো থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাতে ধরাতে বললে, মাসখানেক প্রায় দেখা নেই, তাই না!
হ্যাঁ ও যেন কেমন হয়ে গিয়েছে।
বিয়ে না করলে পুরুষমানুষ এমনই হয়ে যায়।
হঠাৎ ঐ সময় ঘরের ফোনটা বেজে উঠল। কিরীটী উঠে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিল।
মল্লিকের ফোন।
মণীশ কি করেছে শুনেছ!
কি? …তাই নাকি! ভালই তো। কিরীটী হাসতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে ফোন রেখে ফিরে এসে আবার বসল কৃষ্ণার মুখোমুখি। হ্যাঁ, কি যেন বলছিলে? বিয়ে না করলে কি হয়ে যায়, কৃষ্ণা—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, ঐ সময় দরজা ঠেলে সুব্রত ঘরে ঢুকল, মুখে স্মিত হাসি।
আরে তুই-তোর পায়ের শব্দ পাইনি তো! কিরীটী বললে।
তাহলে দেখছি মণীশ চক্রবর্তী ঠিকই বলেছে—সুব্রত হাসতে হাসতে মুখোমুখি বসে বললে।
মণীশ চক্রবর্তী?
হ্যাঁ, চন্দননগর থানার ও সি।
তুই চিনিস নাকি ওকে?
আমরা যখন বাঁকুড়া কলেজে পড়তাম তখন ও বাঁকুড়া স্কুলে পড়ত, দুর্ধর্ষ ফুটবল প্লেয়ার ছিল।
গোলকীপার বুঝি? কিরীটী স্মিতহাস্যে বলল।
ঠিক বলেছিস। কিন্তু বুঝলি কি করে? বলতে বলতে হেসে ওঠে সুব্রত।
হাসলি যে?
সুব্রত বললে, সেই দৃশ্যটা মনে পড়ল তোর কথায়।
কোন্ দৃশ্য?
কলেজের মাঠে খেলা হচ্ছিল, ও ছিল গোলকীপার। বরাবরই ওর চেহারাটা ছিল। কুমড়োপটাসের মত, সেই চেহারা আর সাতটা গোল খেয়েছিল, তাইতেই মনে আছে ওকে। তারপর বহুকাল পরে চন্দননগরে একটা সাহিত্য-সভায় ওর সঙ্গে পরিচয় হল। এখন আবার একজন কবি।
ফুটবল থেকে কবিতা—অসাধারণ উত্তরণ! এ যে আরও দুর্ধর্ষ ব্যাপার!
তাই—তবে মাঝখানটা বাদ দিলি কেন? দারোগা। গত মোল বছর। ভদ্রলোকের এক কথা এক কাজ। ঐ দারোগাগরিতেই আটকে আছে, এক ধাপও অগ্রসর হয়নি। ভদ্রলোক দেখলাম তোর উপরে ভীষণ খাপ্পা।
কেন? আমি আবার কি করলাম?
কি একটা যাত্রাদলের লোকের খুনের ব্যাপারে নাকি তুই তার উপরওয়ালার সাহায্যে নাক। গলিয়ে ব্যাপারটাকে প্রায় ভণ্ডুল করে দিতে বসেছিস?
কেন, সে তো এইমাত্র শুনলাম—
কি শুনলি?
ফোনে মল্লিক বললে, রাধারমণ পালকে নাকি সে অ্যারেস্ট করেছে, তার মতে সে-ই নাকি খুনী।
কিন্তু ব্যাপারটা কি? শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। সুব্রতর কণ্ঠে আগ্রহের সুর।
আমি ততক্ষণে স্নানটা সেরে আসি, তুই কৃষ্ণার কাছে সব শোন্।
কিরীটী উঠে গেল ঘর থেকে।
আধঘণ্টা পরে স্নান সেরে একবারে বেরুবার পোশাকে সজ্জিত হয়ে কিরীটী ঘরে এল।
কি রে, শুনলি?
শুনলাম, আর এও বুঝলাম মণীশ চক্রবর্তী আর একটা গোল খেয়ে বসে আছে।
বুঝলি কি করে? কৃষ্ণার সঙ্গে মত বিনিময় হল বুঝি? বলতে বলতে আড়চোখে কিরীটী স্ত্রীর দিকে তাকাল।
না, তোর গৃহিণী তো কবুল করল না কিছুতেই। সুব্রত হাসতে হাসতে বললে।
তাহলে তুই একটু বোস, আমি একটু ঘুরে আসি।
কতদূর যাবি? সুব্রত শুধায়।
বেশি দূর না–কাছাকাছি।
ঐ সময় ঘরের টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নেয়, কিরীটী রায়—
আমি মণীশ চক্রবর্তী কথা বলছি।
কি খবর বলুন? অ্যাঁ! কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে বোতলে কিছু পাওয়া যায়নি? গ্লাসে এবং স্টমাক কনটেন্টে বিষ পাওয়া গিয়েছে?
কি বিষ?…অ্যাট্রোপিন সালফেট? ঠিক আছে। হ্যাঁ, ভাল কথা—সন্ধ্যার দিকে একবার ফোন করবেন। কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল।
সুব্রত শুধাল, কি? অ্যাট্রোপিন সালফেট বিষ পাওয়া গিয়েছে?
হ্যাঁ, অ্যাট্রোপিনের লিথাল ডোজটা বোধ হয়—এক থেকে দুই গ্রেন–কৃষ্ণা, ঐ আলমারি থেকে ডাঃ ঘোষের ফারমাকোপিয়াটা বের কর তো, ঐ যে লাল মলাটের বইটা—একেবারে ডান দিকে শেষে, দ্বিতীয় থাকে—
কৃষ্ণা আলমারি থেকে বইটা বের করে এনে কিরীটীর হাতে দিল। কিছুক্ষণ ধরে পাতা উল্টে উল্টে এক জায়গায় এসে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। পড়তে লাগল।
একটু পরে বইটা বন্ধ করে কৃষ্ণার হাতে দিতে দিতে বললে, আশ্চর্য! লোকটা ঐ বিশেষ বিষটা যে এত দ্রুত এত অল্প ডোজে কার্যকরী, তা জানল কি করে?
কিরীটী পুনরায় বসে সোফার উপর, একটা সিগারেট ধরায়।
কৃষ্ণা, তোমাকে বলেছিলাম না দুদিন পরে মীমাংসা হবে?
হ্যাঁ!
তার আর দরকার হবে না বোধ হয়, মিসিং লিঙ্কটা পেয়ে গিয়েছি।
সত্যি!
বোস্ সুব্রত তুই, যাস নে। ঘণ্টা দেড়েক-দুয়েকের মধ্যে ঘুরে আসছি।
বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল, চললাম।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
১৩. কলিং বেলের শব্দে
কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দিয়ে সুভদ্রা যেন একটু অবাকই হয়, কিরীটীবাবু আপনি!
হ্যাঁ, একটা কথা গত সন্ধ্যায় জিজ্ঞাসা করা হয়নি। চলুন না ভিতরে।
আসুন। অনাসক্ত গলায় সুভদ্রা কিরীটীকে যেন আহ্বান জানালে।
গত রাত্রের সেই ঘর। শয্যাটা এলোমেলো হয়ে আছে এখনও। তখনও গুছিয়ে পাট করা হয়নি শয্যাটা।
কিরীটী একবার আড়চোখে শয্যাটা দেখে নিলে। শুনলাম শ্যামলবাবু যাত্রাদলের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন? কিরীটী কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুভদ্রার মুখের দিকে তাকাল।
তাই নাকি! শুনিনি তো–কে বললে?
শুনলাম। তাহলে আপনিও বোধ হয় ঐ দল থেকে চলে যাবেন?
না। তা কেন যাব?
যাবেন না! শ্যামলবাবু চলে যাবেন, অথচ আপনি—
তার যদি না পোয় তো সে চলে যাবে, আমি চাকরি ছাড়তে যাব কেন?
শ্যামলবাবু যদি আপত্তি করেন?
করবে না—আর করলেই বা!
তা আপনাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে?
বিয়ে?
হ্যাঁ, শ্যামলবাবুর আর আপনার?
হন্তদন্ত হয়ে ঐ সময় রাধারমণ পাল এসে ঘরে ঢুকল, সুভদ্রা, শুনেছ?
রাধারমণ পাল কিরীটীকে লক্ষ্য করেনি প্রথমটায়, কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ে গেল কিরীটীকে।
একটু থেমে, যেন থতমত খেয়ে বললে, কিরীটীবাবু, আপনি?
কি হয়েছে পাল মশাই? কিরীটী শান্ত গলায় প্রশ্ন করল।
সুজিতকে গতরাত্রে সে যখন বাড়ি ফিরছে, তার গলির মধ্যে কারা যেন পিছন থেকে ছোরা মেরেছে।
সে কি! একটা ভয়ার্ত স্বর যেন বের হয়ে এল সুভদ্রার কণ্ঠ থেকে।
রাতে কখন? কিরীটী আবার শান্ত গলায় প্রশ্ন করল, মানে রাত কটা হবে?
ও তো বলছে রাত প্রায় বারোটা সোয়া-বারোটা হবে।
সুজিতবাবু এখন কোথায়?
বাঙ্গুর হাসপাতালে—কেবল একটু আগে হাসপাতাল থেকে আমাকে অফিসে ফোন করেছিল।
কে?
সুজিত।
আঘাতটা খুব বেশি হয়েছে?
কিরীটী পুনরায় শান্ত গলায় প্রশ্ন করে।
না, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছে। বাঁ দিককার ঠিক কাঁধের নীচে নাকি হাতের উপর দিয়ে গিয়েছে।
এখন তিনি কোথায়?
তার বাসা কালীঘাটে। আমি তো সেখান থেকেই আসছি।
প্রাণের কোন আশঙ্কা নেই তো পাল মশাই? সুভদ্রা এতক্ষণে প্রশ্ন করে।
নাঃ, খুব বেঁচে গিয়েছে এযাত্রা। নেহাৎ বোধ হয় পরমায়ু ছিল। কিন্তু আমি ভাবছি সুভদ্রা, কে এভাবে আমাদের সর্বনাশ করছে! সেদিন সামন্ত মশাই গেলেন, কাল আবার সুজিতের প্রাণ নেওয়ার চেষ্টা—
পাল মশাই!
হঠাৎ কিরীটীর ডাকে রাধারমণ পাল ওর দিকে ফিরে তাকাল।
বলতে পারেন, হরিদাস সামন্তর কি চোখের অসুখ ছিল?
না তো। কেন?
না—আচ্ছা, আপনাদের দলের আর কেউ কি ইতিমধ্যে চোখের ব্যাপারে ভুগছিলেন?
কেন, আমিই তো কিছুদিন থেকে কষ্ট পাচ্ছি—চোখের ডাক্তার দেখছেন আমার চোখ, চন্দননগরে যেদিন পালা গাইতে যাই তার পরের দিনই বিকেলে ওষুধ লাগিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে আমার যাবার কথা ছিল।
গিয়েছিলেন?
না—দেখছেন তো কি ঝঞ্ঝাটের মধ্যে কটা দিন যাচ্ছে!
তা ঠিক। তা ডাক্তারটি কে?
ডাঃ চ্যাটার্জি, ধর্মতলার আই-স্পেশালিস্ট।
যে ওষুধটা লাগাবার কথা ছিল সে ওষুধটা তৈরী করানো হয়েছিল?
হ্যাঁ, এখনও আমার অফিস-ঘরেই বোধ হয় রয়েছে।
ফিরে গিয়ে অফিস-ঘরে ওষুধটা আছে কিনা আমাকে একবার জানাবেন—বাড়িতে আমায় ফোন করে আর ঘণ্টা তিনেক বাদে।
বেশ।
ভুলবেন না যেন। আচ্ছা আসি, নমস্কার।
কিরীটী আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী গৃহে ফিরে এল। সুব্রত তখন কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প করছিল।
সোফায় বসতে বসতে কিরীটী বললে, মিলে গেছে—দুয়ে দুয়ে চার।
হত্যাকারী তাহলে—
হ্যাঁ। সুব্রতর প্রশ্নের উত্তরে কিরীটী বললে, নিজের হাতেই নিজের মৃত্যুবাণ তুলে দিয়েছে আমার হাতে।
সুব্রত ও কৃষ্ণা দুজনেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
কিন্ত কোন প্রশ্ন করল না, কারণ ওরা তো জানেই—নিজে থেকে মুখ না খুললে ও-মুখ খোলানো যাবে না।
.
বিকেলের দিকে তিনটে নাগাদ রাধারমণ পালের ফোন এল কিরীটীর কাছে।
সংক্ষিপ্ত দু-চারটে কথা হল। তারপর কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল।
সুব্রত কিরীটীর বাড়িতে ছিল। যায়নি–কৃষ্ণা যেতে তাকে দেয়নি।
কৃষ্ণা, আর একপ্রস্থ চা হলে মন্দ হত না—সুব্রত বললে।
সুব্রতর কথায় কৃষ্ণা উঠে গেল ঘর থেকে।
সুব্রত বললে, চা খেয়ে এবারে যাব।
বোস না, ব্যস্ত কি!
কিরীটী তাকে থাকবার অনুরোধটা জানাল বটে, কিন্তু সুব্রতর মনে হয় কিরীটী যেন একটু অন্যমনস্ক—কেমন যেন ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা।
সুব্রত জানে কোন রহস্যের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছালে কিরীটী অমনি ভিতরে ভিতরে কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে।
কথা বলে কম এবং সংক্ষিপ্ত। বোঝা যায় ও যেন কথা বলতে চায় না।
কিরীটীর দিকে তাকাল সুব্রত। কিরীটী সোফার উপর হেলান দিয়ে বসে। মুখে জ্বলন্ত সিগার। ধূমপান করছে কি করবে বোঝবার উপায় নেই।
গ্রীষ্মের শেষ প্রহরের ম্লান আলো বাইরে। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে।
ওর বসবার ভঙ্গিতে নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন একটা প্রতীক্ষ্ণর ইঙ্গিত।
কিরীটী কি কারও জন্যে অপেক্ষা করছে? কিংবা কোন সংবাদের জন্য কান পেতে আছে যেন!
কৃষ্ণা জংলীর হাতে ট্রেতে চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার ঘরের কোণে টেলিফোনটা বেজে উঠল।
কিরীটী যেন একটু দ্রুত চঞ্চল পদবিক্ষেপেই এগিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল, কিরীটী রায়–কে, সুশান্তবাবু? বলুন, তারপর কৃষ্ণনগরে গিয়েছিলেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, মারা গেছে অনেক দিন আগে? হুঁ! ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল—ঠিক আছে, ঠিক আছে, ধন্যবাদ।
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চোখে-মুখে যেন একটা চাপা উত্তেজনা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।
রিসিভারটা নামিয়েই আবার তুলে নিয়ে ডায়েল করে কিরীটী, হ্যাঁ, হ্যাঁআমি কিরীট রায়-এ্যা, সব ব্যবস্থা করে রাখবেন, ঠিক রাত এগারোটায় যেমন বলেছি মিন্টু করবেন, হ্যাঁ, যেখানে বলেছি সেখানেই।
আবার ফোন নামিয়ে ডায়েল করল কিরীটী কাকে যেন, আমি কিরীটী রায় কথা বলছি যে দুটি ছেলেকে নজর রাখতে বলেছিলেন, তারা যেন এক মুহূর্তের জন্যও নজর না সরিয়ে নেয়। হ্যাঁ, ইনস্ট্রাকশন দিন—সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বাড়িতে ফোন করবে, আপনাকেও সংবাদটা দেবে।
কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে পুনরায় এসে সোফায় গা ঢেলে দিল।
কিরীটীর চোখে-মুখে দুপুর থেকে যে দুশ্চিন্তাটা প্রকট হয়ে উঠেছিল সেটা যেন আর অবশিষ্ট নেই।
মনে হচ্ছে শেষ দাবার চালটি যেন দিলি! সুব্রত বললে।
সূত্রগুলো সবই হাতের মধ্যে এসে গিয়েছে, একটা জায়গায় শুধু একটা ছোট্ট গিট, সেটা খুলতে পারলেই–
কিরীটীর কথা শেষ হল না, আবার ফোন বেজে উঠল।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা হাতে তুলে নিল, কিরীটী রায়। কে, পাল মশাই? তবে কি আপনি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন চন্দননগরে? নেননি—আপনার অফিস-ঘরেই ছিল? আমিও সেই রকমই অনুমান করেছিলাম। খুঁজে পাবেন না তাও জানতাম, কাল সকালে আসবেন।
কিরীটী রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল, তারপর কৃষ্ণার দিকে ফিরে বললে, কৃষ্ণা, আমি পাশের ল্যাবরেটরী ঘরে আছি। যে কোন সময় একটা ফোন আসতে পারে, এলে আমাকে ডেকো। সুব্রত, যাস না—হয়তো বেরুতে হতে পারে রাত্রে।
কিরীটী আর কোন কথা বললে না, ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
১৪. ফোন এল রাত দশটার কিছু পরে
ফোন এল রাত দশটার কিছু পরে।
কিরীটীকে ডাকতে হল না। সে সজাগ ছিল। তাড়াতাড়ি ঘরে এসে রিসিভারটরা তুলে নিল।
অন্য পক্ষ কি কথা বললে বোঝা গেল না ফোনের অপর প্রান্ত থেকে, কেবল কিরীটীর একটিমাত্র জবাব শোনা গেল, ঠিক আছে, মল্লিক সাহেবকে ফোন করে দিন।
রিসিভারটা নামিয়ে রেখে কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, খাবার হয়েছে কৃষ্ণা?
হ্যাঁ। দেব?
হ্যাঁ, আমাদের খাবার দিতে বল।
খাওয়া-দাওয়া সেরে আধঘণ্টার মধ্যেই দুজনে বেরুল।
হীরা সিং?
জী সাব!
শ্যামবাজার চল।
শ্যামবাজারে সুভদ্রার গৃহে পৌঁছতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগে না।
কিরীটী আর সুব্রত গলির মধ্যে ঢুকে দরজার কলিংবেলটা টিপল কিরীটী।
একটু পরেই দরজাটা খুলে গেল।
সুভদ্রাই দরজা খুলে দিয়েছিল, কিরীটীবাবু! এত রাত্রে, কি ব্যাপার?
চলুন ভিতরে, আপনাকে একটা সংবাদ দিতে এসেছি।
সুভদ্রা কিন্তু দরজা ছাড়ে না, কেমন যেন একটা ইতস্ততঃ ভাব।
আমি একটু ব্যস্ত আছি এখন কিরীটীবাবু।
জানি আপনি কি ব্যাপারে ব্যস্ত। কিন্তু আমার প্রয়োজনটা অনেক বেশি।
আপনি কাল আসবেন–বলতে বলতে সুভদ্রা কিরীটীর মুখের উপরই যেন দরজাটা বন্ধ করবার উপক্রম করে।
কিরীটী কিন্তু হাত দিয়ে দরজার পাল্লা দুটো ঠেলে শান্ত গলায় বললে, কোন লাভ হবে না সুভদ্রা দেবী। আপনার যত কাজই থাক এখন, এবং আপনি যত ব্যস্তই থাকুন, আমাকে ঘরে যেতে দিতেই হবে, আমার কথাও আপনাকে শুনতেই হবে।
কিন্তু আপনি কি জোর-জবরদস্তি করবেন নাকি?
সে রকম করবার কোন ইচ্ছা, বিশ্বাস করুন, সত্যিই আমার নেই, তবে আপনি যদি আমাকে বাধ্য করেন–
এটা আমার বাড়ি কিরীটীবাবু!
সুভদ্রার গলার স্বর তীক্ষ্ণ এবং কঠিন।
অবশ্যই, এবং সেটা না জানার তো কোন হেতু নেই। চলুন ভিতরে।
না।
সুভদ্রা দেবী, পুলিস আশপাশেই আছে, আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না আশা করি, তাদের সাহায্য আমি নিই!
পুলিস!
হ্যাঁ, চলুন ভিতরে।
সহসা সুভদ্রার কণ্ঠস্বরের যেন পরিবর্তন ঘটল।
সে বললে, আপনি পুলিস নিয়ে এসেছেন? কিন্তু কেন, কি করেছি আমি?
ভিতরে চলুন সব বলছি।
সুভদ্রা মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে যেন কি ভাবল। তারপর বললে, বেশ। আসুন।
বসবার ঘরেই বসাতে যাচ্ছিল সুভদ্রা কিরীটীকে, কিন্তু কিরীটী বললে, না, আপনার শোবার ঘরে চলুন।
শোবার ঘরে?
হ্যাঁ, চলুন।
ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখা গেল, সুভদ্রার শয্যার উপরে বসে আছে সুজিতকুমার, বুকে ও হাতে তার ব্যাণ্ডেজ বাঁধা।
নমস্কার সুজিতবাবু, চিনতে পারছেন?
হ্যাঁ, কিরীটীবাবু। সুজিত বললে।
ভালই হল সুজিতবাবু, আপনাকে কয়েকটা কথা আমার জিজ্ঞাসা করার ছিল, দেখা হয়ে গেল এখানেই, আপনার কালীঘাটের বাড়িতে আর ছুটতে হল না।
হ্যাঁ, আজ দুপুরে গিয়ে সুভদ্রা এখানে আমায় নিয়ে এসেছে।
ভালই করেছেন উনি, ওখানে তো সেবা করার মত কেউ আপনার ছিল না। কিরীটী বললে।
বসুন না কিরীটীবাবু, দাঁড়িয়ে কেন? সুজিত বললে।
আপনি তো বসতে বলছেন, সুভদ্রা দেবী তো ঢুকতেই দিচ্ছিলেন না বাড়িতে।
সে কি! কেন সুভদ্রা? সুজিত প্রশ্নটা করে সুভদ্রার মুখের দিকে তাকাল।
আপনার এ সময়ে এখানে উপস্থিতিটা হয়তো বাইরের লোক কেউ জানুক সুভদ্রা দেবীর ইচ্ছা ছিল না, তাই না কি সুভদ্রা দেবী?
কথাটা বলে আড়চোখে তাকাল কিরীটী সুভদ্রার দিকে।
সুভদ্রা চুপ। কোন কথা বলে না।
কিরীটী আবার বললে, যাক, একপক্ষে ভালই হল, দুজনের সঙ্গে একই জায়গায় দেখা হয়ে গেল। তারপর, কেমন আছেন? হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল?
হ্যাঁ। বললে ডাক্তাররা আঘাতটা অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যে নেহাত অপঘাতে মৃত্যু ছিল না বলেই হাসতে হাসতে বললে সুজিত।
হ্যাঁ, ভাগ্য নিশ্চয়ই বলতে হবে। তা কে পিছন থেকে আপনাকে আঘাত করল জানতেই পারলেন না? দেখতেও পেলেন না লোকটাকে সুজিতবাবু?
অন্ধকারে ছোরাটা মেরেই ছায়ার মত অন্ধকারে যেন মিলিয়ে গেল কিরীটীবাবু! তাছাড়া রক্তে তখন আমার সারা জামা ভিজে গিয়েছে, প্রায় ফেণ্ট হবার যোগাড়। ঐ অবস্থায় আততায়ীকে দেখবার মত অবস্থা কি থাকতে পারে!
তা সত্যি।
তা উনি—সুব্রতকে দেখিয়ে সুজিত বললে, ওঁকে তো চিনতে পারছি না!
উনি আমার এক ছোটবেলার বন্ধু, কৃষ্ণনগরে চাষাপাড়ায় ওঁর বাড়ি।
তাই নাকি!
হ্যাঁ, আপনারও কৃষ্ণনগরে ঐ পাড়াতেই বাড়ি সুজিতবাবু, তাই না? ভাল কথা, রঞ্জিত বিশ্বাসকে আপনি চেনেন?
রঞ্জিত বিশ্বাস! কে বলুন তো?
চিনতে পারছেন না, অথচ তিনি বলছিলেন, একসঙ্গে এক বছর আপনারা আর্ট স্কুলে পড়েছিলেন। কিরীটী বললে।
ও! হা হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা তাকে আপনি চেনেন নাকি?
চিনতাম না, তবে–
তবে?
সেদিন চেনা-পরিচয় হল, তাঁর কাছেই শুনছিলাম—
কি শুনেছেন?
আপনি ছোটবেলা থেকেই ভাল অভিনয় করতে পারতেন, শেষ পর্যন্ত তাই বোধ হয় আঁকার লাইন ছেড়ে অভিনয়ের লাইনটাই বেছে নিলেন।
হ্যাঁ, ও হল কমাশিয়াল আর্টিস্ট আর আমি হলাম অভিনেতা। তা রঞ্জিত বিশ্বাস এখন কোথায়? অনেক দিন তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না।
এবারে হয়তো হবে।
কলকাতায় থাকলে হবে বৈকি। কিন্তু আপনি একটু আগে যেন বলছিলেন আমাকে আপনার কি জিজ্ঞাসা করবার আছে?
হ্যাঁ, দুটো কথা।
কি বলুন তো?
দুর্ঘটনার রাত্রে—অর্থাৎ যে রাত্রে হরিদাস সামন্তকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়—মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে–
বলেন কি! সত্যি নাকি ব্যাপারটা?
১৫. ব্যাপারটা নিষ্ঠুর সত্য
হ্যাঁ সুজিতবাবু, ব্যাপারটা নিষ্ঠুর সত্য এবং সেটা কি বিষ জানেন—শান্ত গলায় কথাটা বলে কিরীটী পর্যায়ক্রমে সুজিত ও সুভদ্রার দিকে তাকাল।
কি বিষ? সুজিত প্রশ্ন করে।
কিরীটী পূর্ববৎ শান্ত গলায় বললে, অ্যাট্রোপিন সালফেট, যার থেকে দু গ্রেনেই অবধারিত মৃত্যু একজন মানুষের।
বলেন কি!
তাই এবং সে বিষ তাঁকে তাঁর মদের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু কে—কে তাকে মদের সঙ্গে বিষ দিতে পারে? ব্যাপারটা আত্মহত্যা নয় তো! Suicide!
না। শান্ত গলায় কঠিন না শব্দটা যেন উচ্চারিত হল কিরীটীর কণ্ঠ হতে, ব্যাপারটা আদৌ আত্মহত্যা নয়।
নয় কি করে জানলেন?
জেনেছি, এবং সে প্রমাণও আমার কাছে আছে। কথাটা বলে পুনরায় কিরীটী সুভদ্রার দিকে তাকাল।
সুভদ্রা যেন পাথর।
সে যেন কেমন অসহায় বোবা দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কিরীটীর দিকে।
সুভদ্রা দেবী, আপনি সম্ভবতঃ জানেন ব্যাপারটা, আপনিই বলুন না-হরিদাসবাবুকে মদের সঙ্গে বিষ কে দিতে পারে বা কার পক্ষে সম্ভব ছিল সে-রাত্রে?
আমি-আমি কি করে জানব?
কিন্তু আমার মনে হয় সুভদ্রা দেবী, ব্যাপারটা আপনি জানলেও জানতে পারেন।
আমি?
হ্যাঁ—বলুন সুভদ্রা দেবী, কে সে-রাত্রে সামন্ত মশাইয়ের মদের সঙ্গে বিষ দিতে পারে? কিরীটীর গলার স্বর তীক্ষ্ণ।
সুভদ্রা, সত্যি তুমি জান? প্রশ্ন করল এবার সুজিত।
না, না। বলুন সুভদ্রা দেবী,বলুন—কারণ, রাত সাড়ে দশটা এগারোটার মধ্যে অর্থাৎ তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে সে-রাত্রে আপনি হরিদাসবাবুর ঘরে দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন।
প্রমাণ–
হ্যাঁ, এই ভাঙা-বলতে বলতে পকেট থেকে সে-রাত্রে সাজঘরে কুড়িয়ে পাওয়া কাচের আয়না-বসানো চুড়ির টুকরোটা বের করে বললে, চুড়ির টুকরোটাই সে প্রমাণ দেবে, দেখুন তো, চিনতে পারছেন কি না, এই ভাঙা টুকরোটা যে চুড়ির সেটা সে-রাত্রে অভিনয়ের সময় আপনার হাতে ছিল—
সুভদ্রা বোবা।
এখন বলুন সুভদ্রা দেবী, দ্বিতীয়বার কেন আপনি আবার সে-ঘরে গিয়েছিলেন?
আ—আমি যাইনি। বিশ্বাস করুন—
গিয়েছিলেন। শান্ত কঠিন গলা কিরীটীর। বিষ মেশানো মদের বোতলটা সরিয়ে আনবার জন্য, তাই না?
আমি কিছু জানি না।
জানেন। বলুন সে বোতলটা কোথায়?
আমি জানি না–কিছু জানি না–বলতে বলতে সুভদ্রা সুজিতের দিকে তাকাল।
স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেন কি? আমার দিকে তাকিয়ে বলুন। কিরীটী আবার বললে।
কি বলছেন? উনি আমার স্বামী হতে যাবেন কেন? সুভদ্রা বলে ওঠে।
নন বুঝি! কিরীটীর কণ্ঠে যেন একটা চাপা ব্যঙ্গের স্বর, কি সুজিতবাবু, উনি আপনার স্ত্রী নন? অবিশ্যি এখনও জানি না বিবাহটা দশ বছর আগে আপনার কোন মতে হয়েছিল। হিন্দুমতে পুরুত ডেকে, না রেজিস্ট্রি করে, না শৈবমতে, না কেবল কালীঘাটে গিয়ে সিঁদুর ছুঁইয়ে—
কোন মতেই আমাদের বিবাহ হয়নি। কি সব পাগলের মত যা-তা বলছেন। সুজিত বলে ওঠে।
আমি পাগল, তাই না! এবারে বলুন সুভদ্রা দেবী, আপনার গলার হীরের লকেটটা কোথায় গেল? কিরীটী বললে।
লকেট! কিসের লকেট?
আপনার গলায় যে সরু হারটা আছে তার সঙ্গে একটা লকেট ছিল, লকেটটা কোথায়? সেই লকেটটা যে হরিদাসবাবুর হাতে গিয়ে পড়েছিল সেটা জানতে পেরেই বোধ হয় মরীয়া হয়ে উঠেছিলেন, যেহেতু বুঝেছিলেন আসল সত্যটা তাঁর কাছে ফাঁস হয়ে গেছে, তাই না? এতদিনের অভিনয়টা আপনাদের ধরা পড়ে গেছে তাই ভেবে মরীয়া হয়ে, না সুভদ্রা দেবী—উঁহু, কোমরে হাত দেবার চেষ্টা করবেন না। আমি জানি কোমরে দোক্তার কৌটোর মধ্যে দোক্তার সঙ্গে কি মেশানো আছে।
সুভদ্রা হাতটা কোমর থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হল।
সুব্রত, সুভদ্রা দেবীর কোমরে দোক্তার কৌটোটা গোঁজা আছে, ওটা নিয়ে নে।
সুব্রত এগিয়ে গিয়ে সুভদ্রার কোমরে গোঁজা দোক্তার ছোট্ট কৌটোটা ছিনিয়ে নিল।
আমি জানি সুভদ্রা দেবী, অবশ্যই অনুমানে নির্ভর করে, সুজিতবাবু আজ যদি আপনার গর্ভের সন্তানকে স্বীকৃতি না দিতেন তাহলে আপনি শেষ পথটাই নিতেন।
হঠাৎ হাঃ হাঃ করে সুজিত হেসে উঠে বললে, চমৎকার একটা নাটক রচনা করেছেন তো কিরাটীবাবু!
সত্যিই নাটকটা চমৎকার সুজিতবাবু, আপনার ভিলেনের রোলটিও অপূর্ব হয়েছে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। তবে জানেন তো, সব নাটকেই ভিলেনের শেষ পরিণতি হয় জেল, নয় ফাঁসি!
কিরীটীর কথা শেষ হল না, অকস্মাৎ যেন বাঘের মতই ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা ধারাল ছোরা কোমর থেকে টেনে নিয়ে সুজিত কিরীটীর উপরে।
কিন্তু কিরীটী অসতর্ক ছিল না, চকিতে সে সরে দাঁড়ায়।
সুজিত হুমড়ি খেয়ে দেওয়ালের উপর গিয়ে পড়ে গেল। সুব্রত সেই সুযোগটা হেলায় হারায় না, লাফিয়ে পড়ে সুজিতের উপর। সুজিতের সাধ্য ছিল না সুব্রতর শারীরিক বলের কাছে দাঁড়ায়। তাই সহজেই সুব্রত তাকে চিৎ করে ফেলে মাটিতে।
কিরীটী তার পকেটে যে বাঁশীটা ছিল তাতে সজোরে ফুঁ দিল।
মল্লিক সাহেব তাঁর দলবল নিয়ে প্রস্তুতই ছিলেন কিরীটীর পূর্ব নির্দেশ মত বাড়ির সামনে, সকলে ছুটে এল ঘরে।
.
পরের দিন সকালে দুই প্রস্থ চা হয়ে গিয়েছিল।
তৃতীয় প্রস্থের সঙ্গে কিরীটী, সুব্রত, মল্লিক সাহেব, মণীশ চক্রবর্তী ও কৃষ্ণা—কিরীটীর বাড়ির বসবার ঘরে হরিদাস সামন্তর মৃত্যুর ব্যাপারেই আলোচনা চলছিল।
আলোচনা ঠিক নয়।
একজন বক্তা। সে কিরীটী। এবং অন্য সকলে শ্রোতা। কিরীটী বলছিল : ব্যাপারটা সত্যিই একটা রীতিমত নাটক। এবং নাটকের শুরু নবকেতন যাত্রা পার্টিতে সুভদ্রার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এবং শেষ সুজিতের হাতে হাতকড়া পড়ার সঙ্গে।
সুভদ্রা তার মাসীর আশ্রয় থেকে পালিয়ে যখন যায় তখনই সুজিতের সঙ্গে তার সামান্য পরিচয়। সুজিত সুভদ্রাকে ঠিকমত আইনানুগভাবে কোনদিন বিবাহ করেছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু সুভদ্রার বোধ হয় তা সত্ত্বেও সুজিতের উপর একটা দুর্বলতা ছিল, আর সে দুর্বলতাটুকুর পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছিল শয়তান সুজিত।
সুজিতের চরিত্রে নানা দোষ ছিল, তার মধ্যে রেসের মাঠ ও জুয়া-অভিনয় সে ভালই করত, কিন্তু ঐ মারাত্মক নেশার দাস হওয়ায় তার সে প্রতিভা নষ্ট হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে চেহারাটাও খারাপ হয়ে যায় চারিত্রিক উচ্ছলতার জন্য। সে ক্রমশঃ পারফেক্ট ভিলেনে রূপান্তরিত হয়।
এদিকে সুভদ্রাও তাকে ছাড়বে না, সুজিতের পক্ষেও তার ভার বয়ে চলা সম্ভব নয়। তখন সুজিতই এক উপায় বের করল। সুভদ্রার অভিনয়ের নেশা ছিল, সে তাকে নিয়ে গিয়ে হাজির করল পাল মশাইয়ের কাছে। বেশ চলছিল এবং চলতও হয়তো দুজনের, কিন্তু মাঝখানে প্রৌঢ় হরিদাস সামন্ত পড়ে সব গোলমাল করে দিল।
হরিদাস সামন্তর লোভ পড়ল সুভদ্রার যৌবনের প্রতি। সে আকৃষ্ট হল এবং শয়তান সুজিত তখন দেখল ব্যাপারটায় তার লাভ বই ক্ষতি নয়। সে আর এক কৌশলে সুভদ্রাকে হরিদাস সামন্তর হাতে তুলে দিয়ে হরিদাসকে শোষণ শুরু করল।
হরিদাস টাকা যোগাতে লাগল, সুভদ্রার বোধ হয় ব্যাপারটা আগাগোড়াই পছন্দ হয়নি, সে অনন্যোপায় হয়ে শয়তান সুজিতের শাসানিতে হরিদাসের রক্ষিতা হয়ে রইল।
কয়েক বছর বেশ ঐভাবেই হয়তো চলছিল, তারপরই ব্যাপারটা হরিদাসের কাছে ফাঁস হয়ে গেল।
কিন্তু কেমন করে ফাঁস হল, সেটাও অবিশ্যি আমার অনুমান, হরিদাস সামন্ত হঠাৎ কোন এক সময় সুভদ্রার গলার হারের লকেটটা বোধ হয় পায়। সেই লকেটের মধ্যে ছিল সুভদ্রা ও সুজিতের যুগল ফটো। হরিদাস ব্যাপার বুঝতে পেরে (আমার অনুমান অবশ্য) সুভদ্রাকে তিরস্কার করে এবং টাকা দেওয়া বন্ধ করে। কারণ সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল সুভদ্রার হাত দিয়েই সুজিত তাকে শোষণ করে চলেছে।
সুজিত ব্যাপারটা জানতে পারল। এবং সে তখন হরিদাসকে নিশ্চয়ই শাসায়, প্রাণভয়ে ভীত হরিদাস তখন আমার কাছে ছুটে আসে। কিন্তু সব কথা স্পষ্ট করে বলতে সাহস পায় না।
তবে সব কথা না বললেও স্পষ্ট করে আভাসে যেটুকু বলে তাতে আমার বুঝতে কষ্ট হয় না, তার বিপদ যাত্রাদলের মধ্যেই।
সন্দেহটা আমার আরও ঘনীভূত হয় সুভদ্রা হরণ নাটকের বিষয়বস্তু শুনে। তবে একটা কথা এখানে অস্বীকার করব না, শ্যামলকেই প্রথমে নাটকের বিষয়বস্তু শোনার পর সন্দেহ করি, তাই আমি নাটকটা দেখতে যাই।
সুব্রত প্রশ্ন করে, কিন্তু সুজিতকে তুই সন্দেহ করলি কখন?
সুজিতকে ঠিক প্রথমটায় সন্দেহ করিনি—কিরীটী বলতে থাকে, এইমাত্র তো বললাম আমার প্রথম সন্দেহ পড়ে শ্যামল ও সুভদ্রার উপরে। তাদের উপরেই আমি নজর রেখেছিলাম। কিন্তু বিষ ও চুড়ির টুকরো আমার মনের চিন্তাধারাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করে।
হরিদাস সামন্তকে মদের সঙ্গে বিষ দেওয়া হয়েছিল, শ্যামল মদ্যপান করে না, কিন্তু সুজিত মদ্যপানে অভ্যস্থ ছিল—তাতেই মনে হয় আর যে-ই বিষ দিক না কেন মদের সঙ্গে মিশিয়ে, শ্যামল নয়, শ্যামল যদি বিষ না মিশিয়ে থাকে মদে তবে আর কে মেশাতে পারে—আর কে ঐ ব্যাপারে, অর্থাৎ হরিদাসকে পৃথিবী থেকে সরানোর ব্যাপারে interested থাকতে পারে।
প্রথমেই তারপর মনে হয়েছিল সুভদ্রার কথা। কিন্তু যে মুহূর্তে বুঝতে পারলাম সুভদ্রা অন্তঃসত্ত্বা, তখুনি বুঝলাম সুভদ্রা তাকে বিষ দেয়নি, তার গর্ভের সন্তানের জন্মদাতাকে সে বিষ দেবে না।
কিরীটী একটু থেমে আবার বলতে লাগল, হরিদাস সুজিতকে টাকা দেওয়া বন্ধ করায় হরত সুজিত তাকে চাপ দিচ্ছিল, অথচ নিজের জালে জড়িয়ে সুভদ্রারও আর টাকা দেবার জন্য হরিদাসকে অনুরোধ করবার উপায় ছিল না। এমন সময় হয়ত একটা কথা তার মনে হয়েছিল, হরিদাসকে যদি বোঝাতে পারে গর্ভের সন্তান হরিদাসেরই তখন হয়ত হরিদাস আবার সুজিতকে টাকা দিতে পারে, সুভদ্রার প্রতি সন্দেহটা যেতে পারে, তাই আমার মনে হয়েছিল সুভদ্রা হরিদাসকে বিষ দেয়নি।
কাজেই সুভদ্রা যদি বিষ না দিয়ে থাকে তবে আর কে হতে পারে! শ্যামলও নয়—তাছাড়া শ্যামল তো সুভদ্রার মন পেয়েছিলই—সে কেন তবে হরিদাসকে হত্যা করতে যাবে? তাহলে আর কেহঠাৎ তখন মনে পড়ল সুজিতের কথা। সুজিতই সুভদ্রাকে যাত্রার দলে এনেছিল। Then why not সুজিত?
ঐ পথেই তখন চিন্তা শুরু করলাম। মনে আরও সন্দেহ জাগল সুজিত সম্পর্কে, কারণ সে-ই বলেছিল সে-রাত্রের জবানবন্দীতে, সে নাকি সুভদ্রা ও শ্যামলকে হরিদাসের সাজঘরে সে-রাত্রে ঢুকতে দেখেছিল। মনে হল তবে কি ওদের উপরে সন্দেহ জাগানোর জন্যই সুজিত ওদের নাম করেছিল।
মনের মধ্যে কথাটা দানা বাঁধতে শুরু করল। তারপর ঐ চিরকুটটা—যেটা রাধারাণী ভোলাকে দিয়েছিল শ্যামলকে দিতে।
নাটকের পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় হরিদাসের হাতের নোটিস্ ছিল, সে লেখার সঙ্গে চিরকুটের লেখা যখন মিলল না, তখন বুঝতে বাকি রইল না চিরকুটটা জাল এবং শ্যামলকে ফাঁসানোর সেটা আর একটা ষড়যন্ত্র।
কার লেখা তবে চিরকুটটা! কে লিখতে পারে! শ্যামল নয়—তবে আর কে? আমার মনে হল, why not সুজিত?
সুজিতের উপরে সন্দেহটা আরও বেশি ঘনীভূত হওয়ায় তার সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করলাম। কৃষ্ণনগরে খোঁজ নিতেই বের হয়ে গেল সে এককালে এক বছর আর্ট স্কুলে পড়েছিল। বুঝলাম তখন সে-ই ঐ চিঠি লিখেছে হরিদাসের হাতের লেখা নকল করে। কিন্তু কেন? What was his motive?
নজর রাখলাম সুভদ্রা ও সুজিতের উপর। দেখা গেল সুজিত যাতায়াত করে সুভদ্রার ঘরে। তার ঘরের শয্যাও সেই সাক্ষ্যই দিয়েছিল।
সুজিত তখন আর একটা চাল চালল, একটা self-inflicted injury করে দেখাতে চাইল তাকে কেউ হত্যার চেষ্টা করেছে। হাসপাতালে attending ফিজিসিয়ানের রিপোর্ট থেকেই ব্যাপারটা প্রমাণিত হয়ে গেল, কেউ তাকে ছুরি মারেনি, তাহলে ঐ ধরনের injury হতে পারে না।
যে কুয়াশাটা সুজিতকে ঘিরে ছিল সেটা এবারে সুস্পষ্ট হয়ে গেল। এদিকে ওদের দুজনের উপর থেকে নজর কিন্তু আমি সরাইনি।
সুভদ্রা অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে বুঝতে পেরেছিল তাকে আমি সন্দেহ করেছি, সেটা অবিশ্যি তাকে আমি কিছুটা কথায়বাতায় বুঝিয়েও দিয়েছিলাম এবং অনুমান করেছিলাম ঐ কারণেই যে সে এবারে নিশ্চয়ই ছুটে যাবে সুজিতের কাছে।
অনুমান যে আমার মিথ্যা নয়, প্রমাণিত হয়ে গেল। সে ছুটে গেল। যে মুহূর্তে সংবাদ পেলাম, আমরাও সুজিতের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। অবশ্য সুজিত দুটো মারাত্মক ভুল করেছিল।
সুব্রত শুধায়, কি?
কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কিরীটী বললে, প্রথমতঃ সে অর্থাৎ সুজিত তার জবানবন্দিতে শ্যামলকুমার ও সুভদ্রার উপরে সকলের সন্দেহটা ফেলবার জন্য তাদের সে হরিদাস সামন্তর ঘরে ঢুকতে দেখেছিল কথাটা আমার কাছে বলে।
ব্যাপারটা আরও একটু স্পষ্ট করে বলি। আমি লক্ষ্য করেছিলাম তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দিকে, অর্থাৎ শুরুতে হরিদাস সামন্তর কিছুক্ষণ appearance ছিল—বোধ হয় মিনিট কুড়ির, তারপরই সে চলে আসে এবং সে সময় সুজিতের নাটকে কোন appearance ছিল না।
হিসাবমত সেটা রাত সোয়া দশটা থেকে সাড়ে দশটা। এবং আমার অনুমান সেটা কুড়ি মিনিট সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় সুজিত সবার অলক্ষ্যে হরিদাসের সাজঘরে ঢুকে যেহেতু everything was pre-arranged- পূর্ব-পরিকল্পিত, সে প্রস্তুতই ছিল, হরিদাসের মদের বোতলে বিষ মিশিয়ে দিয়ে আসে।
সুব্রত শুধায়, সে বিষটা তাহলে—
কিরীটী বললে, ঐ সাজঘরের মধ্যেই ছিল, রাধারমণের চোখের অসুখের জন্য ডাক্তার যে eye drop দিয়েছিল তার মধ্যেই অ্যাট্রোপিন সালফেট মারাত্মক বিষ ছিল।
বিষের শিশির সবটাই সুজিত হয়তো মদের বোতলে ঢেলে শিশির মধ্যে তার বোতল থেকে মদ ঢেলে রাখে, যেটা পরে chemical analysis-এও প্রমাণিত হয়েছে। আর সেই কারণেই সুজিতের বোতলে কোন অ্যাট্রোপিন বিষ পাওয়া যায়নি analysis-এ।
কিন্তু কথা হচ্ছে, ভুলটা কি? এবং কোথায়? সুভদ্রা নাটকের তৃতীয় অঙ্কের শুরুতে আসরেই ছিল—তাই তার পক্ষে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল না, অথচ সুজিত সেটা হিসাবের মধ্যে গণ্য করেনি। সে শ্যামলকুমারের সঙ্গে সুভদ্রার নাম করে একই ঢিলে দুই পাখি মারবার ফন্দিতে সুভদ্রার নামটা করেছিল! এবং সে হয়তো জানত না, হরিদাস সুভদ্রাকে টাকা দেবার জন্য তৃতীয় অঙ্কে সে যখন free থাকবে তখন তাকে একবার তার সাজঘরে যেতে বলেছিল।
সুজিত যদি ঐ মারাত্মক ভুলটা না করত, অর্থাৎ শ্যামলকুমারের সঙ্গে সুভদ্রারও নামটা আমাকে না জানাত তাহলে হয়তো তার গিল্টি কনসান্সটা অত সহজে আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠত না। সন্দেহের তার প্রতি শুরু আমার সেখান থেকেই।
মণীশ চক্রবর্তী বললেন, তবে সুজিতই হরিদাস সামন্তকে বিষ দিয়েছিল?
হ্যাঁ। কিরীটী বললে, সুজিত মিত্রই। তবে সুভদ্রা বোধ হয় সুজিতকে হরিদাস সামন্তর সাজঘর থেকে বেরুবার সময় দেখে ফেলেছিল। যে কারণে তার মনে তার প্রতি সন্দেহ জাগে।
কৃষ্ণা বললে, তবে সুভদ্রা সে কথা তোমাকে জানায়নি কেন তার জবানবন্দিতে?
কিরীটী বললে, ভুল তো তোমার সেইখানেই হয়েছে কৃষ্ণা।
ভুল! কৃষ্ণা স্বামীর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। তুমি ভুলে গিয়েছিলে যে সুজিতকে সুভদ্রা প্রথমদিকে ভালবাসলেও, সুজিত যখন অর্থের লোভে অনায়াসেই তাকে হরিদাস সামন্তর মত এক প্রৌঢ় কামুকের হাতে তুলে দিল সে ভালবাসার আর অবশিষ্ট মাত্রও ছিল না–থাকতে পারে না, নারীর মন সে ব্যাপারে বড় কঠিন। অথচ সুজিতের কবল থেকে মুক্তিরও তখন আর তার কোন উপায় ছিল না।
আশ্চর্য! একবারও আমার সে কথা মনে হয়নি।
কিরীটী বললে, জানি, আর সেই ভুলেই তোমার কাগজে হয়তো লিখে রেখেছ হত্যাকারী সুভদ্রা, তাই না?
হ্যাঁ।
কিরীটী হাসল।
কিরীটী আবার বলতে শুরু করল, যাক যা বলছিলাম, সুজিত যে মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিল সুভদ্রার মন শ্যামলকুমারের দিকে ঝুঁকেছে এবং পরস্পর পরস্পরকে ভালবেসেছে, সুভদ্রার গর্ভে হরিদাসের সন্তান থাকা সত্ত্বেও, তখনই সে স্থির করে তার plan of action—একই সঙ্গে শ্যামল ও সুভদ্রাকে সরাতে হবে। কারণ সে তো বুঝেছিলই—সুভদ্রা হরিদাসের কাছে না থাকলে তাকে দোহন আর চলবে না। শ্যামলকুমারকে দোহন করা সম্ভবপর হবে না।
মল্লিক সাহেব শুধালেন, তারপর? বলুন, থামলেন কেন মিঃ রায়? কিরীটী আবার বলতে লাগল, শ্যামল ও সুভদ্রা দুজনকেই একসঙ্গে কেমন করে ফাঁসানো যায় ভাবতে ভাবতেই হয়তো সুজিত ঐ পথটি বেছে নিয়েছিল and plan was succesful—কেউ ধরতে পারত না তাকে অত সহজে, যদি না সে আগ বাড়িয়ে ওদের দুজনের নাম করে বসত আমার কাছে।
আচ্ছা, একটা কথা—কৃষ্ণা বলে, সুভদ্রা কি কোনদিনই সুজিতকে ভালবাসেনি?
বাসেনি—তা তো বলিনি! তবে রমণীর মন তো—আর তার বদলের কারণও তো আগে কিছুটা বলেছি। এবং শেষে শ্যামলকুমারের আবিভাব রঙ্গমঞ্চে, যার প্রতি মন যে কোন নারীর সহজেই আকৃষ্ট হওয়া সম্ভব ছিল।
আচ্ছা, তোমার কি ধারণা কৃষ্ণা আবার প্রশ্ন করে, শ্যামল জানতে পেরেছিল সুভদ্রা মা হতে চলেছে?
সম্ভবতঃ জানতে পেরেছিল বা হয়তো সুভদ্রা ধরা পড়ে গিয়েছিল। তবে সেটা তো ওদের মিলনের ব্যাপারে আজকালকার দিনে কলকাতা শহরে অসংখ্য ব্যবস্থা থাকায় এমন কোন অন্তরায় হত না। তখন ঐ ধরনের কাঁটা অনায়াসেই তারা পরে দূর করে নিতে পারত।
থাক সে কথা। এবারে সুজিতের দ্বিতীয় ভুলের কথায় আসা যাক—What was his second mistake?
কিরীটী বলতে লাগল, সুজিত নিশ্চয়ই হরিদাসের সাজঘর থেকে বের হয়ে আসবার সময় সুভদ্রাকে লক্ষ্য করেছিল–কিন্তু সুভদ্রা যখন হরিদাসের ঘরে গিয়ে ঢোকে, হরিদাসের তখন already মৃত্যু হয়েছে—সে কথাটা সুজিত জানত, কারণ হরিদাস অভিনয় করার সময় ঘন ঘন মদ্যপান করত। আর সে-রাত্রে সুভদ্রার বর্ধমানে চলে যাবার কথা শুনে আরও নিশ্চয়ই মনটা তার বিক্ষিপ্ত ছিল, তাই হরিদাস আসর থেকে এসেই মদ্যপান করবে যেমন সে জানত, তেমনি এও সে জানত সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হবে।
কাজেই সুভদ্রা যখন টাকার জন্য হরিদাসের সাজঘরে ঢুকেছিল—তাকে follow করে সে ব্যাপারটা জানতে পেরেছে নিঃসন্দেহে—সুজিতের ঐ সময় সাজঘরে ঢোকাটাই দ্বিতীয় মারাত্মক ভুল।
দুজনে সাজঘরে মুখোমুখি হল। যা ছিল অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে-সুভদ্রার মনে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ঐ জন্যই পরে। তবে এর মধ্যে আর একটা ব্যাপার বোধ হয় ঘটেছিল। সুজিতকে বোধ হয় সুভদ্রা কিছু বলে, ফলে দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয় যে সময় সুভদ্রার হাতের চুড়ি একটা ভেঙে যায়। আর ঐ চুড়িরই ভগ্নাংশ প্রমাণ দেয় ঘরের মধ্যে মৃত্যুর ঠিক আগে বা পরে কোন এক সময় সুভদ্রা হরিদাসের ঘরে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করেছিল।
যা হোক, সুজিতের প্রতি আমার সন্দেহটা ক্রমশঃ দানা বেঁধে উঠল, আমি তার উপরে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করলাম। তার প্রতিটি movement-এর উপরে দৃষ্টি রাখা হল। জানা গেল সুজিতই সে রাত্রে-গিয়েছিল সুভদ্রার গৃহে হরিদাসের মৃত্যুর পর, শ্যামলকুমার নয়।
আর সুজিত যে যায় সেখানে, তার প্রমাণ সুভদ্রার ঘরে গিয়ে আমি স্বচক্ষে যাচাই করে এসেছি।
এদিকে শ্যামল দলে notice দিল সে দল ছেড়ে দেবে। বুঝলাম বা অনুমান করলাম, শ্যামলকুমার ও সুভদ্রা ওখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাবার ব্যবস্থা করেছে। সেই সঙ্গে এও মনে হল এ সুজিত নিশ্চয়ই তা হতে দেবে না।
হয়তো সুভদ্রাও সেটা বুঝতে পেরেছিল, আর তাইতেই সে বুঝতে পেরেছিল সুজিতের সঙ্গে তার একটা শেষ বোঝাপড়া করা দরকার। আর সেই বোঝাপড়ার জন্য তার তৃণে মোক্ষম তীরও রয়েছে—হরিদাসের সাজঘরে তার সে-রাত্রে যাবার ব্যাপারটা।
জানতাম সুভদ্রাকে সুজিতের ওখানে যেতেই হবে, বিশেষ করে সুজিত যখন নিজেকে। নিজে আঘাত করে বোঝাবার চেষ্টা করল সকলকে, তারlife-এর উপরেও attempt নেওয়া হয়েছে।
আমরা constant watch রাখলাম, সুভদ্রা গেল গত রাত্রে সুজিতের বাসায়। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও জানতে পারলাম। সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল, আমরাও বের হয়ে পড়লাম। বোঝাপড়া ওদের মধ্যে কতদূর হয়েছিল জানি না, তবে দুজনেই অকস্মাৎ আমাদের আবির্ভাবে থতমত খেয়ে গেল, ওদের মুখের চেহারা, ওদের হাবভাব স্পষ্ট জানিয়ে দিল দোষী কে?
খুনী কে আর একবার অত্যন্ত স্পষ্ট করে বুঝলাম আবারও—আমার অনুমান মিথ্যা নয়।
তবে হ্যাঁ, এও বলব, সুজিত মিত্র একজন অতীব দক্ষ অভিনেতাই কেবল নয়, নার্ভও তেমনি শক্ত তার এবং আমরা সেখানে ঐ সময়ে গিয়ে উপস্থিত না হলে সুজিতের কোমরে লুকানো ছোরার আঘাতেই সুভদ্রাকেও হয়তো সে-রাত্রে প্রাণ দিতে হত শেষ পর্যন্ত।
এই হচ্ছে মোটামুটি কাহিনী।
কিরীটী থামল।
হাত বাড়িয়ে চুরোটের বাক্স থেকে একটা চুরোট ও লাইটারটা হাতে তুলে নিল।
সুব্রত বললে, কৃষ্ণা, চা।
কৃষ্ণা উঠে গেল।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ওরা—সুভদ্রা ও শ্যামল স্থির করেছিল চলে যাবে এবং নাটকের শেষ দৃশ্যেও ছিল সুভদ্রাকে হরণ করে নায়ক পালাবে, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠবে না—সুভদ্রাকে আর হরণ করা হবে না নায়কের, যেমন শ্যামলকুমারেরও আর সুভদ্রাকে নিয়ে চলে যাওয়া হল না। রূপক নাটক শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুর সত্যে পরিণত হল।