আপনি তবে রায়মশাই ঐ ব্যাপারেই—
হ্যাঁ, কলকাতা থেকে অনুসন্ধান শুরু করে এখানে এসেছি।
সমস্ত ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছে করছে রায়মশাই।
পুলিশের খাতায় যা লেখা আছে তা হচ্ছে, তিন বছর আগে ক্ষিতীন্দ্রবাবু ঝগড়াঝাঁটি করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন, এই পর্যন্ত সত্যি, কিন্তু তারপর–
তারপর?
যে ক্ষিতীন্দ্রবাবু এখানে এসে এই হোটেলে ওঠেন, তিনি আদৌ ক্ষিতীন্দ্রবাবু নন, কোন তৃতীয় ব্যক্তি। এখন কথা হচ্ছে, কোন তৃতীয় ব্যক্তি কেন ক্ষিতীন্দ্রবাবুর পরিচয়ে এখানে এসে উঠলেন, তার পিছনে কি উদ্দেশ্য ছিল? আর সেই সময় আসল ক্ষিতীন্দ্রবাবুই বা কোথায় ছিলেন?
দেবেশ বললেন, এবং আত্মহত্যাও করলেন—
না, কেউ তাঁকে হত্যা করেছিল
কে সে? আপনি বলছেন মিঃ রায়, ক্ষিতীন্দ্রবাবুর পরিচয়ে যিনি এখানে এসে উঠেছিলেন। তিনি আদৌ আত্মহত্যা করেননিতাকে হত্যা করা হয়েছিল?
হ্যাঁ।
কিন্তু—কে তাকে হত্যা করল আর কেনই বা হত্যা করেছিল?
হয়ত ক্ষিতীন্দ্রবাবুই তাকে হত্যা করেছিলেন, না হয় অন্য কেউ।
বলেন কি!
বলছি তো সবটাই আমার একটা অনুমান মাত্র। যাক সে কথা, ঘটনাটা মনে করুন। হোটেলের ১৭নং ঘরে সকালে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। পুলিস এল, তারা যতটুকু অনুসন্ধান করবার করল। জামসেদপুরে তার স্ত্রী মালতী দেবীকে সংবাদ দেওয়া হল। তিনি এলেন সনাক্ত করলেন তার স্বামী বলেই, কিন্তু সকার না করেই চলে গেলেন।
হ্যাঁ।
কিন্তু এর মধ্যে একটা কথা আছে দেবেশবাবু–
কি, বলুন?
যাঁকে হত্যা করা হয়েছিল তিনি আমার অনুমান আগেই বলেছি আসল ক্ষিতীন্দ্রবাবু নন, তাহলে সত্যিকারের ক্ষিতীন্দ্রবাবুর জামসেদপুরের ঠিকানা পুলিশ কেমন করে কোথা থেকে পেল!
সত্যিই তো।
রহস্যটা ঐখানেই জট পাকিয়ে আছে।
কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, এত দিন পরে হঠাৎ তার মনে সন্দেহ জাগল কেন যে যাঁকে তিন বছর আগে তিনি তার স্বামী বলে সনাক্ত করেছিলেন তিনি তার স্বামী নন? দেবেশ বললেন।
আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো, অনুসন্ধান তিনি আবার করতেন না কখনও যদি না মোটা টাকার একটা ফিক্স ডিপোজিটের ব্যাপারটা অকস্মাৎ জটিল হয়ে উঠত। ক্ষিতীন্দ্রবাবুর পঁচাত্তর হাজার টাকার একটা ফিক্স ডিপোজিট ছিল জামসেদপুরে টিসকোর অ্যাকাউন্টে যে টাকাটা রিটায়ার করবার পর ক্ষিতীন্দ্র পেয়েছিলেন, ঐ পঁচাত্তর হাজার তারই একটা অংশ— ফিক্স ডিপোজিট করে রেখেছিলেন কোম্পানিতে পাঁচ বছরের মেয়াদে মোটা সুদে। কিরীটী বলতে লাগল, কিছুদিন আগে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ায় মালতী দেবী টাকাটা তোলার যখন ব্যবস্থা করছেন একটা চিঠি এল তাঁর নামে!
চিঠি!
হ্যাঁ।
কার কাছ থেকে চিঠি এল?
ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম সইকরা চিঠি। সেই চিঠিতে লেখা ছিল—আমি মরিনি। ঐ ফিক্স ডিপোজিটের টাকা তুলবার চেষ্টা কোরো না, তাহলে আমি জানিয়ে দেব পুলিসকে যে পুরীতে গিয়ে অন্য এক ব্যক্তির মৃতদেহ তোমার স্বামীর বলে মিথ্যা সনাক্ত করে এসেছ। ইতি ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
কি সর্বনাশ!
কাজেই বুঝতে পারছেন, মালতী দেবীর অবস্থাটা। টাকা তোলার আর চেষ্টা করলেন না। প্রথমে নানাভাবে স্বামীর অনুসন্ধান করলেন, কিন্তু কোন কিছুর হদিস করতে পারলেন না। তাঁর তখন মনে একটা জেদ চেপে গিয়েছে—যে ভাবেই হোক সত্য ব্যাপারটা তাঁকে জানতেই হবে। তিনি সোজা চলে গেলেন তখন তাদের পূর্ব-পরিচিত একটা রিটায়ার্ড পুলিস কমিশনারের কাছে। তিনি সব শুনে মালতী দেবীকে আমার কাছে আসতে পরামর্শ দিলেন। সব শুনে কিরীটী বলতে লাগল, আমার মনে হল বিচিত্র একটা রহস্য ব্যাপারটার মধ্যে জড়িয়ে আছে!
কবে এসেছিলেন তিনি আপনার কাছে? দেবেশ শুধাল।
তা দিন-কুড়ি আগে হবে।
০৩. কলকাতা শহরে তখন প্রচণ্ড তাপদাহ
কলকাতা শহরে তখন প্রচণ্ড তাপদাহ চলেছে কয়েক দিন ধরে একটানা। জুনের সেটা গোড়ার দিক। আটত্রিশ থেকে চল্লিশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। সকাল যেন দেখতে দেখতে গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়।
দুপুরের দিকে যেন পশ্চিমের মত লু চলে, রাস্তায় বেরুলে হাত পা মুখ ঝলসে যায়। কিরীটীর বাড়ির কলিং বেলটা ডিং ডিং শব্দে বেজে উঠল।
জংলীই এসে দরজাটা খুলে দিল। সামনে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি একটা, এক ভদ্রমহিলা নামছেন ট্যাক্সি থেকে। পরনে সরু কালোপাড় একটা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা টানা। দুহাতে তিনগাছা করে ক্ষয়ে যাওয়া সোনার চুড়ি, মাথায় বা সিঁথিতে সিঁদুর নেই। বয়স হয়েছে আগন্তুক ভদ্রমহিলার, তিপান্ন থেকে চুয়ান্ন হবে। কিরীটীর সঙ্গে দেখা করতে চায় শুনে জংলী তো প্রথমটায় কিছুতেই সম্মত হয় না। বলে, না, এখন দেখা হবে না।
মহিলা কাকুতিমিনতি করতে থাকেন। বিশেষ প্রয়োজনে এসেছেন, একটিবার তাকে দেখা করতেই হবে। জংলী অনিচ্ছাসত্ত্বেও মহিলাকে বাইরের ঘরে এনে বসাল।
কিরীটী জেগেই ছিল তার মেজোনিন ফ্লোরের বসবার ঘরে। ডিভানে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। জংলী এসে ঘরে ঢুকল।
বাবু!
কি রে?
একজন মেয়েছেলে এসেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
এই দুপুরের প্রচণ্ড রৌদ্রে কেউ যে দেখা করতে আসতে পারে, বিশেষ কোন প্রয়োজন না থাকলে বুঝতে পারে কিরীটী, তাই জংলীকে ঐ ঘরেই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আসতে বলল।
ভদ্রমহিলা ঢুকতেই কিরীটী তার আপাদমস্তকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। তার বুঝতে কষ্ট হয় না, এখন বয়স হলেও আগন্তুক মহিলা যৌবনে মোটামুটি দেখতে সুন্দরীই ছিলেন। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, সামান্য লম্বাটে ধরনের মুখের গঠন, চোখেমুখে বয়সের ছাপ অনিবার্য ভাবেই পড়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চেহারার প্রতি যে তার একটা সযত্ন প্রয়াস আছে সেটা ওর দিকে তাকালেই বোঝা যায়।