উনচল্লিশ-চল্লিশ হবে হয়ত।
মাথার সামনের দিকে টাক আছে?
আছে—চেনেন নাকি ভদ্রলোককে মিঃ রায়!
না, ঠিক চিনি না।
তবে এত কথা বলছেন কি করে?
কিরীটী পকেট থেকে একটা খাম বের করে খাম থেকে একটা ফটো বের করে বললে, দেখুন তো দেবেশবাবু, এই ভদ্রলোক কি?
দেখি। হ্যাঁ এই তো দেবেশ বললেন।
আপনি–
দেবেশের কথা শেষ হল না, সলিল দত্ত মজুমদারকে দেখা গেল তার অফিস ঘরে ঢুকতে। দত্ত মজুমদার ঘরে ঢুকে সোজা দেবেশের দিকেই এগিয়ে গেলেন। পার্শ্বে উপবিষ্ট কিরীটীর দিকে তাকালেনও না।
দেবেশ বললেন, কিছু বলছিলেন মিঃ দত্ত মজুমদার?
হ্যাঁ, আজ বিকেলের দিকে আমাকে একবার ভুবনেশ্বর যেতে হবে। ট্রেনে যাব না, একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা হতে পারে কি?
কেন হবে না। আমার জানাশোনা একটা ট্যাক্সি আছে, যদি ভাড়ায় না গিয়ে থাকে—এখুনি খবর পাঠাচ্ছি। তা কখন যেতে চান?
বেলা পাঁচটা নাগাদ বেরুব ভাবছি।
আপনার স্ত্রীও যাবেন তত আপনার সঙ্গে?
না, সে থাকবে। আমি তো আবার কালই ফিরে আসছি। আপনি তাহলে খবরটা পাঠান, আমি আমার ঘরেই আছি। দত্ত মজুমদার চলে গেলেন।
কিরীটী বললে, এই ভদ্রলোক?
হ্যাঁ–দেবেশ বললেন।
তাহলে দেবেশবাবু ১৭নং ঘরটা খুলে দেবার ব্যবস্থা করুন।
হোটেলের চাকর ও ঝিকে ডেকে পাঠালেন দেবেশ।
গোপী সামনে এসে দাঁড়াল।
গোপী, ১৭নং ঘরটা খুলে দাও—
কাঁই কি বাবু, কঁড় হব?
এই বাবু থাকবেন—
কথাটা শুনে মনে হল গোপী যেন বেশ একটু বিস্মিত হয়েছে। সে প্রথমে দেবেশের মুখের দিকে তাকাল, তারপর কিরীটীর মুখের দিকে এবং মৃদুকণ্ঠে বললে, সে বাবু ১৭নং কামরাতে
রহিব?
জবাব দিল কিরীটী, হ্যাঁ গোপী, ঐ ঘরেই আমি থাকব, ভূতের ভয় আমার নেই। তুমি ঘরটা পরিষ্কার করে দাও।
গোপী বললে, সে গত বছরে আগের বাবুরও ভূতের ভয় ছিল না বলে ঐ ঘরে। থেকেছিলেন, কিন্তু মাঝরাত্রে সিঁড়ির কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
ভয় নেই, তোমার গোপী, আমি অজ্ঞান হব না। তুমি ব্যবস্থা কর।
দেবেশ ঘরের চাবিটা গোপীর হাতে তুলে দিলেন।
গোপী যেন কিছুটা অনিচ্ছার সঙ্গেই চাবি নিয়ে চলে গেল।
আচ্ছা দেবেশবাবু, ১৭নং ঘরে যে আত্মহত্যার কথা একটু আগে বলছিলেন, সেটা কতদিন। আগেকার ব্যাপার?
তা বৎসর তিনেক হবে, ঠিক এমনি এক জুলাই মাসে। হোটেলের প্রত্যেকটি ঘরে যাত্রীসে যে কী হুজ্জত কিরীটীবাবু, ভদ্রলোক আত্মহত্যা করলেন, তারপর থানা-পুলিস। ভদ্রলোক নাকি এসেছিলেন জামসেদপুর থেকে। টিসকোতে কাজ করতেন, রিটায়ার করার পর পুরীতে বেড়াতে এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। বয়স হয়েছিল—তা প্রায় বাষট্টি-তেষট্টি। একাই এসেছিলেন। পরে জানতে পেরেছিলাম সংসারে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা আছে কিন্তু কারও সঙ্গেই ভদ্রলোকের বনিবনা হত না।
কেন—বনিবনা হত না কেন?
ভদ্রলোকের নিজের স্বভাবেরই জন্য নাকি সংসারের কারও সঙ্গে বনত না।
তা কেন হঠাৎ এখানে এসে আত্মহত্যা করলেন, কিছু জানা গিয়েছিল?
না। তবে তার স্ত্রী বলেছিলেন, বাড়ি থেকে নাকি ঝগড়া করে চলে এসেছিলেন। পুরীতে যে এসেছেন তাও তিনি জানতেন না। আসার সময় কিছু বলেও আসেননি কাউকে না বলেকয়ে হঠাৎ চলে এসেছিলেন।
আর কিছু জানা যায় নি—ঐ পারিবারিক কলহ ছাড়া?
না।
কোন চিঠিপত্র রেখে গিয়েছিলেন।
না। কোন চিঠি বা লেখা-টেখা কিছুই ঘরে পাওয়া যায়নি।
ভদ্রলোকের নামটা আপনার মনে আছে দেবেশবাবু?
মনে আছে বৈকি-ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নামটা আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে।
আচ্ছা দেবেশবাবু, ভদ্রলোকের মাথায় বেশ বড় একটা টাক ছিল কি?
কই না তো, বরং মনে আছে আমার, ঘন চুলই ছিল ভদ্রলোকের মাথায়।
খুব বড় বড় কথা বলতেন কি? এবং রীতিমত ভোজনপটু ছিলেন?
হ্যাঁ। যে কদিন ছিলেন তা প্রায় দুজনের মিল একাই খেতেন। অবিশ্যি তার জন্য এক্সট্রা চার্জ দিতে চেয়েছিলেন—
খুব দরাজ গলায় যখন-তখন হাসতেন কি?
অতশত মনে নেই। তা ভদ্রলোক সম্পর্কে এত কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন বলুন তো রায়মশাই? আপনি ভদ্রলোকটিকে চিনতেন নাকি?
দেবেশের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিরীটী বললে, সেটাই তো যাচাই করছি!
কি ব্যাপার? দেবেশ অধিকারীর কণ্ঠস্বরে রীতিমত আগ্রহ প্রকাশ পায়।
ভদ্রলোক নামের সঙ্গে যে পদবীটা এখানকার খাতায় লিখিয়েছিলেন তা সত্য নয়—কিরীটী বললে।
সে কি রায়মশাই! কিন্তু তাঁর স্ত্রী যিনি এসেছিলেন এখানে পরে—
তিনিও তার স্ত্রী নন।
এসব কি বলছেন রায়মশাই। তাই বোধ হয় ডেড বডির সৎকার না করেই ভদ্রমহিলা চলে গিয়েছিলেন! এখন বুঝতে পারছি
২৯শে জুলাই ঘটনাটি ঘটেছিল এই হোটেলে, তাই তো?
হয়ত তাই হবে, জুলাই মাস আপনাকে তো আগেই বললাম, তবে তারিখটা–
২৯শে জুলাই এবং ২৮শে জুলাই এখানে সেরাত্রে খুব একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। ফলে তাপাঙ্ক নেমে যায় কিরীটী বললে।
কিন্তু কি ব্যাপার রায়মশাই? দেবেশ প্রশ্ন করলেন।
আরও একটা কথা আছে দেবেশবাবু। কি কথা বলুন তো?
দেবেশ ওর মুখের দিকে তাকালেন।
আমার মনে হয়, কিরীটী বললে, তিনি আত্মহত্যা করেননি, তাকে হত্যা করা হয়েছিল। এবং তিনি আদৌ জামসেদপুর থেকে আসেননি, এসেছিলেন কলকাতা থেকে। আর তার আসল . পরিচয় ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নয়।
এসব কি বলছেন রায়মশাই!
আমার অনুমানের কথাটাই আপনাকে বলছি।
কিন্তু পুলিস—পুলিস কি কিছুই জানতে পারেনি?
কিরীটী বললে, জানতে পারত নিশ্চয়ই, যদি ভাল করে লোকটা সম্পর্কে খোঁজখবর করত। ব্যাপারটা এক ভদ্রলোকের, যিনি এখানকার হোটেলে এসে উঠেছিলেন, তাই কেসটা আত্মহত্যা বলে হাত ধুয়ে ফেলেছিল পুলিস। এবং পুলিসের ফাইলে আত্মহত্যাই থেকে যেত, যদি না বছরতিনেক পরে হঠাৎ ক্ষিতীন্দ্রবাবুর স্ত্রী মালতী দেবী তার তিন বছর নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর খোঁজখবর শুরু করতেন এবং শেষ পর্যন্ত আমার দ্বারস্থ হতেন। আর কিছু ছিন্ন সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালাতে চালাতে আমি এখানে এসে না উপস্থিত হতাম!