সরিৎশেখর দুপা এগিয়েও যায় দরজাটার দিকে, কিন্তু আবার থেমে যায়।
মনে পড়ল একটু আগে সলিল দত্ত মজুমদারের কথাগুলো। এবং সলিল দত্ত মজুমদারের কথা ভেবেই ইচ্ছাটাকে দমন করল। অনুরাধার সঙ্গে তাকে দেখলে সলিলের মেজাজটা হয়ত আবার বিগড়ে যাবে। কি প্রয়োজন তার ওদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে মাথা গলানোর। ও আজ সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি, একান্ত ভাবেই অনভিপ্রেত। কিন্তু যতই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাব না মনে করুক সরিৎশেখর, অনুরাধার চিন্তাটা যেন মন থেকে কিছুতেই দূর করতে পারে না। ঘুরে-ফিরে কেবলই যেন অনুরাধা তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
ঐ সলিল দত্ত মজুমদারের সঙ্গে সম্পর্কটা কি অনুরাধার? যেভাবে সলিল দত্ত মজুমদার কথা বলছিল, তার মধ্যে একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার সুর স্পষ্ট ছিল। কি সে অধিকার? আর সেই অধিকার সলিল দত্ত মজুমদার কেমন করে অর্জন করল? একটার পর একটা সিগ্রেট পুড়তে থাকে।
দরজার ওদিকে পদশব্দ শোনা গেল আবার একসময়।
ভিতরে আসতে পারি?
গলার স্বর থেকে মানুষটাকে চিনতে সরিতের অসুবিধা হয় না, সলিল দত্ত মজুমদার। সরিৎ বললে, আসুন।
সলিল দত্ত মজুমদার এসে ঘরে ঢুকলেন। একবার ভাল করে তাকাল সরিৎ। ভদ্রলোকের দিকে—আটত্রিশ-উনচল্লিশ বৎসর বয়স মনে হয় ভদ্রলোকের। সামনের দিকে মাথায় বিস্তৃত টাক, পাশ থেকে চুল টেনে এনে সযত্নে ঢাকা দেওয়া হয়েছে। চোখে চশমা, দামী ফ্রেমের চশমা। সকালবেলার সেই পোশাকই পরিধানে।
বসুন মিঃ দত্ত, সরিৎ বললে। আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে এলাম ডঃ সেন আমাকে! কি কথা?
আমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে আপনার সঙ্গে আলাপ ছিল অনুরাধার জানতাম। এবং আপনাদের পরস্পরের মধ্যে যে রীতিমত একটা ঘনিষ্ঠতা একসময় হয়েছিল তাও আমার জানা।
কতটুকু আপনি জানেন বা শুনেছেন আমি জানি না সলিলবাবু, তবে এমন কিছু ছিল না যা মনে রাখার মত।
কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম, বেশ একটু—
সেসব অনেক দিন চুকেবুকে গিয়েছে, আপনি যা বলতে এসেছেন তাই বলুন—
জানেন কি, ও একটা জঘন্য চরিত্রের মেয়েমানুষ—
এই কথাটাই কি বলতে এসেছেন?
হ্যাঁ। আমি ঠকেছি বলেই আপনাকে সাবধান করে দিতে এলাম।
ধন্যবাদ।
আমার আর একটা কথা আপনার জানা বোধ হয় দরকার ডঃ সেন। ওকে আমি বিয়ে করেছি—She is my wife!
বিয়ে করলে তো উনি স্ত্রীই হবেন, তার মধ্যে নতুনত্বের কি আছে?
মনে হচ্ছে আপনি যেন আমার কথাটা বিশ্বাস করলেন না ডঃ সেন!
কেন–বিশ্বাস করব না কেন?
তাই বলছিলাম একদিন ওর সঙ্গে আপনার যে সম্পর্কই থাক, ও আজ পরস্ত্রী।
কথাটা কেন বলছেন বুঝতে পারলাম না–
পারবেন, একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন। আচ্ছা চলিসলিল দত্ত মজুমদার যেমন হঠাৎ ঘরে এসে ঢুকেছিলেন তেমনিই হঠাৎ ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
০২. হোটেলের ম্যানেজার-প্রোপ্রাইটার
হোটেলের ম্যানেজার-প্রোপ্রাইটার দেবেশ অধিকারীর সঙ্গে তার ঘরে বসে কিরীটীর কথা
হচ্ছিল।
কিরীটীর বয়স হয়েছে, মাথার চুলে পাক ধরেছে।
দেবেশ বলছিলেন, সত্যি বলতে কি এবারে কিন্তু আপনাকে দেখে প্রথমটায় ভাল চিনতে পারিনি।
কিরীটী হেসে বললে, কেন, বয়েস হলেও আমার চেহারাটা তো খুব একটা পালটায়নি!
তা প্রায় বছর পাঁচেক বাদে এখানে এলেন, তাই না? দেবেশ বললেন।
পাঁচ বছর! বোধ হয় ঐ রকমই হবে—
তা কটা দিন থাকছেন তো পুরীতে?
থাকব বলেই তো এসেছিলাম, কিন্তু ১৮নং ঘরটা তো কে একজন দখল করে আছে দেখছি
হ্যাঁ সরিৎবাবু এসেছেন। উনি এখানে প্রায়ই আসেন, আর এলে ঐ ১৮নং ঘরেই ওঠেন। অবিশ্যি আপনি আসছেন জানতে পারলে ঘরটা ওঁকে দিতাম না। ১৫নং ঘরটা খালি আছে—দুদিক খোলা, প্রচুর হাওয়া পাবেন। ঘরটা দেখবেন?
না, ও ঘরেই আমার ব্যবস্থা করুন।
তা করছি। নিশ্চয়ই কোন কাজে এসেছেন কিরীটীবাবু, তাই না?
না, সেরকম কিছু না। তবে একটা অনুরোধ, আমি যে এসেছি যেন জানাজানি হয়।
সে কি আর চাপা থাকবে?
যতটা চেপে রাখা যায়।
দেবেশ অধিকারী বললেন, তা বলছেন যখন আমি কাউকে বলব না। তবে আপনি যে কেবলমাত্র সমুদ্রের হাওয়া খেতেই আসেননি তা আমি জানি।
সে কথা যাক, কিরীটী বললে, দোতলায় বুঝি ঐ ১৫নং ঘরটাই খালি আছে?
না, ১৭নং ঘরটাও খালি আছে। তবে ঐ ঘরটা ভাড়া দেওয়া হয় না।
কেন?
ঐ ঘরে একবার এক ভদ্রলোক নিজের গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।
গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন!
হ্যাঁ।
আত্মহত্যার কারণটা জানা যায় নি?
না।
কিরীটী আর প্রশ্ন করল না।
দেবেশ বলতে লাগলেন, সেই থেকে রাত্রে প্রায়ই ঘরের মধ্যে নানা রকমের আওয়াজ নাকি শোনা যায়। মধ্যে মধ্যে ঘরের মধ্যে চেয়ারের উপর এক ছায়ামূর্তিকে বসে থাকতে দেখা যায়। পর পর দুবার ঐ ঘরে যারা এসে উঠেছিলেন তারা ভয় পেয়েছিলেন।
তাহলে এক কাজ করুন—ঐ ১৭নং ঘরটাই আমাকে দিন।
কিন্তু–
আপনি তো জানেন, ভূতের ভয় আমার নেই। যদিও ভূত আমি দু-একবার দেখেছি এবং আমি ভূত বিশ্বাসও করি।
ভূত বিশ্বাস করেন।
হ্যাঁ। আপনি ঐ ১৭নং ঘরেই আমার থাকবার ব্যবস্থা করুন। আচ্ছা ১৬নং ও ১৮নং ঘরে কারা আছেন?
বললামই তো, ১৮নং ঘরে আছেন অধ্যাপক ডঃ সেন, ব্যাচিলার মানুষ। আর ১৬নং ঘরে মিঃ দত্ত মজুমদার ও তার স্ত্রী এসে উঠেছেন। ইউনিভারসাল ইলেকট্রিক কোম্পানির কলকাতা অফিসের জি. এম.।
ইউনিভারসাল ইলেকট্রিক কোম্পানির জি. এম.!
হ্যাঁ।
ভদ্রলোকের বয়েস কত হবে বলুন তো?