না, তাই বলছিলাম, যদি বৃষ্টি নামে—
তা দাঁড়িয়ে কেন অনুরাধাবসো না। সরিৎশেখর বললে।
ঐ সময় দরজার বাইরে থেকে একটি মোটা গম্ভীর পুরুষের গলা শোনা গেল, অনুরাধা।
তোমাকে ডাকছে যেন কে–সরিৎশেখর বললে।
অনুরাধা কোন জবাব দিল না। আবার ডাক শোনা গেল, অনুরাধা।
কি?
শুনে যাও। গলার স্বর রুক্ষ। সামান্য অসন্তোষও বুঝি প্রকাশ পায় সে কণ্ঠস্বরে।
আমি ঘরের মধ্যে আছি, ঘরে এস। অনুরাধা বললে।
সকালের সেই সমুদ্রের ধারে দেখা ভদ্রলোকটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। সরিৎশেখরের দিকে না তাকিয়েই বললেন, বেড়াতে যাবে না?
না, তুমি যাও—অনুরাধা বললে।
সরিৎশেখর আড়চোখে দেখল, ভদ্রলোকের পরনে টেরিটের প্যান্ট, দামী টেরিলিনের হাওয়াই শার্ট গায়ে।
তুমি যাবে না?
না, বললাম তো তুমি যাও—
অকস্মাৎ যেন ভদ্রলোকের চোখের মণি দুটো ধক্ করে জ্বলে ওঠে। মুহূর্তকাল অনুরাধার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক সরিশেখরের দিকে তাকালেন এবং বললেন, এঁকে তো চিনলাম না।
চিনবে না তুমি, ওঁর নামটা তোমার জানা থাকলেও, কখনও ওঁকে তুমি দেখনি। জবাব দিল অনুরাধা।
তা আগে পরিচয় ছিল বুঝি?
অনেক দিনের পরিচিত—
তা তো বুঝতেই পারছি।
তবে ওঁকে না দেখলেও ইতিপূর্বে ওঁর নামটা তোমার ভাল করেই জানা—
তাই বুঝি!
হ্যাঁ, যার কথা তুমি দিনের পর দিন বলতে—যাঁর সম্পর্কে তোমার কৌতূহলের অন্ত ছিল। না–যাক, পরিচয় করিয়ে দিই, উনিই ডঃ সরিৎশেখর সেন—
অ—
আর সরিৎ, ইনিই—
বুঝতে পারছি মিঃ সলিল দত্ত মজুমদার।
সত্যিই তুমি বেড়াতে যাবে না?
না, বললাম তো—
যাবে না?
না, যাব না। অনুরাধার কণ্ঠস্বর দৃঢ়।
সরিৎ কেমন যেন বিব্রত বোধ করে। বলে, যাও অনুরাধা—
কি, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, তুমি যাও—অনুরাধা আবার বললে ভদ্রলোককে।
তাহলে তুমি যাবে না অনুরাধা-সলিল দত্তর কণ্ঠস্বর যেন একটা চাপা আক্রোশে ফেটে পড়ল।
বললাম তো যাব না।
অনুরাধা যাও না–সরিৎ বললে। সরিৎ সত্যিই যেন কেমন বিব্রত বোধ করছিল। আশ্চর্য, কেন অনুরাধা যেতে চাইছে না?
না, যাব না-অনুরাধা আবার বললে, তার গলার স্বরে দৃঢ়তা ফুটে ওঠে।
ঠিক আছে, আমিও জানি তোমার মত বেহায়া বজ্জাত মেয়েছেলেকে কি করে শায়েস্তা করতে হয়। কথাগুলো বলে সলিল দত্ত মজুমদার আর দাঁড়ালেন না, ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। অকস্মাৎ ঘরের আবহাওয়াটাই যেন কেমন ভারী হয়ে গেল। সরিৎশেখর আরও বেশী বিব্রত বোধ করে। কি বলবে যেন বুঝে উঠতে পারে না। বিব্রত স্বরে বলে, তুমি গেলেই পারতে অনুরাধা।
না। কিন্তু তুমি এখনও ওই লোকটার কথা ভাবছ? যেতে দাও—ব্যাপারটাকে যেন উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে অনুরাধা। সমস্ত পরিস্থিতিটাকে সহজ করে তুলবার চেষ্টা করে। অনুরাধার হাবেভাবে মনে হয় যেন কিছুই হয়নি।
ভদ্রলোক মনে হল, অত্যন্ত চটে গিয়েছেন অনুরাধা।
কাকে ভদ্রলোক বলছ সরিৎ। ঐ অভদ্র আনকালচার্ড একটা ব্রুটকে! ভদ্রভাবে কথা পর্যন্ত বলতে জানে না!
কিন্তু উনিই—
আমাদের অফিসের জি. এম.—
উনিই একদিন ইন্টারভিউ নিয়ে তোমাকে চাকরি দিয়েছিলেন না? সরিৎ বললে।
হ্যাঁ তাই, তবে তার জন্য আমাকে পরবর্তীকালে যে মূল্য দিতে হয়েছিল—
মূল্য—
যাক সে কথা। চল, সমুদ্রের ধারে যাব—
এই দুপুরে-রৌদ্রে—
তাহলে আমি একাই যাই—অনুরাধা দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
আরে শোন শোন, কোথায় যাচ্ছ এই প্রচণ্ড রৌদ্রে, বসো–
বসব না, আমি যাচ্ছি—অনুরাধা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সরিৎশেখর অতঃপর কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। একটা কথা কিন্তু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তখন তার কাছে, ওদের পরস্পরের সম্পর্কটা যতই একসময় ঘনিষ্ঠ থাকুক, এখন তাতে চিড় ধরেছে।
সলিল দত্ত মজুমদার অনুরাধার অফিসের বস। এবং হয়তো ঐ ভদ্রলোকের ইচ্ছাতেই একসময় তার অফিসে অনুরাধার চাকরি হয়েছিল—সেও বৎসর দুইয়ের কিছু আগেই হবে। এবং চাকরি পাওয়ার পরই কয়েক মাসের মধ্যে যে কোন কারণেই হোক অনুরাধার মনটা তার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিল। যে কারণে অকস্মাৎ একদিন অনুরাধা এসে তাদের সমস্ত সম্পর্কের ওপর একটা ইতি টেনে দিয়ে গিয়েছিল।
তারপর এই দুই বৎসর অনুরাধা তার কাছে আর আসেনি, সেও যায়নি অনুরাধার কাছে। বস্তুত সরিৎ অনুরাধার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টাও করেনি।
সে ভুলতেই চেয়েছিল অনুরাধাকে। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে ভুলতে সে পারেনি অনুরাধাকে। কিন্তু কেন? কেন ভুলতে পারল না অনুরাধাকে?
জানালাপথে বাইরে দৃষ্টিপাত করল সরিৎশেখর। সমুদ্রের জল যেন প্রখর সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ঢেউয়ের মাথায় মাথায় শুভ্র ফেনার মালা। একটার পর একটা ঢেউ বালুবেলার উপরে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। সমুদ্রে মানার্থীর ভিড় আর এখন তেমন নেই।
অনেক দূরে দেখা গেল, মাথায় ঘোমটা তুলে তীর ধরে হেঁটে চলেছে অনুরাধা, স্বর্গদ্বারের দিকে।
অনুরাধা।
কত কত দিন পরে সে আজ আবার অনুরাধাকে দেখল।
এ সেই অনুরাধা যে একসময় তার জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।
তার মনের রেখাগুলো হতে হাসিটি পর্যন্ত তার একান্ত পরিচিত।
একদিন যার সম্পর্কে তার মনে হত—তার জীবন থেকে অনুরাধাকে বাদ দিয়ে একটা দিনও চলতে পারে না।
একটা দিন যার সঙ্গে দেখা না হলে তার মনে হতকতকাল যেন অনুরাধাকে সে দেখে নি।
সরিৎশেখর জানালা পথে চেয়ে থাকে—অনুরাধা হেঁটে চলেছে স্বর্গদ্বারের দিকে।
একবার মনে হয় সরিৎশেখরের অনুরাধা এখনও বেশীদূর যায় নি—ওর পিছনে পিছনে গিয়ে ডেকে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।