কেবল একটা কাজ বাকি। হোটেলের বোর্ডারদের গতিবিধির উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, হেমন্ত সাহুকে বলে তার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া। হোটেল থেকে এখনও কেউ যাননি।
রাত্রে আহারাদির পর নিজের ঘরে বসে বসে কিরীটী সেই কথাটাই ভাবছিল। রাত তখন গোটা দশেক হবে।
থানা থেকে হেমন্ত সাহুর লোক এল তার একটা চিঠি নিয়ে।
সাব, হুজুর আপনাকে একবার থানায় যেতে বলেছেন।
কিরীটী আর দেরী করে না। উঠে পড়ল। লোকটা একটা সাইকেল-রিকশা এনেছিল। উঠে বসল কিরীটী সাইকেল-রিক্শায়।
শ্রাবণের আকাশটা আজ পরিষ্কার, কোথাও কোন মেঘের চিহ্নমাত্রও নেই। ঝকঝক করছে। আকাশভরা একরাশ তারা।
সমুদ্রের একটানা গর্জন, বাতাস হু-হু করে ভেসে আসছে। কালো কালো ঢেউগুলো শুভ্র। ফেনার মুকুট মাথায় বালুবেলার ওপরে ভেঙে ভেঙে পড়ছে।
থানার অফিসঘরেই হেমন্ত সাহু বসেছিলেন, আর তার সামনে মুখখামুখি বসেছিল যে লোকটা তাকে দেখে কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা জেগে ওঠে-সলিল দত্ত মজুমদার।
এই যে আসুন মিঃ রায়, হেমন্ত সাহু বললেন।
কিরীটী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
আমি জানতে চাই দারোগাবাবু-সলিল দত্ত মজুমদার বললে ভুবনেশ্বরের হোটেল থেকে আমাকে এখানে এভাবে ধরে আনা হল কেন?
জবাব দিল কিরীটীই, দাবোগাবাবুর কঠিন নির্দেশ সত্ত্বেও আপনি গতকাল কাউকে কিছু না। বলে হোটেল থেকে পালিয়েছিলেন কেন?
পালিয়েছিলাম। কে আপনাকে বললে?
যেভাবে চলে গিয়েছিলেন সেটা পালানো ছাড়া আর কি!
আমি কারও হুকুমের চাকর নই।
কিন্তু আইন যে কোন সময় আপনার গতি রুখতে পারে–
অন্যায় আইন—
ন্যায়-অন্যায়ের বিচারটা পরে হবে, আপনি পালিয়েছিলেন কেন তাই বলুন?
আবারও বলছি, আমি পালাইনি—চলে গিয়েছিলাম।
কিন্তু আপনার বোঝা উচিত ছিল ঐভাবে চলে গেলেই আইনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। শুনুন, আপনাকে অ্যারেস্ট করে আনা হয়েছে।
অ্যারেস্ট। শুনতে পারি কি কিজন্য?
আপনার বিরুদ্ধে তিন-তিনটি হত্যার অভিযোগ!
কি পাগলের মত আবোলতাবোল বকছেন?
তিন বৎসর আগে পুরীর হোটেলে এক রাত্রে জীমূতবাহন চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করেন আপনি, এবং তিন বৎসর পরে আরও দুজনকে পর পর হত্যা করেন—প্রথমে অনুরাধা দেবী ও পরে ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে–
মশাই গাঁজা-টাজা সেবন করেন নাকি?
আপনি বলতে চান আপনি ঐ হত্যাগুলি করেননি?
নিশ্চয়ই না–সলিল দত্ত মজুমদারের কণ্ঠস্বরে এতটুকু কোন দ্বিধা বা সংকোচমাত্রও নেই, শান্ত, নিরুদ্বিগ্নতা ঐ অদ্ভুত আজগুবি চিন্তাটা আপনাদের উর্বর মস্তিষ্কে কি করে এবং কেনই বা এল জানতে পারি কি?
নিশ্চয়ই। কিরীটীও অনুরূপ শান্ত গলায় জবাব দিল, জানতে পারেন বৈকি।
বক্র হাসি দেখা গেল সলিল দত্ত মজুমদারের ওষ্ঠপ্রান্তে, আমিই যে তাদের হত্যা করেছি তার কোন প্রমাণ কি আপনাদের কাছে আছে?
প্রমাণ ছাড়া কি দাবোগাবাবু আপনার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছেন?
তাই নাকি? তা কি প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে বলুন তো?
মোটামুটি যে চারটি প্রমাণ—
চারটি প্রমাণ।
হ্যাঁ। কিরীটী শান্তগলায় বললে, যে রাত্রে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করা হয়–
সেরাত্রে তো হোটেলের ত্রিসীমানায়ও আমি ছিলাম না। আমি ভুবনেশ্বরে গিয়েছিলাম, ম্যানেজার ভবেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারতেন।
সে অ্যালিবাইটা আপনার ধোপে টিকবে না, কারণ সেরাত্রে আপনি আদৌ ভুবনেশ্বরে যাননি। আর জগন্নাথ পাণ্ডাই সে সাক্ষ্য দেবে। মনে হল আপনি যেন একটু চমকে উঠলেন : মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনার একটা কথা জানা প্রয়োজন, জগন্নাথ পাণ্ডা আপাতত নিরাপদ জায়গাতেই অবস্থান করছে—আদালতেই যা বলবার সে বলবে; তারপর ২ নং প্রমাণ আপনার ব্যবহৃত বিলেত থেকে আনা রেইনকোট, মানে ওয়াটারপ্রুফটা—যেটা আপনি সেরাত্রে জলঝড়ের মধ্যে ব্যবহার করেছিলেন—তারপর আপনার কাজকর্ম চুকে যাবার পর হোটেল থেকে বের হয়ে গিয়ে সমুদ্রতীরে একটা কাঁটাঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে এসেছিলেন। সেটার স্থানে স্থানে এখনও যথেষ্ট রক্তচিহ্ন আছে—যে রক্ত কেমিক্যাল অ্যানালিসিসে প্রমাণ করবে অনুরাধা দেবীরই রক্ত, সেটা এখন সেরাত্রের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রমাণ হিসাবে থানায়-ই আছে।
শেষের কথাগুলো শুনতে শুনতে কিরীটীর মনে হল যেন সলিল দত্ত মজুমদারের মুখের চেহারাটা কেমন পালটে যাচ্ছে।
এবার আসা যাক তৃতীয় প্রমাণে—আপনার পিস্তলটা, যেটার সাহায্যে তৃতীয় দিন রাত্রে আপনি আপনার হতভাগ্য নির্বোধ সম্বন্ধী ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে হত্যা করেছিলেন, সেই পিস্তলটা আজ শেষরাত্রে একজন জেলে সমুদ্রের কাছে কুড়িয়ে পেয়েছে—ঐ পিস্তলের নম্বরটাই প্রমাণ দেবে, ঐ পিস্তলের লাইসেন্স হোল্ডার কে!
কিরীটীর মনে হল, সলিল দত্ত মজুমদারের থুতনীটা যেন ঝুলে পড়েছে।
বলছিলাম না চারটি প্রমাণ আপাতত আমাদের হাতে আছে, চতুর্থ প্রমাণ হল ক্ষিতীন্দ্রবাবুর অসমাপ্ত একখানা চিঠি। সারাটা জীবন ধরে নির্বুদ্ধিতা করে করে বোধ হয় মৃত্যুর আগে ঐ একটিমাত্র বুদ্ধির কাজ করতে উদ্যত হয়েছিলেন ক্ষিতীন্দ্রবাবু তার স্ত্রী মালতী দেবীকে ঐ চিঠিটা লিখতে বসে—এখন বুঝতে পারছেন দত্ত মজুমদার সাহেব, গরল আর পাপ কখনও চাপা থাকে না, তিন বৎসর আগেকার চাপা পাপও আজ এতদিন পরে প্রকাশ হয়ে পড়ল!
সলিল দত্ত মজুমদার একেবারে চুপ। কেমন যেন অসহায় বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কিরীটীর মুখের দিকে।