আর ওই স্মাগলিংয়ের সূত্রেই সলিল দত্ত মজুমদারের সঙ্গে দাদার আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা। সলিল দত্ত মজুমদার বিলাতফেরত ও একজন বড় অফিসার হওয়া সত্ত্বেও স্মাগলিংয়ে জড়িত ছিল।
লোকটার টাকার নেশা ছিল প্রচণ্ড। মুখোশ ছিল তার বড় একটা কোম্পানিতে বড় একটা পোস্টের চাকরি। তার অন্ধকারের জীবনটা বোধ করি ঐ চাকরি ও পজিশনের দরুণই ধরাছোঁয়ার বাহিরে ছিল।
বিবাহের পর মুকুল যখন তার ঘরে এল সে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও এই সব কিছু না জেনেই এসেছিল।
আগেই বলেছি মুকুল ছিল সত্যিই সুন্দরী। দলের একজন হোমরাচোমরা ছিল ইসমাইল খান, লোকটা জাতিতে পাঠান, একদিন মুকুলকে দেখে সে পাগল হয়ে উঠল।
সোজাসুজিই সে সলিলকে কথাটা বললে। সলিল দত্ত মজুমদারকে ইসলাইমের প্রস্তাবে রাজী হতে হল, কারণ তা ছাড়া তার উপায় ছিল না। এক রাত্রে ঘুমন্ত মুকুলের শয়নকক্ষে ইসমাইলকে ঢুকিয়ে দিল সলিল।
কিন্তু ইসমাইল খান জানত না মুকুল কি প্রকৃতির মেয়ে, সে ধর্ষিতা হল বটে কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত মুকুলের হাতেই প্রাণ দিতে হল পিস্তলের গুলিতে।
তারপর সেই পিস্তলের সাহায্যেই মুকুল আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। অবশেষে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। সব ব্যাপারটা ঘটে সলিল দত্ত মজুমদারের দেওঘরের বাড়িতে।
রাতারাতি ইসমাইলের মৃতদেহটা সলিল দত্ত মজুমদার পাচার করে দিল। আর মুকুলকে পাঠিয়ে দিল রাঁচীর পাগলা গারদে। সে এখন বদ্ধ উন্মাদ।
কোন প্রমাণই ছিল না। সলিল দত্ত মজুমদার রটিয়ে দিল মুকুল নিরুদ্দিষ্টা।
দাদা কিন্তু খুঁজে বেড়াতে লাগল মুকুলকে।
ঐ সময় অনুরাধা এল আকস্মিক ভাবে সলিল দত্ত মজুমদারের জীবনে। অনুরাধা একজনকে ভালবাসত কিন্তু সলিল দত্তর চাতুরিতে কিছুটা এবং কিছুটা একটা সাচ্ছল্যের জীবনের জন্য সে ভুলে গেল সব কিছু।
দাদা বরাবরই সলিল দত্তর উপর নজর রেখেছিল, হঠাৎ সে সংবাদ পেল সলিল দত্ত পুরীতে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে দাদা স্থির করে সে পুরীতেই যাবে এবং তার সঙ্গে শেষবারের মত দেখা করবে। মুকলের ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করবে। কিন্তু একা সম্ভব নয়, তাই সে জামসেদপুরে গিয়েছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি সেরাত্রে বঙ্কিমের গৃহে তাকে চিনেও না চেনবার ভান করলাম। দাদা সেখান থেকে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমিও উঠে পড়লাম। আমি বুঝেছিলাম আমার সঙ্গে দেখা না করে ও কথা না বলে দাদা যাবে না। ঠিক তাই হল, মাঝপথেই তার সঙ্গে আমার দেখা হল।
ক্ষিতি!
কে? দাঁড়ালাম আমি। থমথমে অন্ধকার রাত। পথে জনমিনিষ্যি নেই।
দাঁড়া। আমি জীমুত—
কি চাই? কেন এসেছ? আমি শুধালাম।
মুকুলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
কোথায় সে? বেঁচে আছে তাহলে?
হ্যাঁ, বদ্ধ উন্মাদ। আছে রাঁচীর পাগলা গারদে।
কি করে জানলে?
ইসমাইল খানের ব্যাপারটা আমাকে বলে গেল জীমূতবাহন।
শুধালাম, কি করে এসব কথা জানলে?
দলের লোকেদের কাছ থেকেই জেনেছি। শোন যেজন্য এসেছি, আজ শুক্রবার, সামনের বুধবার তুই চলে আয় পুরী। আমি ঐদিনই পুরী পৌছাব। সলিল পুরীতে যাচ্ছে, মুখোমুখি একটা মোকাবিলা করতে হবে ঐ শয়তানটার সঙ্গে। আমি একা থাকলে হবে না—তুইও আসবি।
আমি রাজী হয়ে গেলাম। আর তিন দিন বাদেই পুরী রওনা হলাম।
হোটেলে পাশাপাশি ঘরে আমরা ছিলাম। আমি ও দাদা ১৭নং ঘরে, আর ১৮নং ঘরে সলিল দত্ত মজুমদার। যে রাত্রে পুরীতে পৌঁছাই, সেই রাত্রেই ঘটনাটা ঘটল।
সলিলের হাতে ঘুমের মধ্যে জীমূতবাহন নিহত হল।
পিছন থেকে তার গলায় ধারাল অস্ত্র চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
সেরাত্রে খুব বেশী মদ্যপান করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম, দুই ভাইয়ে মিলে দুবোতল প্রায় শেষ করেছিলাম। তখনও জানি না, সলিল পাশের ঘরেই আছে। আমি জানতাম সে তখনও হোটেলে এসে পৌঁছায়নি।
শেষরাত্রের দিকে ঘুমটা ভেঙে যেতে দেখি ঐ বীভৎস দৃশ্য। দাদা নিহত।
ভয়ে পালালাম আমি। পাছে আমাকেই পুলিস খুনী বলে ধরে।
দাদার কথা শুনে পুরীতে এসে ভুল করেছিলাম, আবারও ভুল করলাম পালিয়ে গিয়ে সেই শুরু হল আমার অজ্ঞাতবাস। এই তিনটে বছর যে আমার কিভাবে কেটেছে বেঁচেও মরে আছি আমি।
শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারের একটা হেস্তনেস্ত—
ব্যাস, ঐখানেই চিঠি শেষ। চিঠিটা ঐ পর্যন্তই লেখা—আর লেখা হয়নি।
চিঠিটা হাতে করে কিরীটী বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর একসময় চিঠিটা পকেটে নিয়ে বের হয়ে এল। রাত তখন প্রায় সোয়া নটা।
১৭নং ঘরে মালতী ছিলেন। কিরীটী তার ঘরেই থাকবার ব্যবস্থা করেছিল মালতীর এবং নিজে নীচের একটা ঘরে শিট করেছিল।
দরজা বন্ধ দরজার গায়ে টোকা দিতেই সাড়া এল।
কে?
মালতী দেবী, আমি কিরীটী রায়–দরজাটা খুলুন।
মালতী দরজা খুলে দিল।
ঘরে আসতে পারি?
আসুন। দরজা ছেড়ে দিলেন মালতী।
এই চিঠিটা পড়ে দেখুন।
কার চিঠি? কিসের চিঠি? মালতী শুধালেন।
চিঠিটা আপনার স্বামীর লেখা আর আপনাকেই লেখা–চিঠিটা শেষ করতে পারেননি, তাই হয়তো পোস্ট করেননি।
কোথায় পেলেন এটা?
আপনার স্বামীর সুটকেসে। পড়ে দেখুন–আপনার সমস্ত প্রশ্নেরই উত্তর এর মধ্যে পাবেন।
মালতী হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন।
মালতী কিরীটীর হাত থেকে চিঠিটা নিলেন বটে কিন্তু মনে হল তার জন্য যেন মনের মধ্যে। কোন তাগিদ ছিল না। কোন ইচ্ছা বা আগ্রহও না।
কিরীটী আর দাঁড়াল না।
কিরীটী স্থির করেছিল পরের দিনই সে চলে যাবে। মালতী দেবীর কাজটুকু যখন শেষ হয়ে। গিয়েছে, পুরীতে থাকা তো আর প্রয়োজন নেই।