মালতী পাথরের মতই দাঁড়িয়ে থাকে।
কি—আপনার স্বামী ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই তো? হেমন্ত সাহু প্রশ্ন করলেন।
মালতী দেবী পূর্ববৎ পাথরের মতই দাঁড়িয়ে রইলেন।
ঐসময় একজন সেপাই এসে ঘরে প্রবেশ করল।–স্যার!
কি খবর বৈজুপ্রসাদ, সেই ভদ্রলোক কোথায়? আসেননি?
তাকে হোটেলে পাওয়া গেল না। সে কি! হোটেলেই নেই?
না! দরজার লকটা বন্ধ ছিল, ড়ুপলিকেট চাবি দিয়ে লক খুলে দেখা গেল ঘরের মধ্যে কেউ নেই—ঘর খালি।
কিরীটী বললে, মিঃ সাহু, এখনি সর্বত্র ওয়ারলেস মেসেজ পাঠান চেহারার একটা ডেসক্রিপসন দিয়ে, কুইক, আর দেরি করবেন না। প্রত্যেক স্টেশনে ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট, সিকিউরিটি পুলিসকে।
হেমন্ত সাহু সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
আপনার মনের মধ্যে আজ আর কোন সন্দেহ নেই তো মিসেস চ্যাটার্জী, উনিই আপনার স্বামী ক্ষিতীন্দ্রবাবু?
মালতী মাথা তুলে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করলেন।
এবার বলবেন কি, তিন বৎসর আগে যে মৃতদেহটা সনাক্ত করবার জন্য এখানে এসেছিলেন। সে মৃতদেহটা যে আপনার স্বামীর নয় তা বুঝতে পেরেও কেন আপনার স্বামীর মৃতদেহ বলেই সনাক্ত করেছিলেন?
মালতী দেবী নীরব।
একটা মিথ্যার ভিতর দিয়ে মুক্তি পেয়ে গেছেন বলেই বোধ হয়, তাই নয় কি?
মালতী পূর্ববৎ নীরব।
সেদিন যদি মিথ্যাটাকে সত্য বলে না মেনে নিতেন, তবে হয়তো আজ এমনি করে মৃত্যুবরণ করতে হত না ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে আপনিই আপনার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী মালতী দেবী।
মালতী তখনও নীরব।
আপনি হয়তো ছেলেমেয়ে ও অন্যান্য সকলের দিক থেকে বেঁচে গেলেন, কিন্তু নিজের মনের কাছে জবাব দেবার মত কিছুই তো রইল না। আপনার স্বামীর কোন দোষ ছিল না তা আমি বলছি না। ছিল—তার অনেক দোষ ত্রুটিই ছিল, এবং সব কিছুর উপরে ছিল তার নির্বুদ্ধিতা, তবু বলব আপনার কাছ থেকে একটু সহানুভূতি পেলে হয়তো আপনাদের দুজনারই
জীবনটা এইভাবে নষ্ট হয়ে যেত না।
কিরীটী লক্ষ্য করল, মালতী দেবীর দুচোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
হেমন্ত সাহু ঘরে ঢুকলেন।
সিগন্যাল মেসেজ পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে এলাম মিঃ রায়।
ঠিক আছে, চলুন এবারে হোটেলের দিকে যাওয়া যাক। কিরীটী বললে!
আপনি কি মনে করেন মিঃ রায়, দত্ত মজুমদার হোটেলে ফিরে আসবেন?
কিরীটী মৃদু হাসল, বললে, তার জন্য ভাববেন না। পালিয়ে আর কোথায় যাবেন দত্ত। মজুমদার, ধরা তাকে পড়তেই হবে। একবার ক্ষিতীন্দ্রবাবুর—মানে আপনাদের মৃত চন্দ্রকান্তবাবুর সুটকেসটা ভাল করে উলটে-পালটে সবকিছু দেখতে হবে।
কিরীটী উঠে দাঁড়াল। চলুন মালতী দেবী।
কোথায়?
হোটেলে।
কেন?
ডেড বডির ময়নাতদন্ত না হওয়া পর্যন্ত আর ডেড বডি পাচ্ছেন না। পেতে পেতে হয়তো কাল পরশু–
আমি কিন্তু আজই ফিরে যেতে চাই, অবশ্যই আপনাদের অনুমতি পেলে–মালতী বললেন।
স্বামীর মৃতদেহের সক্কার না করেই চলে যাবেন?
মালতী মাথা নিচু করলেন।
ভদ্রলোক সত্যিই হতভাগ্য, ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন, বাপের স্নেহ কোন দিন পাননি, আপনিও সারাটা জীবন বিমুখ হয়ে ছিলেন, অন্তত শেষ কাজটুকু করুন। পরলোক বলে যদি কিছু থাকে তো, হয়তো একটু শান্তি পাবেন।
১১. একটা দীর্ঘ চিঠি
ক্ষিতীন্দ্রর সুটকেসের মধ্যেই একটা দীর্ঘ চিঠি পাওয়া গেল।
চিঠিটা দিনদশেক আগে তার স্ত্রী মালতী দেবীকেই লেখা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পোস্ট করা হয়নি।
মালতী,
আমি বেঁচে আছি। তিন বৎসর পূর্বে পুরীর হোটেলে যে মৃতদেহকে তুমি তোমার স্বামী বলে সনাক্ত করেছিলে পুলিসের সামনে, সে আমি নই। আমার বৈমাত্রেয় ভাই জীমূতবাহন চট্টোপাধ্যায়।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখ, আমরা দুভাই একই রকম দেখতে হয়েছিলাম। দুই মায়ের গর্ভে জন্মালেও। তুমি তো তাকে কোন দিন দেখইনি, আমিও ছোটবেলায় মাত্র একবার দেখেছিলাম তাকে!
দাদাকে তার মামারা আসতে দেননি কোন দিন বাবার কাছে, দাদাও আসেননি, মনের মধ্যে একটা ঘৃণা তার মামারা বাবার প্রতি সঞ্চার করেছিল।
আর তুমি হয়তো জান না দাদার এক বোনও ছিল।
তার নাম মুকুল। দাদার থেকে ১৮ মাসের ছোট, তার জন্মের পরই আমাদের সেই মা মারা যান। সেই মার জীবনের শেষের একটা বছর বাবার কাছ থেকে তিনি দূরেই ছিলেন, ছোট বোন, মুকুল তখন মার গর্ভে। বাবাও জানতেন না কথাটা, মা তো তাকে কথাটা জানতেই দেননি।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ায় দুজনে পৃথক হয়ে যান। মনোমালিন্যের কারণ যতদূর জানা যায়, বাবার অত্যধিক মদ্যপানের অভ্যাস।
আমি তোমাকে অতীতের সব কথা জানাচ্ছি, কারণ তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে, কেন তিন বৎসর পূর্বে জীবিত থেকেও আমাকে মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদকে মেনে নিতে হয়েছিল। কেন এই দীর্ঘ তিন বৎসর আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে আমাকে।
আমি আবার সংসারে তোমাদের সকলের মাঝখানে ফিরে যেতে চাই মালতী। নতুন করে আবার তোমাদের নিয়ে বাঁচতে চাই। তাই কিছুই গোপন করব না, সব বলব অকপটে।
সলিল দত্ত মজুমদার নামে এক ভদ্রলোককে মুকুল ভালোবাসে, এবং তাদের বিয়েও হয়। মুকুলের সঙ্গে সলিলের বিবাহে অবিশ্যি দাদার পূর্ণ মত ও সহযোগিতা ছিল। দাদা আর সলিল উভয়ে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্রেই মুকুলের সঙ্গে সলিলের আলাপ।
দাদা আমারই মত ম্যাট্রিক পাস করে আই. এ. পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দেয়। মামারা তখন তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়, কারণ ঐ বয়সেই দাদা স্মাগলারদের দলে ভিড়ে গিয়েছিল।