সেদিন শেষ পর্যন্ত একটা রিকশা ডেকেই দুজনে উঠে বসেছিল। সরিৎ প্রথমে রিকশায় উঠতে চায়নি, কিন্তু অনুরাধা তার কোন কথা শোনেনি। সেই আলাপ এবং সেই দিনই ওরা জানতে পারে পরস্পরের নাম।
ডঃ সরিৎশেখর সেন। কলেজের প্রফেসার। ইকনমিক্সের। আর অনুরাধা সোম ডিগ্রী কোর্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। অনুরাধার সাবজেক্টও ছিল ইকনমিক্স।
তারপর থেকে দুজনার দেখা হলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পথের মধ্যে বা পথ চলতে চলতেই কথা চলত। কলেজে যাতায়াতের পথেই বেশীর ভাগ।
সেই আলাপই ক্রমশ উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এনে দিয়েছিল।
তারপর অনুরাধা বি. এ. পাস করে একটা অফিসে চাকরি পেয়ে গেল যেন হঠাৎই।
অনুরাধার চাকরির প্রয়োজন ছিল সত্যিই একটা। বিধবা মা, ছোট একটি বোন ও সে নিজে, তিনজনের সংসার। রজনী সেন স্ট্রীটের বাড়িটা ছিল দোতলা, উপরে নীচে খানচারেক মাত্র ঘর, অবিশ্যি রান্নাঘর ও বাথরুম আলাদা। অনুরাধার বাবা দ্বিজেন সোম চাকরি করতে করতে হঠাৎ পঙ্গু হয়ে পড়েন একটা অ্যাক্সিডেন্টে। কমপেনসেশান ও প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে যা পেয়েছিলেন রজনী সেন স্ট্রীটের ঐ বাড়িটি তাই দিয়ে তৈরি করেছিলেন। অনুরাধার বয়স তখন সতেরো। সবে কলেজে ঢুকছে। দ্বিজেন সোম মারা গেলেন।
অনুরাধার মা বাড়ির দোতলাটা ভাড়া দিতে কতকটা বাধ্য হলেন। হাতে সামান্য যা অবশিষ্ট ছিল তাই দিয়েই সংসার চলতে লাগল, আর অনুরাধার কলেজের পড়া ও ছোট বোন মধুছন্দার স্কুলে পড়া। কিন্তু সঞ্চিত অর্থ তখন প্রায় শেষ। কাজেই পাস করার পর অনুরাধার একটা চাকরির প্রয়োজন ছিল।
পাস করার পরই চাকরি পাওয়া এত সহজ নয় আর পাবেও না হয়ত জেনেও, অনুরাধা একটার পর একটা চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক বিরাট ফার্মের অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার মিঃ সলিল দত্ত মজুমদারের কাছে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েই চাকরি হয়ে গেল তার। অনুরাধার খুশির অন্ত ছিল না সেদিন।
সংবাদটা এসে সেইদিনই সন্ধ্যার পর সরিৎশেখরকে সে দিয়েছিল।
সরিৎ, একটা surprise দেব তোমাকে।
সারপ্রাইজ?
হ্যাঁ–বল তো কি হতে পারে?
কেমন করে বলব—আমি তো আর গণৎকার নই!
তবু গেস্ কর—
তার চাইতে তুমিই বল রাধা।
পারলে না তো?
না।
জান আমার একটা চাকরি হয়ে গেছে আজ—
চাকরি! কোথায় চাকরি পেলে? কি চাকরি রাধা?
একটা মস্ত অফিসেজান, মাইনে আড়াইশো টাকা, আর মিঃ দত্ত মজুমদার বলেছেন, শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিংটা শিখে নিতে পারলে আরও বেশী মাইনে পাব—পারব না শিখে নিতে শর্টহ্যান্ড টাইপরাইটিংটা?
কেন পারবে না!
জান সরিৎ, ইন্টারভিউতে আমাকে কিছুই তেমন জিজ্ঞাসা করেননি মিঃ দত্ত মজুমদার। কেবল আমার বাড়িতে কে কে আছে-বাবা বারা গেছেন এবং আর্নিং মেম্বার আর ফ্যামিলিতে কেউ নেই শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দিলেন। সত্যি ভদ্রলোক ভারি ভাল।
সরিৎশেখর চুপ করে ছিল।
ঐ চাকরিটা পাবারই মাস চারেক বাদে, হঠাৎ দ্বিপ্রহরে সরিতের বাড়িতে এসে পরস্পরের মধ্যে সমস্ত সম্পর্কের ছেদ করে দিয়ে গিয়েছিল অনুরাধা।
ভিজে বালির ওপর দিয়ে সাগরের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঐসব কথাই মনে পড়ছিল আজ সরিশেখরের। গত দুই বৎসরের মধ্যে আর তার অনুরাধার সঙ্গে দেখা হয়নি কখনও। দুই। বৎসর পরে আজ আবার সাক্ষাৎ হল।
অনুরাধার সঙ্গের ভদ্রলোকটি কেকথাটা সরিতের মনের মধ্যে তখন আনাগোনা করছে। . বেশ মোটাসোটা ভারিক্কী চেহারা। ভদ্রলোকটির পরনেও ছিল সুইমিং কস্টিউম, গায়ে জড়ানো ছিল একটা বড় টাওয়েল। স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে অনেকটা হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক ভাবে চলে গিয়েছিল সরিৎশেখর। . হঠাৎ যেন তার মনে হল, মাথার উপরে রোদটা বড় চড়া। পায়ের নীচে বালিও গরম হয়ে। উঠছে। সরিৎশেখর ফিরল আবার হোটেলের দিকে।
দোতলায় একেবারে সমুদ্রের মুখখামুখি একটা ঘর নিয়েছে সরিৎশেখর। ১৮নং ঘর। ঘরটি একেবারে শেষপ্রান্তে। দোতলা সর্বসমেত চারটি ঘর ১৫, ১৬, ১৭, ও ১৮ নম্বর।
ঘরের চাবি খুলে ঢুকতে যাবে, ১৬নং ঘর থেকে বের হয়ে এল অনুরাধা। আবার দুজনে। চোখাচোখি। সরিৎশেখর থমকে দাঁড়ায় নিজের অজ্ঞাতেই বোধ হয়।
একবার সরিৎ ভাবল ডাকে অনুরাধাকে, কি ভেবে ডাকল না, ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দরজাটা কিন্তু খোলাই রইল।
জানালার সামনে এসে দাঁড়াল সরিৎশেখর।
হু হু করে খোলা জানালাপথে হাওয়া আসছে।
সরিৎ!
ফিরে তাকাল সে ডাকে সরিৎশেখর। দরজার উপরে দাঁড়িয়ে অনুরাধা। পরনে একটা হালকা সবুজ রঙের মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়ি।
কি, আমাকে চিনতে পারছ না? অনুরাধা বললে।
চিনব না কেন—
তাহলে ভিতরে আসতে তোকই একবারও বললে না!
বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছিলাম। সরিৎশেখর বললে।
কেন? বললে অনুরাধা।
সেটাই কি স্বাভাবিক নয় অনুরাধা?
অনুরাধা অন্য কথা বললে, এভাবে এই হোটেলে তোমার সঙ্গে দেখা হবে—আমি প্রায়ই তো পুরীতে আসি, আর এই হোটেলের এই ঘরটিতেই উঠি
তাই নাকি! যাক সে কথা, তা তুমি পুরীতে বেড়াতে এসেছ বুঝি?
হ্যাঁ!
তারপরই অনুরাধা হঠাৎ প্রশ্ন করল, আজ জুলাই মাসের কত তারিখ জান?
জানি-২৯শে জুলাই।
সেদিন কলকাতায় সেই বৃষ্টির সন্ধ্যায়—সেই তারিখটাও ছিল ২৯শে জুলাই।
সেদিন বুঝি ২৯শে জুলাই ছিল? সরিৎশেখর প্রশ্ন করল।
অনুরাধা রললে, হ্যাঁ। আচ্ছা, আজও যদি সেদিনকারও মত বৃষ্টি নামে।
তাতে কি হবে?