কিরীটী কথায় হেমন্ত সাহু যেন একটু বিরক্তই হলেন। বললেন, কি জানি মিঃ রায়, আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। তার ঐভাবে থানার হাজতঘর থেকে পালানোটাই প্রমাণ করে দিয়েছে অনুরাধা দেবীর হত্যাকারী তিনিই। আর কেউ নয়। খুঁজে তাকে আমি বের করবই, পালাবেন কোথায় তিনি! সর্বত্র তার চেহারার একটা ডেসক্রিপশন দিয়ে ওয়ারলেসে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। চললাম।
বের হয়ে গেলেন হেমন্ত সাহু ঘর থেকে একটু দ্রুতপদেই। আর একটু পরেই নীচে জীপের শব্দ পাওয়া গেল, বোঝা গেল, হেমন্ত সাহু প্রস্থান করলেন।
মালতী দেবী এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি। চুপচাপ বসে সব শুনছিলেন। এবার তিনি কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন, সত্যিই আপনার ধারণা কিরীটীবাবু, ও খুন করেনি।
তাই। ক্ষিতীন্দ্রবাবু খুন করেননি।
তবে কে খুন করল মেয়েটিকে।
দুটি হত্যাই একই সূত্রে বাঁধা, তিন বৎসর পূর্বে এই হোটেলেই জীমূতবাহনকে যে হত্যা করেছিল, তিন বৎসর পরে সেই আবার ঘটনাচক্রে অনুরাধাকেও হত্যা করেছে। কেবল দুটি ঘটনার মধ্যে অলক্ষ্যে যে যোগসূত্রটা রয়ে গিয়েছে সেটা খুঁজে বের করতে পারলেই সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে।
কিরীটীর কথাগুলো শুনে মনে হল, মালতী দেবীর মুখের ওপরে যেন একটা হতাশা ফুটে উঠেছে।
কিরীটী বললে, একটা কথা বলব মালতী দেবী, মনে কিছু করবেন না, আপনি বার বার আমাকে বলেছেন আপনার স্বামী একান্ত স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, নিজের সুবিধা ছাড়া অন্য কিছু ভাবেন না, নিজেকে ছাড়া দুনিয়ার কাউকে ভালোবাসেন না, নিঃসন্দেহে তার চরিত্রের ওটা একটা দিক, তার চরিত্রের সর্বাপেক্ষা বৈশিষ্ট্য যেটা সেটা হচ্ছে তার নির্বুদ্ধিতা। বুদ্ধি বলে কোন কিছুই তার মধ্যে নেই, একের নব্বরের নির্বোধ। তাই সর্বদা বড় বড় কথা বলে নিজের বিরাটত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে সকলের কাছে আরও হাস্যস্পদ হয়ে যান, আর এ সব কিছুর জন্যে দায়ী আপনিই।
আমি?
তাই। সে বিরাটত্ব প্রমাণ করার জন্য তিনি বার চরম নির্বুদ্ধিতা, প্রকাশ করে এসেছেন, অন্যের কাছে হাস্যাস্পদ হয়েছেন, সে বিরাটত্ব তার ওপরে আরোপ করেছেন আপনিই, এবং কার্যক্ষেত্রে তাঁর জীবনের ব্যর্থতার জন্য আপনিও বহুলাংশে দায়ী—আর তার মধ্যেই সুপ্ত ছিল তাঁর প্রতি আপনার বিরাগ, আপনাদের পরস্পরের মধ্যে অশান্তির অঙ্কুর। আপনি যদি সত্যিকারের স্ত্রীর মত স্বামীর ঐ নির্বুদ্ধিতাকে শোধরাবার চেষ্টা করতেন, তবে হয়তো আপনাদের জীবনের আজকের ট্র্যাজেড়িটাকে এড়াতে পারতেন।
মালতী দেবী মাথা নীচু করে বসে থাকেন।
যাক, অবশ্যম্ভাবীর গতিরোধ কেউ করতে পারে না।
কিন্তু লোকটা কোথায় গেল? ক্ষীণ স্বরে বললেন মালতী।
আমার মনে হয় এখনও তিনি পুরীতেই আছেন। আপনি কিন্তু হুট করে পুরী ছেড়ে চলে যাবেন না।
কিন্তু থাকব কোথায়?
এই হোটেলেই থাকুন, ম্যানেজারবাবুকে আমি বলে দেব।
পরের দিন প্রত্যুষে ক্ষিতীন্দ্রর মৃতদেহ পাওয়া গেল সমুদ্রের ধারে বালির উপরে, স্বর্গদ্বার থেকে মাইলখানেক দূরে, পৃষ্ঠদেশে তাঁর গুলির চিহ্ন।
বোঝা গেল কেউ তাকে পশ্চাৎ থেকে গুলি হত্যা করেছে। একদল বায়ুসেবী তরুণ মৃতদেহটা আবিষ্কার করে। এবং তারাই থানায় সংবাদ দেয়।
ক্ষিতীন্দ্রর মৃতদেহটার আইডেনটিফিকেশনের জন্য থানা থেকে ডাক এল মালতী দেবীর।
কিরীটী থানাতেই ছিল। তারই পরামর্শনুযায়ী হেমন্ত সাহু মালতী দেবীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন হোটেল থেকে থানায়। অবিশ্যি মালতী তখনও জানেন না কেন তাকে থানায় যেতে বলা হয়েছে।
স্বভাবতই হেমন্ত সাহু বিশেষ চিন্তিত। সমস্ত ঘটনাটা যে ঐভাবে অকস্মাৎ মোড় নেবে হেমন্ত সাহুর কল্পনারও যেন বাইরে ছিল এবং উভয়ের মধ্যে ক্ষিতীন্দ্রর মৃত্যুকে নিয়েই আলোচনা চলছিল।
মৃতদেহের হাত-পাঁচেক দূরে একটা ছোট কাঁটাঝোপের মধ্যে একটা ছোট জার্মান-মেক পিস্তল পাওয়া গিয়েছিল। তার ছয়টি চেম্বারের একটি চেম্বারে গুলি নেই। পিস্তলটা খুঁজে বের করেছে একজন সেপাই।
পিস্তলটা সামনের টেবিলের ওপরেই ছিল। কিরীটী বলছিল, ঐ পিস্তলটির সাহায্যেই আপনি হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পারবেন মিঃ সাহু।
কেমন করে? বিরস বদনে প্রশ্ন করেন হেমন্ত সাহু।
ঐ পিস্তলে একটা নম্বর আছে—ঐ নম্বরের পিস্তলের লাইসেন্স যার নামে আছে, সেটা আলিপুরের লাইসেন্স ডিপার্টমেন্ট খুঁজলেই তো পেয়ে যাবেন।
যদি অন্য কোথাও লাইসেন্সটা করানো হয়ে থাকে?
কিরীটী বললে, না। সম্ভবত আলিপুরের কোর্টেই লাইসেন্স করানো হয়েছিল। আমার অনুমান, হত্যাকারী এবং ঐ পিস্তলের যিনি অধিকারী, ওঁর—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, মালতী এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
আসুন মালতী দেবী। কিরীটী বললে।
আমাকে ডেকেছেন কেন? মালতী বললেন।
একটা মৃতদেহ সনাক্ত করবার জন্য।
মৃতদেহ! কার?
পাশের ঘরেই আছে, চলুন।
কিরীটী, হেমন্ত সাহু ও মালতী এসে পাশের ঘরে প্রবেশ করলেন।
মেঝের উপরে আগাগোড়া বস্ত্রাবৃত একটা মৃতদেহ পড়েছিল। হেমন্ত সাহুই নীচু হয়ে দেহের মুখের উপর থেকে বস্ত্রখণ্ড টেনে নিতেই মালতীর কণ্ঠ হতে একটা অস্ফুট চীৎকার নির্গত হল।
কিরীটী শান্ত গলায় মালতীর দিকে তাকিয়ে বললে, এবারে আর মিথ্যা নয়, সত্যি-সত্যিই ক্ষিতীন্দ্রবাবু এবারে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন তিনি আর বেঁচে নেই, সত্যি সত্যিই মারা গেছেন।