ঐদিনই দ্বিপ্রহরে। কলকাতায় ট্রাংককলে কার সঙ্গে যেন কথা বলে সবে এসে ঘরে ঢুকছে কিরীটী, চোরের মত এদিক ওদিক চাইতে চাইতে প্রৌঢ় নুলিয়া আঁড়িয়া এসে ঘরে ঢুকল, কাপড়ের তলায় কি যেন একটা বস্তু সযত্নে আড়াল করে।
–সাহাব।
কে, আঁড়িয়া—আয়, পেয়েছিস?
হ্যাঁ, পেয়েছি সাহেব। দেখ—সযত্নে কাপড়ের আড়াল থেকে একটা ওয়াটারপ্রুফ বের করে কিরীটী সামনে ধরল।
কিরীটীর চোখের দৃষ্টি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওয়াটার প্রুফটা উলটে-পালটে দেখে হৃষ্টচিত্তে বললে, কোথায় পেলি এটা?
স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে আরও এক মাইল দূরে-বালুর চরায় কাঁটাঝোপের মধ্যে।
কিরীটী ব্যাগ থেকে দশ টাকার দুটো নোট বের করে আঁড়িয়াকে দিল। আঁড়িয়া হৃষ্টচিত্তে, টাকাটা ট্যাকে খুঁজতে খুঁজতে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল।
বিকেলের দিকে থানা থেকে সাহু লোক পাঠালেন। জগন্নাথ পাণ্ডা থানায় বসে আছে। থানায় গিয়ে জগন্নাথের সঙ্গে কথাবার্তা বলে কিরীটী যখন ফিরে এল, সন্ধ্যার অন্ধকার চারদিকে ঘন হয়ে এসেছে তখন।
১০. পরের দিনই রাত আটটা নাগাদ
পরের দিনই রাত আটটা নাগাদ মালতী দেবী স্বর্গদ্বার হোটেলে এসে পৌঁছলেন। কলকাতা থেকে প্লেনে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন পুলিসের লোকই।
কিরীটী তার ঘরেই ছিল। বোধ করি মালতীর আগমনের প্রতীক্ষাতেই ছিল।
মালতী দেবী একজন সাধারণ পোশাকের পুলিস অফিসারের সঙ্গে অফিসে এসে কিরীটীর খোঁজ করতেই ভবেশ অধিকারী নিজে এসে মালতীকে কিরীটীর ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেলেন।
এই ভদ্রমহিলা আপনার খোঁজ করছিলেন মিঃ রায়।
মালতী দেবী, আসুন আসুন–বসুন।
কি ব্যাপারমালতী বললেন, এত জরুরি তলব দিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন?
আপনার স্বামীর সন্ধান পেয়েছি—
পেয়েছেন?
হ্যাঁ।
মালতী কিছুক্ষণ অতঃপর গুম হয়ে বসে রইলেন, তারপর ক্ষীণগলায় প্রশ্ন করলেন, কোথায়
সে?
এখানেই আছেন। থানার হাজতে—
থানায়? কেন?
ওর মাথার ওপর একটা খুনের চার্জ ঝুলছে।
সে কি! কাকে আবার সে খুন করল?
অনুরাধা দেবীকে।
সে কে?
সব বলব, তার আগে কয়েকটা প্রশ্ন ছিল আপনাকে আপনার স্বামীর কি আর কোন ভাই ছিলেন?
কিরীটীর আচমকা প্রশ্নটা যেন মালতী দেবীকে একেবারে পাথরে পরিণত করে, কেমন যেন বোবা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মালতী দেবী।
মালতী দেবী আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না তো!
আছে, তার এক সৎভাই—
সৎভাই!
হ্যাঁ আমার শ্বশুরের দুই বিয়ে—প্রথম যাকে বিয়ে করেছিলেন তার একটি ছেলে ছিল, তারপর তার হঠাৎ সর্পদংশনে মৃত্যু হওয়ায় দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন, তারও একটি মাত্র ছেলে, এবং বিবাহের দুই বৎসরের মধ্যে সেই স্ত্রীরও সর্পদংশনেই মৃত্যু হয়।
দুজনারই সর্পদশংনে মৃত্যু! কিরীটী প্রশ্ন করল, আশ্চর্য তো!
এর সবটাই পরবর্তীকালে আমার স্বামীর মুখ থেকে শোনা। প্রথমবারের ছেলেকে আমার শ্বশুরমশায়ের কাছ থেকে তার দিদিমা নিয়ে যান। কখনও আর তিনি তার বাপের কাছে আসেননি। শ্বশুরমশাইও যতদিন জীবিত ছিলেন সে ছেলের আর কোন সন্ধান নেননি তিনি। সে ছেলে দেখতে কেমন, কি করতেন, এখনও বেঁচে আছেন কিনা কিছুই জানি না।
কিরীটী ধীরে ধীরে বললে, মস্ত বড় একটা জট আমার খুলে গেল মিসেস চ্যাটার্জী। আমি যেন এখন সবকিছু অনুমান করতে পারছি।
কি অনুমান করতে পারছেন কিরীটীবাবু? প্রশ্ন করলেন মালতী।
বর্তমান রহস্যের গতিবিধি। ঠিক আছে, চলুন এবারে আমার সঙ্গে।
কোথায়?
থানায়। সেখানে আপনার স্বামী ক্ষিতীন্দ্রবাবু আছেন।
মালতী যেন নেহাৎ অনিচ্ছার সঙ্গেই উঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু তাদের আর বেরুনো হল না।
ঝড়ের মতই থানা-অফিসার হেমন্ত সাহু এসে ঘরে ঢুকলেন।
মিঃ রায়–
কি খবর—এই যে ক্ষিতীন্দ্রবাবুর স্ত্রী মালতী দেবী জামসেদপুর থেকে এখানে এসে পৌঁছেছেন। ওঁকে নিয়ে আমি থানাতেই আপনার কাছে যাচ্ছিলাম।
ক্ষিতীন্দ্রবাবু তো নেই—শুকনো গলায় উচ্চারণ করলেন হেমন্ত সাহু।
নেই, নেই মানে কি?
থানা থেকে পালিয়েছেন!
পালিয়েছেন? কেমন করে? তাকে তো হাজতে রাখা হয়েছিল?
বেলা চারটে নাগাদ হঠাৎ উনি পেটের ব্যথায় ছটফট করতে থাকেন। ক্রমশ ব্যথা নাকি বাড়তে থাকে। আমি থানায় ছিলাম না, সন্ধ্যানাগাদ ফিরে সব শুনে সিভিল সার্জেনকে কল দিই। ডাক্তার চৌধুরী এসে হাজতঘরে ঢুকে তাকে পরীক্ষা করছেন, হঠাৎ এক লাফে আমাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে খোলা দরজা-পথে ছুটে বের হয়ে গেলেন।
তারপর?
তারপর এই ঘণ্টাতিনেক আশেপাশে সর্বত্র খুঁজেছি—আমি নিজে ও সেপাইরা চারপাঁচজন, কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পেলাম না—তাই হোটেলে দেখতে এলাম, আপনাকেও কথাটা জানাতে এসেছি
পাগল নাকি! পালিয়েই যদি থাকেন তো হোটেলে আসতে যাবেন কেন?
এখন বুঝতে পারছেন তো মিঃ রায়, অনুরাধা দেবীর হত্যাকারী আর কেউ নয়—ঐ ক্ষিতীন্দ্রবাবুই?
না।
এখনও বলবেন, ক্ষিতীন্দ্রবাবু অনুরাধা দেবীর হত্যাকারী নন?
হ্যাঁ, তিনি নন। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে একটা সুস্পষ্ট দৃঢ়তা ফুটে ওঠে।
তবে তিনি পালালেন কেন?
মনে হচ্ছে মৃত্যুই তাকে টেনেছে, কি জানেন মিঃ সাহু, এইরকম কিছু যে একটা ঘটতে পারে সেটা পূর্বেই অনুমান করতে পেরেছিলাম বলেই তাকে অ্যারেস্ট করে হাজতে রাখায় কোন বাধা দিইনি—আপত্তি জানাইনি। কিন্তু ভাবছি কোথায় যেতে পারেন তিনি?
কিন্তু তিনি যদি হত্যাকারী নাই হবেন, তবে—
কিরীটী বললে, ভদ্রলোক কেবল নির্বোধ নন, প্রচণ্ড ভীতুও।