ওঁর কি ব্যবস্থা করব? হেমন্ত সাহু শুধালেন।
কেন–যেমন হাজতে আছেন তেমনিই থাকবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হচ্ছে ক্ষিতীন্দ্রবাবু গতরাত্রে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করেননি! আচ্ছা আমি এখন উঠব মিঃ সাহু–উঠে দাঁড়াল কিরীটী।
আপনি–
ভয় নেই, হোটলে থাকব-মালতী দেবী না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত। বলে থানা থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল কিরীটী।
কিছুটা পথ হেঁটে আসার পর কিরীটী একটা খালি সাইকেল-রিক্শা দেখে তাকে হাতঈশারায় ডেকে উঠে বসল।
কৌটি যিবে বাবু?
স্বর্গদ্বার হোটেলে চল।
চলন্ত রিকশাতে বসে কিরীটীর হঠাৎ মনে পড়ল, বিশেষ একটা জরুরি কথা হেমন্ত সাহুকে বলে আসা হয়নি। আবার ফিরে গেল কিরীটী থানায়।
থানার সামনে পৌঁছে দেখল, হেমন্ত সাহু বেরুচ্ছেন একটা সাইকেল চেপে।
কি, আবার ফিরে এলেন যে? হেমন্ত সাহু শুধালেন।
ট্যাক্সি ড্রাইভার জগন্নাথ পাণ্ডাকে চেনেন মিঃ সাহু?
হ্যাঁ, তার নিজেরই একটা ট্যাক্সি আছে, নিজেই চালায়।
তাকে একটিবার আপনার থানায় বিকেলে ডাকিয়ে আনতে পারেন?
ভাড়া খাটতে যদি না বের হয়ে থাকে তো ডেকে পাঠাব।
আমি তো হোটেলেই আছি, এলে খবর পাঠাবেন।
ঠিক আছে।
কিরীটী আবার ফিরে চলল। হোটেলের সামনে নামতেই হোটেলের নুলিয়া আড়িয়ার সঙ্গে দেখা হল। তাকে ডেকে কিরীটী কি যেন বললে। সে ঘাড় নেড়ে বললে, বুঝেছি।
কিরীটী বললে, ২০ টাকা বকশিস পাবি, যা।
আড়িয়া চলে গেল।
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কিরীটী এসে তার নিজের ঘরে ঢুকতেই দরজার বাইরে সলিল দত্ত মজুমদারের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ভিতরে আসতে পারি মিঃ রায়?
আসুন, আসুন।
সলিল দত্ত মজুমদার ঘরে এসে ঢুকলেন। পরনে তার পায়জামা পাঞ্জাবি।
মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, বোঝা গেল স্নানপর্ব শেষ হয়েছে।
বসুন মিঃ দত্ত মজুমদার।
সলিল দত্ত মজুমদার একটা চেয়ারে উপবেশন করলেন।
তারপর মিঃ দত্ত মজুমদার-I. G. মিঃ গুপ্তর সঙ্গে ট্রাংক কলে কথা হল?
না। তাকে এখনও ফোনে কনটাক্ট করতে পারিনি। এদিকে পরশু দুপুরে আমার একটা জরুরি মিটিং অ্যাটেন্ড করবার কথা, মিটিংটা অ্যাটেন্ড না করতে পারলে ভীষণ ক্ষতি হবে।
এখানকার ব্যাপারটাও তো কম জরুরি নয় মিঃ দত্ত মজুমদার।
আপনাদের কি ধারণা মিঃ রায়, অনুরাধাকে আমি হত্যা করেছি?
ব্যাপারটা ঠিক তা নয় মিঃ দত্ত মজুমদার, কিরীটী বলল, এমন কিছু সার্কাস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স আমাদের হাতে এসেছে যাতে করে আপনিও সন্দেহের তালিকার বাইরে যেতে পারছেন না!
ননসেন্স! আমি কেন অনুরাধাকে হত্যা করতে যাব?
আপনার দিক থেকে হত্যা করবার কারণ যেমন ছিল তেমনি প্রভোকেশানও ছিল। আপনি নিশ্চয়ই চাইতেন না অনুরাধা দেবী আপনার মুঠোর বাইরে চলে যাক!
সে চলে যেতে চাইলে নিশ্চয়ই আমি আটকাতাম না।
আমার প্রশ্নটার ঠিক জবাব নয় ওটা। আমি আপনার মনের ইচ্ছার কথাটা বলেছি কি, আপনি তা চাইতেন?
বললাম তো, আটকাতাম না।
কিরীটী মৃদু হাসল। তারপর বলল, গতকাল আপনি ভুবনেশ্বরে যাবার আগে অনুরাধা দেবীর সঙ্গে আপনার কথাকাটাকাটি হয়েছিল, তাই না?
কে বললে?
যেই বলে থাকুক–কথাটা সত্যি কিনা তাই বলুন।
না।
ভুবনেশ্বরে কখন গিয়ে পৌঁছেছিলেন?
বেশীক্ষণ লাগেনি, ঘন্টা দুই পরেই।
তারপর ফিরলেন কখন?
আজ সকালে প্রায় দশটা নাগাদ।
আচ্ছা মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনার ওয়াটারপ্রুফটা কি আসার সময় এখানে সঙ্গে করে এনেছিলেন?
এনেছিলাম। বৃষ্টির সময় এটা-ওয়াটারপ্রুফটা তাই সঙ্গে এনেছিলাম।
কাল বেরুবার সময় সেটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন?
নিয়েছিলাম বৈকি।
কিন্তু আজ সকালে যখন ফিরলেন, ওয়াটারপ্রুফটা তো আপনার সঙ্গে ছিল না?
সলিল দত্ত মজুমদার যেন একেবারে বোবা।
ভুবনেশ্বরে ফেলে আসেননি তো ভুল-টুল করে—
না, না।
তবে কোথায় ফেলে এলেন, মনে করার চেষ্টা করুন।
মনে হচ্ছে ট্যাক্সিতে ফেলে আসতে পারি—
ট্যাক্সিতে ফেলে আসলে কি আর সেটা পাবেন?
কেন পাব না, নিশ্চয়ই পাব। জগন্নাথ পাণ্ডা সেরকম লোক নয়।
তা বেশ। কিন্তু আপনি যে চলে যেতে চাইছেন, অনুরাধা দেবীর শেষ কাজটুকু কে করবে?
চুলোয় যাক অনুরাধা, I dont care!
সে কি! এতকাল ভদ্রমহিলাকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন—
স্ত্রী না ছাই। একটা লোক-দেখানো বিয়ে না করলে—
ওঁকে ধরে রাখতে পারতেন না, তাই কি?
অফিসের মাইনে ছাড়াও কম টাকা ওকে আমি মাসে মাসে দিইনি। নেমকহারাম, ছোটলোক–
মিথ্যে রাগ করছেন মিঃ দত্ত মজুমদার, রক্ষিত রাখতে হলে টাকা খরচ করতে হয় বৈকি। যা সেকথা—মুকুল দেবী তত ছিলেন আপনার স্ত্রী, তাই না?
নিশ্চয়ই, রীতিমত রেজেস্ট্রি করে বিবাহ করেছিলাম তাকে।
তবে যে সরিৎশেখরবাবুর কাছে অনুরাধা দেবী বলেছিলেন, তিনিও আপনার বিবাহিত স্ত্রী নন–মানে আইনসঙ্গত স্ত্রী ছিলেন না?
বাজে কথা। মুকুলকে আমি রেজেস্ট্রি করে বিবাহ করেছিলাম।
তা হঠাৎ তিনি নিরুদ্দেশটা হলেন কেন? এমন কিছু আপনাদের মধ্যে ঘটেছিল কি?
না, কিছুই ঘটেনি।
আচ্ছা মুকুল দেবীর দাদার নাম জীমূতবাহন, না?
হ্যাঁ।
সেই যে একদিন অফিসে এসে তিনি আপনাকে থ্রেন করে গিয়েছিলেন, তারপরে আর তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?
না।
আমি যদি বলি আপনি ঠিক সত্য কথাটা বলছেন না!
মিথ্যা কিসের জন্য বলতে যাব?
কারণ একটা মিথ্যা ঢাকতে গেলে আর একটা মিথ্যা এসে পড়ে, তারপর আর একটা মিথ্যার পাহাড় জমে ওঠে ক্রমশ। আর তখন সবটাই মিথ্যা হয়ে যায়। তাছাড়া ভুলে যাবেন না, মিথ্যাকে চিরদিন সত্য বলে চালানো যায় না, একদিন না একদিন অনিবার্য ভাবেই সত্য যা তা প্রকাশ হয়ে পড়ে।– সলিল দত্ত মজুমদার আর কিছু বললেন না, নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।