কৌণ্টি যিবে? রিকশাওয়ালা শুধায়।
থানায় চল। সাইকেল-রিকশা থানার দিকে চলল।
গতরাত্রে ঝড়-বৃষ্টির পর শহর অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আকাশে এখানে ওখানে সামান্য ভাসমান মেঘ থাকলেও মোটামুটি পরিষ্কার।
থানার অফিস-ঘরেই হেমন্ত সাহু বসেছিলেন। কিরীটী ঘরে ঢুকতেই বললেন, এই যে আসুন মিঃ রায়। একটু আগেই এস.পি. সাহেব চলে গেলেন।
চলে গিয়েছেন?
হ্যাঁ, তবে বার বার করে বলে গিয়েছিল, আজকের কেসটার ব্যাপারে আমি যেন আপনার পরামর্শ নিই। এদিকেও মহা ঝামেলা
কি আবার ঝামেলা?
ঐ যে আমাদের চন্দ্রকান্ত ঘাই–দাড়িগোঁফ কামাবে না কিছুতেই।
কামায়নি?
কামিয়ে দিয়েছি।
কোথায় সে?
হাজতঘরে—
এখানে আনান লোকটাকে।
সাহু একজন সেপাইকে আদেশ করলেন চন্দ্রকান্তকে অফিস-ঘরে আনবার জন্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন সেপাই চন্দ্রকান্তকে ঘরে নিয়ে এল।
কিরীটী তাকাল চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে। আর তার কোন সন্দেহ নেই। তার অনুমান মিথ্যা নয়, মন তার মিথ্যা বলেনি। তবু কিরীটী পকেট থেকে একটা ফটো বের করে একবার মিলিয়ে নিল।
ওটা কার ফটো মিঃ রায়? হেমন্ত সাহু শুধালেন।
দেখুন না, চিনতে পারেন কিনা! কিরীটী ফটোটা এগিয়ে দিল সাহুর হাতে।
সাহু দেখতে দেখতে বললেন, আশ্চর্য! এ যে—
ঠিক তাই। দিন ফটোটা।
কিরীটী ফটোটা নিয়ে আবার পকেটে রাখল।
এবার একটা কাজ করতে হবে মিঃ সাহু কিরীটী বললে।
কি করতে হবে?
একটা ঠিকানা দিচ্ছি বলে একটা কাগজে নামধাম লিখে কাগজটা সাহুর হাতে তুলে দিল কিরীটী, এই ঠিকানায় একে একটা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করে দিন, আর বিষ্ণুপুরের থানা অফিসারকেও একটা কেবল পাঠান, যেন অবিলম্বে এখানে তিনি চলে আসেন। মানে ওঁর এখানে আসবার ব্যবস্থা করে দেন।
এখুনি দিচ্ছি উঠে পড়লেন হেমন্ত সাহু।
হেমন্ত সাহু বের হয়ে যাবার পর কিরীটী আবার চন্দ্রকান্তর দিকে তাকাল।
এবার বলুন, আপনাকে কোন নামে ডাকব? কিরীটী চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে।
মানে? কুটি করে চন্দ্রকান্ত তাকাল কিরীটী মুখের দিকে।
মানে চন্দ্রকান্ত ঘাই তো আর আপনার আসল নাম নয়?
আপনি বলতে চান, আমি আমার নাম ভাড়িয়েছি? চন্দ্রকান্তর গলার স্বর রুক্ষ।
ক্ষিতীন্দ্রবাবু—
সঙ্গে সঙ্গে যেন চন্দ্রকান্ত চমকে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
খুব আশ্চর্য হচ্ছেন, না? আপনি যে ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেটা আজ আর আমার কাছে অজ্ঞাত নেই।
কি বলছেন যা-তা?
যা বললাম আমি জানি তার চাইতে বড় সত্য আর নেই। কিন্তু এবারে বলবেন কি—এই। তিন-তিনটে বছর ঐ ছদ্মবেশের কি প্রয়োজন ছিল?
আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না!
খুব ভাল করেই বুঝতে পারছেন, কিন্তু স্বীকার করতে চাইছেন না। কিন্তু এটা তো বুঝেছেন, দারোগা সাহেব কেন আপনাকে এখানে হাতকড়া দিয়ে নিয়ে এসেছেন—অনুরাধা দেবীর হত্যার অভিযোগ থেকে যদি নিজেকে এখনও বাঁচাতে চান তো সব কথা আমাকে খুলে বলুন।
আমি অনুরাধা দেবীকে হত্যা করিনি।
সাহুর পক্ষে খুব এটা কঠিন হবে না আপনার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করতে—ঐ রক্তমাখা ভোজালি যেটা আপনারই ঘরে আপনারই সুটকেসের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে, তার চাইতে আর মোক্ষম প্রমাণ কি হতে পারে এবং আরও একটা কথা, অনুরাধা দেবী কাল রাত্রে ছিলেন ১৬নং ঘরে এবং আপনি ছিলেন ঠিক তার পাশেই অর্থাৎ ১৫ নম্বরে।
না না, আমি বলছি আমি এর বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানি না। অনুরাধা দেবীকে আমি হত্যা করিনি, তাকে আমি চিনি না, কখনও আগে দেখিওনি।
কিন্তু circumstantial evidences যে আপনাকে কোণঠাসা করে ফেলবে, আদালতে কোন ক্রমেই তো আপনি benefit of doubt পাবেন না! আমি—একমাত্র কিরীটী রায়ই আপনাকে বাঁচাতে পারে—
দোহাই আপনার কিরীটীবাবু, আপনি আমাকে বাঁচান। বলতে বলতে ক্ষিতীন্দ্র হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।
হেমন্ত সাহু এসে ঘরে ঢুকলেন, পাঠিয়ে দিলাম কেবল দুটো।
কিরীটী বললে, এখন ক্ষিতীন্দ্রবাবুকে নিয়ে কি করবেন মিঃ সাহু?
হেমন্ত সাহু বিস্ময়ের সঙ্গে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে, ক্ষিতীন্দ্রবাবু!
ওঁর আসল নাম চন্দ্রকান্ত ঘাই নয়, উনি আপনাকে একটা ধোঁকা দিয়েছিলেন!
কি বলছেন কি?
হ্যাঁ মিঃ সাহু, ওঁর আসল নাম ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিন বৎসর আগে ঐ হোটেলে যিনি নিহত হয়েছিলেন, এবং আপনাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, ইনি তিনিই—আদি ও অকৃত্রিম ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-জামসেদপুর-নিবাসী মালতী দেবীর স্বামী! গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সব আপনার মিঃ সাহু বুঝতে পারছি—its a long story!
ক্ষিতীন্দ্রবাবু তবে আত্মহত্যা করেননি? তাহলে–
তাহলে তিন বছর আগে ঐ হোটেলে কে খুন হয়েছিল, তাই তো? না, সেটা এখনওমানে সে রহস্য এখনও ধোঁয়া। সম্ভবত সেই তিন বৎসর আগেকার এক হত্যার জেরই—অনুরাধা দেবীকে হত্যা!
সত্যই মিঃ রায়, আমার সব কিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। হেমন্ত সাহু বললেন।
কিরীটী প্রত্যুত্তরে হেসে বললে, তবে মনে হচ্ছে আমাদের হাতে যতটুকু প্রমাণাদি এসেছে, তার মধ্যে কিছু সূত্র আছে যে সূত্র ধরে এগুলেই হয়তো আমরা সমস্ত রহস্যের মীমাংসা খুঁজে পেয়ে যাবদুটো দিন অপেক্ষা করুন।
তবে কি অনুরাধা দেবীকে উনি হত্যা করেননি?
যদি বলি, না!
তাহলে ঐ ভোজালি, ঐ রুমাল—
বললাম তো, দুটো দিন অপেক্ষা করুন, আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব পাবেন।