অনুরাধার সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় ও এক সময়ের ঘনিষ্ঠতার কথা সবিস্তারে বলছিল সরিৎশেখর, আমি এখানে আসবার আগে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি মিঃ রায়, এইভাবে হঠাৎ এতদিন পরে অনুরাধার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে। সত্যি, অনুরাধার কথা যেন কিছুতেই আমি ভুলতে পারছি না!
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ডঃ সেন, আপনি যেমন অনুরাধা দেবীকে ভুলতে পারেননি, অনুরাধা দেবীও ঠিক তেমনি আপনাকে ভুলতে পারেননি।
আরও কি দুঃখ হচ্ছে জানেন আমার, অনুরাধা সেদিন ঝোকের মাথায় হঠাৎ যে ভুলটা করে বসেছিল এবং যে ভুলটা সে শোধরাবার জন্য এতখানি ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত সে ভুলটা শোধরাবার আর সুযোগ পেল না।
অনুরাধা দেবী সত্যিসত্যিই কি তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন বলে আপনার মনে হয় ডঃ সেন?
হ্যাঁ। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি সে অনুতপ্ত হয়েছিল, আর তাই ঐ মানুষটার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য একপ্রকার মরীয়া হয়ে উঠেছিল। শেষটায় হয়তো আর কোন পথ না খুঁজে পেয়েই আত্মহত্যা করে।
আত্মহত্যা নয় ডঃ সেন, তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে হয়েছে।
কিন্তু কে-কে তাকে অমন করে হত্যা করল?
একজন কেউ তাকে হত্যা করেছে নিশ্চয়ই!
শুনলাম চন্দ্রকান্তবাবুর সুটকেসে একটা রক্তমাখা ভোজালি পাওয়া গিয়েছে—তাই কি দারোগাবাবু ওঁকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেলেন?
ঠিক তাই।
আপনি কি মনে করেন চন্দ্রকান্তবাবুই–
মনে হওয়াটা তো আশ্চর্য না, উনি তো গতরাত্রে ঠিক ওঁর পাশের ঘরেই ছিলেন। সে যাক, আপনি কি কাউকে ঐ ব্যাপারে সন্দেহ করেন ডঃ সেন?
না, কাকেই বা সন্দেহ করব!
আচ্ছা আপনি আমার একটা কথার জবাব দিন তো-গতকাল ঐ সকালের পর অনুরাধা। দেবীর সঙ্গে আর আপনার সাক্ষাৎ হয়নি বা তার সঙ্গে কোন কথাবার্তা হয়নি?
ডঃ সেন চুপ করে রইলেন।
মনে হয় হয়েছিল, তাই নয় কি ডঃ সেন?
হয়েছিল। ম্লানকণ্ঠে ডঃ সেন বললে, কাল রাত্রে যখন খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে তখন আমি ওর ঘরে গিয়েছিলাম।
রাত তখন কটা হবে?
বোধ করি সোয়া আটটা।
কতক্ষণ ছিলেন সেখানে?
অনেকক্ষণ। ঘণ্টা দু-তিন তো হবেই।
যদি আপত্তি না থাকে, আপনাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছিল বলবেন?
অনুরাধা গতরাত্রে সরিশেখরের বুকের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে ড়ুকরে কেঁদে উঠেছিল।
সরিৎ প্রথমটায় কি করবে বুঝে উঠতে পারেনি, তারপর একসময় বললে, কেঁদো না অনু, কেঁদো না, শোন
আমাকে তুমি বাঁচাও সরিৎ–
শোন আমার কথা–
না না, আগে বল এই যন্ত্রণা থেকে তুমি আমায় মুক্ত করবে।
শোন–সরিৎ সযত্নে অনুরাধার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললে, মুক্তি আজ তোমাকে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে অনু। বাইরের কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে? অনুরাধা বললে, জানো না ঐ মানুষটাকে তুমি? চেনো না?
একটা মিথ্যাকে মেনে নিতে নিতে তুমি আজ দুর্বল হয়ে গিয়েছ রাধা। এই দুর্বলতাকে কাটিয়ে ওঠ, দেখবে মুক্তির পথটা তখন খুঁজে পেতে তোমার কষ্ট হবে না। মিথ্যে জুজুর ভয় মন থেকে যতদিন না দূর করতে পারবে
চল—তুমি আমাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে চল।
তাতে করে তো তোমার এই প্রবলেমের কোন সমাধান হবে না!
তবে কি আত্মহত্যা করে ছাড়া আমার আর অন্য কোন উপায় নেই?
ছিঃ রাধা, ওকথা ভাবাও অন্যায়।
তাহলে বল, কি করতে হবে আমাকে?
কাল যখন দত্ত মজুমদার ফিরে আসবেন, তাকে সবকিছু স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে তুমি কলকাতায় চলে যাও।
তারপর?
আমি এখনও সেই বাসাতেই আছি। ভানুকে তুমি চেনোই, আমার সেই পুরাতন চাকর, তোমার কোন অসুবিধা হবে না—সেখানেই উঠো।
তুমি?
পরশু বা তার পরের দিন ফিরে যাব।
ঠিক তো?
ঠিক। আমি এবার চলি, কেমন? তুমি ভাল করে দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়।
কিরীটী শুধাল তারপর?
সরিৎশেখর বললে, আমি তার ঘর থেকে বের হয়ে চলে এলাম। বাইরে তখনও প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টি। আমি সোজা আমার ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিলাম।
রাত তখন কটা হবে?
জানি না। ঘড়ি দেখিনি, তবে মনে হয় রাত সোয়া দশটা কি সাড়ে দশটা।
অনুরাধা দেবী কি দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, আমি দরজার কবাট দুটো টেনে দিতে ভিতর থেকে দরজার লকটা পড়বার শব্দ পেয়েছিলাম।
অনেক ধন্যবাদ, আপনার স্টেটমেন্ট থেকে অন্তত এটা প্রমাণিত হল যে গতরাত্রে সোয়াদশটা পর্যন্ত অনুরাধা দেবী জীবিতই ছিলেন। যা ঘটেছে, ঘটেছে তারপর। রাত সাড়ে দশটার। পর কোন এক সময় হত্যাকারী তাকে হত্যা করেছে। এবং অনুরাধা দেবী নিজেই হত্যাকারীকে তার ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। অথচ তিনি জানতেও পারেননি, সাক্ষাৎ মৃত্যুকে তিনি ঘরে ঢুকিয়েছিলেন? অবিশ্যি তাতে করে এও প্রমাণ হচ্ছে যে হত্যাকারী তার অপরিচিত কেউ ছিল না। নচেৎ নিশ্চয়ই তিনি তাকে দেখে চেঁচামেচি শুরু করতেন, লোক ডাকতেন। আর ঘরেও আলো জ্বলছিল–
সরিৎশেখর কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল এবং বললে, আপনি কি অনুমান করতে পেরেছেন মিঃ রায়, কাল রাতে অনুকে কে হত্যা করেছে?
কিরীটী শান্ত গলায় বললে, এতক্ষণ সেটা অস্পষ্ট থাকলেও এখন আর নেই। দুএকদিনের মধ্যেই সেটা জানতে পারবেন। আচ্ছা ডঃ সেন, আপনি এবারে আসুন, আমি একটু বেরুব।
সরিৎশেখর ঘর ছেড়ে চলে গেল। কিরীটীও উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী হোটেল থেকে বের হয়ে একটা সাইকেল-রিকশা নিল।
সকাল থেকে যে সন্দেহটা তার মনের মধ্যে ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট ছিল, এখন সেটা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।