মনে হচ্ছে ওটা ওর স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, সযত্নে রক্ষিত ও বর্ধিত, এবং সেই সযত্ন প্রয়াসের মধ্যে কোন বিশেষ অভিসন্ধি–
ঠিক আছে, বলছেন যখন–
কি জানেন মিঃ সাহু, ভাল করে চেয়ে দেখবেন ওর মুখের দিকে, লোকটাকে ঐ দাড়িগোঁফ যেমন কুৎসিত দেখাচ্ছে ঠিক তেমনটি হয়তো লোকটা দেখতে নয়।
অতঃপর মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে থানা থেকে জীপ আনিয়ে চন্দ্রকান্তকে হাতকড়া পরিয়ে হেমন্ত সাহু প্রস্থান করলেন।
কিরীটী এসে অফিস-ঘরে ঢুকল। সলিল দত্ত মজুমদার একটা চেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। সারামুখে তার বিরক্তি।
ভবেশ অধিকারী তার চেয়ারে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে নিঃশব্দে টানছিলেন। কিরীটীর পিছনে আট-দশজন বোর্ডার এসে ঘরে ঢুকলেন।
একসঙ্গে সবাই বলে ওঠেন, আমাদের বিল দিন, আমরা আর এ হোটেলে এক মুহূর্ত থাকব না।
ভবেশ অধিকারীর ধূমপান সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। জ্বলন্ত ও অর্ধদগ্ধ বিড়িটা মুখে চেপে ধরে থাকেন।
কিন্তু এই মুহূর্তে তো আপনাদের কারোরই এ হোটেল থেকে যাওয়া হবে না কথাটা শান্ত গলায় বললে কিরীটী।
যাওয়া হবে না! কেন? অনেকগুলো কণ্ঠস্বর যেন একঝাক তীরের মত কিরীটীর প্রতি বর্ষিত হল।
১৬নং ঘরে একজন ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন, দাবোগাবাবুর হুকুম, তার এনকোয়ারি শেষ হওয়া পর্যন্ত হোটেল ছেড়ে কেউ যেতে পারবেন না।
একজন বলে উঠলেন, দারোগাবাবুর কি ধারণা, আমাদের মধ্যে তাকে কেউ খুন করেছে।
সেটা আপনারা দারোগাবাবুকেই জিজ্ঞাসা করবেন, কিরীটী বললে।
কোথায় দারোগাবাবু?
থানায়।
চল হে, আমরা তাহলে থানায় যাই—একজন আবার বললেন।
কিন্তু এ অন্যায়, বেআইনী জুলুম–বললেন সলিল দত্ত মজুমদার।
কিরীটী সলিল দত্ত মজুমদারের কথায় কান না দিয়ে দোরগোড়ার সমাগতদের দিকে তাকিয়ে। বললে, থানায় আপনাদের কাউকেই যেতে হবে না। মনে হয় কাল-পরশুর মধ্যেই দাবোগাবাবুর। তদন্ত শেষ হয়ে যাবে, তারপর আর উনি আপনাদের যেতে বাধা দেবেন না। একটা বা দুটো দিন হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে, ম্যানেজারবাবু তো কিছু ইচ্ছা করে আপনাদের অসুবিধা সৃষ্টি করছেন না। তাছাড়া দেখছেন তো, উনি নিজেও কম বিব্রত হননি!
সমাগতদের একজন তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, জানতে পারি কি আপনি কে মশাই এ হোটেলে?
কৃষ্ণকায় এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, চিনতে পারছেন না—উনি কিরীটী রায়।
কিরীটীবাবু! অন্য একজনের প্রশ্ন।
হ্যাঁ, বিখ্যাত সত্যসন্ধানী—শোনেননি ওঁর নাম—
ধীরে ধীরে ভিড় পাতলা হয়ে গেল।
সলিল দত্ত মজুমদার তাঁরই সোনার সিগ্রেট কেসটা পকেট থেকে বের করে একটা লাইটারের সাহায্যে একটা সিগ্রেটে অগ্নিসংযোগ করলেন।
সরিৎশেখর ঐ সময় অফিস-ঘরে এসে প্রবেশ করল। সলিল দত্ত মজুমদার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সরিশেখরের দিকে তাকালেন।
বসুন বসুন ডঃ সেন, আপনি এসেছেন ভালই হল, ভাবছিলাম আপনার ঘরে যাব।
ডঃ সেন একটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর বললে, আমিও আপনাকে কিছু বলব বলেই এসেছি মিঃ রায়।
সলিল দত্ত মজুমদার সহসা উঠে দাঁড়াল, ম্যানেজারবাবু, আমার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিন।
নীচের তলায় সিঁড়ির কাছে ১১নং ঘরটা খালি আছে—
থাকতে যখন হবে, যেখানেই হোক থাকবার একটা ব্যবস্থা করুন। আর কলকাতায় আর্জেন্ট একটা ট্রাংককল বুক করুন, বলে নম্বরটা বললেন সলিল দত্ত মজুমদার।
কিরীটী বললে, উনি তো আই. জি.–
হা মিঃ গুপ্ত, আমার বন্ধু-সলিল দত্ত মজুমদার গর্বিত কণ্ঠে বললেন, আপনারা আমাকে নিয়ে খেলা করবেন আর আমি তাই সহ্য করে যাব যদি ভেবে থাকেন তো ভুল করেছেন! আমি একটা বিরাট কনসার্নের জি. এম.!
মিথ্যে আপনি রাগ করছেন মিঃ দত্ত মজুমদার। কিরীটী বললে।
মিথ্যে? আমার কোন প্রেসটিজ নেই বলতে চান?
আচ্ছা মিঃ দত্ত মজুমদার, হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনাদের কোম্পানির কাজে আপনি জামসেদপুরে নিশ্চয়ই গিয়েছেন কখনও না কখনও?
বহুবার গিয়েছি, তাছাড়া আমার বাবা আর এল দত্ত মজুমদার টিসকোর একজন বড় অফিসার ছিলেন। রাঁচিতে আমি আই. এস-সি পড়েছি, তারপর বি. এস-সি পাস করে বিলেত যাই। তা হঠাৎ ও কথা কেন?
আপনি ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে জামসেদপুরের কাউকে চেনেন?
ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়! কেমন যেন একটু চমক দত্ত মজুমদারের গলার স্বরে। কিন্তু কথায় সেটা প্রকাশ পেল না।
হ্যাঁ, টিসকোতেই কাজ করতেন, পরে রিটায়ার করেন–কিরীটী বললে।
না, ঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু কেন বলুন তো?
না ভাবছিলাম, আপনার বাবা তো ওখানেই থাকতেন আর আপনারও সেখানে যাতায়াত ছিল। জামসেদপুর বিহারের কতটুকুই বা একটা টাউন—চিনলেও হয়ত ভদ্রলোককে চিনতে পারেন। আরও একটা কথা, সেই ভদ্রলোক তিন বৎসর আগে এই হোটেলেই আত্মহত্যা করেছিলেন ঐ দোতলার ১৭নং ঘরে—
গোপী এসে দাঁড়াল দরজার সামনে, বললে, ১১ নং ঘর ঠিক করে দিয়েছি ম্যানেজারবাবু।
যান মিঃ দত্ত মজুমদার গোপীর সঙ্গে যান—ভবেশবাবু বলেন।
সলিল দত্ত মজুমদার আর মুহূর্তও দেরি করেন না। গোপীর সঙ্গে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন একটু যেন দ্রুতপদেই।
কিরীটী যেন কেমন অন্যমনস্ক। মনে হল সে যেন কি ভাবছে।
মিঃ রায়।
সরিশেখরের ডাকে কিরীটী ফিরে তাকাল।
গতকাল অনুরাধার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছিল, আমার মনে হচ্ছে আপনার সব কথা জানা প্রয়োজন।
কিরীটী উঠে দাঁড়াল। চলুন ডঃ সেন, আমার ঘরে চলুন। ভবেশবাবু দুকাপ চা পাঠিয়ে দেবেন আমার ঘরে ১৭ নম্বরে।
০৯. ১৭নং ঘরে দুটো চেয়ার
১৭নং ঘরে দুটো চেয়ারে কিরীটী আর সরিৎশেখর মুখখামুখি বসে।