কিরীটী আবার বললে, তাহলে চন্দ্রকান্তবাবু, আপনি বলতে পারছেন না, আপনার সুটকেসের মধ্যে এই ভোজালিটা কি করে এল?
আমি আগে কখনও এটা দেখিনি, বিশ্বাস করুন। বিশ্বাস করুন আপনারা! চন্দ্ৰকান্তের গলার স্বরে করুণ মিনতি।
সাহু কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি স্থিরনিশ্চয় করে বলতে পারি মিঃ রায়, এই লোকটিই কাল রাত্রে কোন এক সময় পাশের ঘরে গিয়ে অনুরাধা দেবীকে হত্যা করেছে।
চন্দ্রকান্ত হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, না না, আমি কাউকে খুন করিনি।
সাহু উচ্চকণ্ঠে দরজার বাইরে প্রহরারত জমাদারকে ডাকলেন। রঘুনন্দন জমাদার ঘরের মধ্যে ঢুকে সেলাম দিল।
ইসকো হাতমে হাতকড়া লাগাও।
কেন কেন—আমার হাতে হাতকড়া পরাবে কেন, আমি কাউকে খুন করিনি। চন্দ্রকান্ত প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করে কিন্তু তার প্রতিবাদে কর্ণপাত করা হয় না। পকেট থেকে একজোড়া হাতকড়া কথা বের করে চন্দ্রকান্তর হাতে পরিয়ে দিল জমাদার রঘুনন্দন!
যাও, একে নিয়ে নীচে অফিসঘরে গিয়ে অপেক্ষা কর রঘুনন্দন, আমরা আসছি। চন্দ্রকান্তকে নিয়ে রঘুনন্দন নীচে চলে গেল।
ভাগ্যে আপনি ছিলেন মিঃ রায়—হেমন্ত সাহু গদগদ ভাবে বললেন, খুনের ফয়সালা এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল—ঐ সুটকেস দেখার কথাটা কখনও আমার মনেই হত না।
কিরীটী বললে, আপনি সুটকেসটা ভাল করে লক্ষ্য করেননি, করলে নজরে পড়ত বন্ধ ডালাটার ওপাশ থেকে একটু কাপড়ের অংশ বের হয়েছিল—কিরীটী এগিয়ে গিয়ে একটা রক্তমাখা রুমাল তুলে বলল, এই দেখুন, এই রুমালের একটা অংশ আমার নজরে পড়েছিল।
এটা তো দেখছি একটা লেডিজ রুমাল।
কিরীটী রুমালটা পরীক্ষা করতে করতে বলল, হ্যাঁ, লেডিজ রুমাল, দেখুন এর এক কোণে ইংরেজী অক্ষর এ লাল সুতো দিয়ে লেখা আছে।
কার এই রুমালটা বলুন তো?
‘এ’ অনেকেরই নামের আদ্যক্ষর হতে পারে। কিরীটী বলল, অনুরাধা দেবীরও হতে পারে। একটা সূক্ষ্ম সেন্টের গন্ধ এই রুমালটা থেকে পাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
চলুন তো একবার পাশের ১৬নং ঘরে।
হেমন্ত সাহু ও কিরীটী এসে আবার পাশের ঘরে ঢুকল। ঘরের সামনে একজন সেপাই দাঁড়িয়ে ছিল, সে সরে দাঁড়াল ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রের দিকের জানালা খুলে দিতেই এক ঝলক রৌদ্র এসে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।বাইরে ইতিমধ্যে মেঘ কেটে গিয়ে যে সূর্যের আলো প্রকাশ পেয়েছে। তা ওরা জানতে পারেনি।
কিরীটী আর একবার ঘরের চারপাশে তাকাল।
পাশাপাশি দুটো চামড়ার সুটকেস, দুটোই তালাবন্ধ। একটা সাইজে বেশ বড়, অন্যটি মাঝারি। সাইজের। ছোট সুটকেসটার গা-তালার সঙ্গে একটা চাবির রিং ঝুলছে। চাবি ঘোরাতে গিয়ে দেখা গেল চাবিটি খোলা। ডালা তুলতেই নজরে পড়ল কিছু দামী দামী শাড়ি, আরও কিছু স্ত্রীলোকের ব্যবহার্য টুকিটাকি, একপাশে একটা দামী সেন্টের সুদৃশ্য শিশি। সেটার ছিপি খুলে নাকের কাছে ধরতেই রুমালের গন্ধটা পাওয়া গেল। তার পাশে একটা লেডিজ ব্যাগ। ব্যাগটা খুলল কিরীটী।
একটা কমপ্যাক্টের সুদৃশ্য কৌটো-ছোট মিরার, একটা চিরুনি, একটা লেডিজ রুমাল, বেশ কিছু একশো টাকার নোট, খুচরো কয়েন।
কিরীটী অনুরাধার মতৃদেহটার দিকে তাকাল। বীভৎস, নৃশংস।
ডেড্ বডিটা এবার মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন মিঃ সাহু।
হ্যাঁ। চলুন এবারে থানায় যাওয়া যাক। হেমন্ত সাহু বললেন।
সরিৎশেখর আর সলিল দত্ত মজুমদারকে আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে মিঃ সাহু–কিরীটী বলল।
চলুন না ওদের থানায় নিয়ে যাই, যা জিজ্ঞাসা করবার সেখানেই করবেন। তারপর না হয় ছেড়ে দেওয়া যাবে—খুনীই যখন ধরা পড়ে গিয়েছে!
আপনার তাহলে ধারণা ঐ চন্দ্রকান্ত ঘাই—
নিশ্চয়ই। ঐ ভদ্রলোকই মার্ডারার। কেন, আপনার কোন সন্দেহ আছে নাকি তাতে? কথাটা বলে হেমন্ত সাহু কিছুটা যেন গর্বিত ও উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে—এখন পর্যন্ত যে সব এভিডেন্স আমরা পেয়েছি, সেটাই কি প্রমাণ করে না!
তা হয়তো করে, কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন কি মিঃ সাহু, ১৫ নং ঘরের মেঝেতে দুটো ধেনোর শূন্য বোতল গড়াগড়ি দিচ্ছিল!
ধেনোর বোতল। কিছুটা যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই মিঃ সাহু তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
দু-বোতল ধেনো গিলে একটা মানুষের অবস্থা কি হতে পারে, নিশ্চয়ই আমাদের কথাটা একবার ভাবতে হবে–
নিশ্চয়ই ভেবেছি বৈকি। সাহু জবাব দিলেন, যা-তা ব্যাপার তো নয়, একটা লোককে মার্ডার করা—মনটাকে সেজন্য প্রস্তুত করবার জন্যই হয়তো দু-দুটো বোতলের প্রয়োজন হয়েছিল! .
তা বটে—কিরীটী মৃদু হাসল।
বুঝতে পারছেন না মিঃ রায়, লোকটা একটা কোল্ড-ব্লডেড মার্ডারার।
আমার কিন্তু মনে হল–কিরীটী বলল, লোকটা অসম্ভব ভীতু–
ভীতু লোকেরা কি খুনখারাপি করে না মিঃ রায়? আমি তিন-তিনটে কেস জানি—অসম্ভব ভীতু—অথচ নৃশংসভাবে খুন করেছিল।
ঠিক আছে, আপনি লোকটাকে অ্যারেস্ট করুন, তবে একটা কাজ যদি করতে পারেন আপনি, মনে হয় আপনার identification-এর খুব সুবিধা হবে।
বলুন না কি করতে হবে?
একটা নাপিত ডাকিয়ে, থানায় নিয়ে গিয়ে লোকটার দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে হেঁটে দিতে পারেন?
কয়েকটা মুহূর্ত সাহু হাঁ করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হল ব্যাপারটা যেন তিনি আদৌ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি।
দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দেব। তার মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?