সাহুই বন্ধ দরজার গায়ে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে চেঁচালেন, দরজাটা খুলুন, শুনছেন মশাই, দরজাটা খুলুন!
কিন্তু সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সাহু আবার ধাক্কা দিলেন আরও জোরে।
প্রায় মিনিট তিনেক ধাক্কাধাক্তির পর ঘরের দরজা খুলে গেল।
কে? কি চাই? কিন্তু ঐ পর্যন্তই—আর কথা বেরুল না চন্দ্রকান্তর গলা থেকে!
একমাথা ঝাকড়া আঁকড়া কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল, মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, পরনে একটা মলিন স্ন্যাকস ও গায়ে একটা ততোধিক ময়লা ও ছেড়া গেঞ্জি। গেঞ্জিটা যে কতদিনের পুরানো ও ময়লা কে জানে!
সাহুই প্রশ্ন করলেন, কি নাম আপনার?
আপনার নাম দিয়ে কি হবে?
সাহু এবার বেশ একটু কড়া গলাতেই বললেন, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দিন বলে চন্দ্রকান্তকে আর জবাবের অবকাশ না দিয়ে তাকে ঠেলেই যেন একপ্রকার সকলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ঘরের মধ্যে এলোমেলো একটা শয্যা, গোটা দুই ধেনো মদের শূন্য বোতল মেঝেতে গড়াচ্ছে, এখানে ওখানে মেজেতে আধপোড়া সিগারেটের টুকরো ছড়ানো।
একপাশে মেঝেতে একটা ছোট সুটকেস, দেওয়ালের আলনায় একটা ময়লা হাফ হাতা হলদে রংয়ের টেরিকটের শার্ট ঝুলছে।
সাহু আবার প্রশ্ন করলেন, কি নাম আপনার?
চন্দ্রকান্ত ঘাই। ভাঙাভাঙা কর্কশ কণ্ঠে জবাব এল।
কোথা থেকে আসেছেন?
কলকাতা থেকে।
তা কি করা হয়?
কাজকর্ম কিছু করি না, তবে পেলে করি—
কিছু করেন না!
রিটায়ার করেছি বছর কয়েক হল, রিটায়ার করার পর থেকে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াই।
কিরীটী একদৃষ্টে চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
একমুখ কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ থাকলেও কেন যেন তার মনে হচ্ছিল ঐ মুখের সঙ্গে কোথায়। একটা ক্ষীণ সাদৃশ্য আছে তার দেখা কোন একটা মুখের। কিন্তু কিরীটী ঠিক যেন স্মরণ করতে পারে না ঐ মুহূর্তে।
চন্দ্রকান্ত বললে এবারে, কিন্তু এভাবে ডাকাডাকি করে আমার ঘুমটা ভাঙালেন কেন দারোগা সাহেব, বলবেন কি?
আপনার ঠিক পাশের ঘরেই একজন ভদ্রলোক ও একজন স্ত্রীলোক থাকতেন, নিশ্চয়ই জানেন মিঃ ঘাই? সাহুর প্রশ্ন।
না।
জানেন না?
না। হোটেলে উঠেছি, আজ না হয় কাল চলে যাব, আমার পাশের ঘরে কে আছে না আছে। সে খবর জেনে আমার কি হবে—আর তার দরকারটাই বা কি!
আপনার পাশের ঘরের মহিলাটিকে কাল রাত্রে কেউ হত্যা করেছে—
কি–কি বললেন—খুন?
হ্যাঁ, খুন। নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, কিরীটী বললে। কথাটা বলে কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে। চন্দ্রকান্তর দুচোখের তারায় একটা স্পষ্ট ভীতি।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল চন্দ্রকান্ত, তারপর একটা ঢোক গিলে বলল, তা আমার কাছে কেন এসেছেন আপনারা?
কাল রাত্রে আপনি তো পাশের ঘরেই ছিলেন—
দোহাই আপনাদের, আমি কিছু জানি না।
কিরীটী ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে, হঠাৎ প্রশ্ন করল, ঐ সুটকেসটা আপনার?
হ্যাঁ, আমার—
কি আছে ওটার মধ্যে?
জামাকাপড়, বোধ হয় একটা রামের বোতল, আর কিছু টুকিটাকি জিনিস।
দেখতে পারি?
হ্যাঁ, দেখুন না।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে সুটকেসের ডালাটা খুলতেই থমকে দাঁড়াল। জামা কাপড়ের ওপরে একটা তীক্ষ্ণধার রক্তমাখা ভোজালি।
এটা কার?
ভোজালি! সে কি? ওটা কোথা থেকে এল আমার সুটকেশের মধ্যে।
কিরীটী রুমাল বের করে সন্তর্পণে ভোজালিটা তুলে নিল। মিঃ সাহু, দেখুন! হেমন্ত সাহু কিরীটীর হাতের দিকে তাকালেন। মাঝারি সাইজের সুন্দর চমৎকার হরিণের শিঙেয়ের তৈরি বাঁটওয়ালা একটা ভোজালি।
কিরীটী বললে, দেখুন, এখনও রক্তের কালো দ্রাগ শুকিয়ে আছে ভোজালিটার গায়ে। আর দেখছেন–
হ্যাঁ, একটা কালো লম্বা চুল। সাহু বললেন।
আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তো—কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, এই ভোজালিটার সাহায্যেই হত্যাকারী অনুরাধা দেবীকে হত্যা করেছিল।
সাহু চন্দ্রকান্তর মুখের দিকে এবার যেন পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
চন্দ্রকান্ত স্থির পাষাণের মত দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ফারিত দুটি চোখের দৃষ্টি স্থির, ঠোটটা যেন ঝুলে পড়েছে নীচের দিকে।
চন্দ্রকান্তবাবু—সাহু প্রশ্ন করলেন, এটা কার?
জানি না। শুকনো গলায় যেন ফিস ফিস করে জবাব দিল চন্দ্রকান্ত।
জানেন না?
না। একটু–একটু জল–
সাহুই এগিয়ে গিয়ে এক কোণে ছোট্ট একটা টুলের উপরে রাখা কাঁচের জাগ থেকে গেলাসে জল ঢেলে চন্দ্রকান্তর সামনে ধরলেন।
কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে জলের গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে চো চো করে সবটুকু জল পান করে নেয় চন্দ্রকান্ত, এবং তার পরমুহূর্তেই চন্দ্রকান্তর কম্পিত শিথিল হাত থেকে শূন্য কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।
চন্দ্রকান্ত কেমন বোকা বিহুল দৃষ্টিতে তাকাল ওদের মুখের দিকে।
তা যেন হল, কিন্তু অস্ত্রটা আপনার সুটকেসের মধ্যে কোথা থেকে এল?
কি করে বলব। আমি কিছুই জানি না।
আপনি তো ঘরের দরজার চাবি নিয়ে শুয়েছিলেন?
চাবি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, চাবি। দরজার গডরেজের তালার চাবিটা কোথায়?
কোথায় চাবিটা! কতকটা যেন স্বগতোক্তির মত চন্দ্রকান্ত উচ্চারণ করলে।
দেখুন তো, আপনার পকেটেই হয়তো আছে।
পকেটে হাত দিয়ে চন্দ্রকান্ত বললে, পকেটে? কই পকেটে তো নেই।
আরে এই তো চাবিটা, বলতে বলতে হেমন্ত সাহু দরজার একপাশে মেঝে থেকে গডরেজের চাবি তুলে নিলেন, দেখুন তো মিঃ রায়, এই চাবিটা বোধ হয়!
পরীক্ষা করে দেখা গেল ঐ চাবিটাই দরজার চাবি।