কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল সলিল দত্ত মজুদমারকে, হঠাৎ এবার বলল, আপনার সারা জুততা ও প্যান্টের নীচে অত বালি এল কোথা থেকে?
সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে এসেছি তো, তাই বোধ করি—
আপনি তো গাড়িতে ভুবনেশ্বর গিয়েছিলেন, ফিরে এসেছেন কি সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে?
না না, তা কেন! গাড়িতেই ফিরেছি, তবে হোটেলের কাছাকাছি এসে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এলাম।
কাল কখন ভুবনেশ্বর পৌঁছেছিলেন–কখন সেখান থেকে রওনা হয়েছেন?
ভোরবেলা রওনা হয়েছি—
এখানে আসতে কতক্ষণ সময় লাগল?
তা ঘণ্টা দুই প্রায়। কিন্তু এত কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আর আপনি বা কে?
সাহুই জবাব দিলেন সলিল দত্ত মজুমদারের কথাটার, বললেন, উনি আমাদের লোক। যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন ওঁকে।
কিরীটী বললে, ওঁকে আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই মিঃ সাহু। আপনার যদি কিছু জানবার থাকে—
না, আমি আর কি জিজ্ঞাসা করব—হেমন্ত সাহু বললেন।
ভবেশবাবু, ঘরের দরজায় তো দেখছি গডরেজের তালা লাগানো-কিরীটী বলল।
হ্যাঁ, এই হোটেলের সব দরজাতেই গডরেজের তালা লাগানো–ভবেশ বললেন।
দুটো করে নিশ্চয়ই চাবি আছে প্রত্যেক তালার?
হ্যাঁ। একটা অফিসে থাকে, অন্যটা বোর্ডারকে দেওয়া হয়।
একটা চাবি তো দেখছি তালায় লাগানো, অন্যটা—
নীচে অফিসে আছে, কি বোর্ডে টাঙানো-আনব?
নিয়ে আসুন। আর ঐ সঙ্গে সরিৎবাবুকে এই ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে যান।
ভবেশ অধিকারী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী আবার সলিল দত্ত মজুমদারের দিকে তাকাল-মিঃ দত্ত মজুমদার, আপনি অনুরাধা দেবীর প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন?
মেয়েমানুষকে কেউ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে কি? মেয়েমানুষ জাতটাই—
অবিশ্বাসিনী হয়—তাই কি আপনার ধারণা?
তাই। নচেৎ দেখুন না, হঠাৎ পুরানো প্রেমিককে দেখেই অনুরাধার পূর্ব স্মৃতি জেগে উঠল—
প্রফেসারকে কি আপনি সন্দেহ করেন?
ঠিক ঐ মুহূর্তে প্রথমে ভবেশ অধিকারী ও তার পশ্চাতে সরিৎশেখর ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরে পা দিয়েই সরিৎশেখর অস্ফুট কণ্ঠে বললে, এ কি! অনুরাধা এভাবে—ওকে কে খুন করলে? উঃ, কি ভয়ানক।
আপনি তো চেনেন সরিৎবাবু, ওঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল—
হ্যাঁ, এক সময় ছিল ঠিকই, পরে অনুরাধা মিঃ দত্ত মজুমদারকে বিবাহ করেছিল।
আপনি সেকথা কার কাছে শুনলেন—অনুরাধা দেবী বলেছিলেন নাকি?
না, সলিল দত্ত মজুমদারই বলেছিলেন কাল। শুধান না ওঁকে!
কিন্তু ওঁদের বিয়ে তো হয়নি। অনুরাধা দেবী ওঁর কিপিংয়ে ছিলেন—
এখন মনে পড়ছে বটে, অনুরাধা ঐরকম কিছু একটা গতকাল আমাকে বলেছিল এবং এও বলেছিল ওঁর স্ত্রী আছেন—
কি মিঃ দত্ত মজুমদার, কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ ছিল, বাট শি ইজ ডেড। অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছে মনে হয়।
কথাটা ঠিক বুঝলাম না–কিরীটী বলল।
মানে অনেক বছর সে নিরুদিষ্টা হঠাৎ প্রায় চার বছর আগে আমাকে ছেড়ে সে চলে যায়, তারপর থেকে তার অনেক সন্ধান করেছি আমি কিন্তু কোন সন্ধান তার পাইনি।
আচ্ছা তাঁকে আপনি কবে বিবাহ করেছিলেন?
লন্ডন থেকে ফিরে এসে চাকরিতে ঢোকার পর।
ঐ সময় সরিৎশেখর বললে, ওঁর পূর্বতন স্ত্রী, যাকে উনি লন্ডন থেকে ফিরে এসে বিবাহ করেছিলেন বলছেন, সেই মহিলা অর্থাৎ মুকুল রায়কে উনি আদপে বিবাহই করেননি—উনি মিথ্যা বলছেন!
চকিতে সলিল দত্ত মজুমদার সরিৎশেখরের মুখের দিকে তাকাল এবং বলল, নিশ্চয় আপনার প্রেমিকা অনুরাধা আপনাকে বলেছে কথাটা?
যে-ই বলে থাকুক, কথাটা সত্যি কিনা?
না, সত্য নয়।
জীমূতবাহন রায়কে আপনি চেনেন–না তাঁকেও চেনেন না? সরিৎশেখর আবার প্রশ্ন করেন।
কে জীমূতবাহন রায়?
মুকুল রায়ের দাদা, এককালে যার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল।
জীমূতবাহন বলেও কাউকে আমি চিনি না।
অথচ ঐ জীমূতবাহনসরিৎশেখর বললে, একদিন ওঁর অফিসে ওঁকে threaten করে গিয়েছিলেন-অনুরাধাই কথাটা আমাকে কাল বলেছিল।
শি ওয়াজ এ র্যাম্পস্বৈরিণী! চাপা ক্রুদ্ধস্বরে সলিল দত্ত মজুমদার বললে।
কিরীটী ওদের তর্ক-বিতর্ক শুনছিল, এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। এবার বললে, ডঃ সেন, আপনিও পুলিশের এনকোয়ারি-পর্ব সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই হোটেল ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
কিন্তু আমি যে আজই চলে যাব। সরিৎশেখর বললে।
সাহু বললেন, আপনি যেতে পারবেন না!
কেন, আমাকে কি হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছেন? সরিৎশেখর বললে।
কিরীটী বললে, ঘটনা পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে কেউই আপনারা সম্ভাব্য সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না। আপনি ও মিঃ দত্ত মজুমদার তো বটেই, ১৫নং ঘরে যিনি আছেন তিনিও না।
ভবেশবাবু বললেন, হয়ে গেল। আমার হোটেলই এবার উঠে গেল।
কিরীটী বললে, আপনি এ ঘরের ড়ুপলিকেট চাবিটা এনেছেন ভবেশবাবু?
না। একটা ছোট্ট ঢোক গিলে হতাশার ভঙ্গিতে ভবেশ অধিকারী বললেন, চাবিটা কি-বোর্ডে নেই রায়মশাই।
নেই মানে কি?
খুঁজে পেলাম না। ভবেশ শুকনো গলায় বললেন, চাবিটা কাল সকালেও কি-বোর্ডে ছিল কিন্তু দেখতে পেলাম না–
তবে চাবিটা গেল কোথায়? চাকরবাকরদের জিজ্ঞাসা করেছেন?
না।
কিরীটী বললে, মিঃ সাহু, চলুন পাশের ঘরের ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলা যাক। ডঃ সেন, আপনি আপনার ঘরে যান।
প্রথমে সাহু ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে এল। সরিৎশেখর ও সলিল দত্ত মজুমদারও পিছনে পিছনে এল, সকলের পশ্চাতে ভবেশ অধিকারী। বাইরে আকাশ তখনও মেঘে কালো। থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, তবে হাওয়াটা কিছুটা স্তিমিত। সূর্যের মুখ মেঘের আড়ালে চাপা পড়ে আছে।
০৮. ১৫নং ঘরের দরজা বন্ধ
১৫নং ঘরের দরজা বন্ধ তখনও।