কিরীটী মৃদু মৃদু হাসছিল নিঃশব্দে। সেদিকে নজর পড়ায় সাহু বললেন, হাসছেন যে, হাসির কথাটা কি হল জানতে পারি কি?
আপনাদের এস. পি. মিঃ নির্মল বড়ুয়া না?
চকিতে ফিরে তাকালেন সাহু-হ্যাঁ, তার নাম জানলেন কি করে?
তাঁর সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় আছে, থানায় ফিরে গিয়ে আমার নামটা বললেই তিনি চিনতে পারবেন।
কি যেন আপনি করেন, ভবেশবাবু বলছিলেন?
তিন বছর আগে এই হোটেলেই ঐ দোতলায় ১৭নং ঘরে একটা খুন হয়েছিল, সেই ব্যাপারেই–
খুন হয়েছিল তিন বছর আগে এই হোটেলে?
হ্যাঁ, ওঁকেই মানে ভবেশবাবুকেই জিজ্ঞাসা করুন না মিঃ সাহু! তাই এখানে আসার আগে, মিঃ বড়ুয়াকে ট্রাংককলে আমি কটকে আসার কথাটা জানিয়েছিলাম। তার এবং আপনার .. সাহায্যের হয়তো আমার প্রয়োজন হতে পারে। তিনি আমায় বলেছিলেন, আপনি একজন খুব কমপিটেন্ট অফিসার–
তা এসব কথা আমাকে আগে বলবেন তো!
সাহুর ব্যবহার তো বটেই, গলার স্বর কথাবার্তাও যেন পালটে গিয়েছে।
ভেবেছিলাম আজ সকালেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব থানায়–
হ্যাঁ হ্যাঁ, গতরাত্রেই সাহেব আমাকে বলছিলেন বটে–কিন্তু আপনি যে ঘটনার কথা বলছেন সেসব গতরাত্রেই থানার পুরাতন ডাইরি উলটে-পালটে আমি দেখছিলাম—সেটা তো একটা সুইসাইড কেস!
না, হোমিসাইড খুন—ডায়াবলিকাল মার্ডার, আর এখানে এই হোটেলে গতরাত্রে ১৬নং * ঘরে যা ঘটেছে সেটাও তাই, মার্ডার-নৃশংস খুন!
আপনি ডেডবডি দেখেছেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ। পিছন থেকে আকস্মিকভাবে কোন ধারাল অস্ত্র চালিয়ে এমন আঘাত করা হয়েছে যে তাতেই ভদ্রমহিলার মৃত্যু হয়েছে বলে আমার ধারণা।
অস্ত্র কি–কাটারী?
না, ধান কাটা হয় যে কাস্তের সাহায্যে, আমার অনুমান সেই ধরনেরই কোন অস্ত্র আততায়ী ব্যবহার করেছিল। তারপর মৃতের হাতে একটা ধারাল ছুরি গুজে দিয়ে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বলে রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।
বুঝলেন কি করে?
ওটা উল্ডের পজিসন ও ডেপথ দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন মিঃ সাহু।
কিন্তু ভদ্রমহিলাকে কে খুন করল?
হত্যাকারীর মোটিভ বা উদ্দেশ্য একটা কিছু ছিল বৈকি। বিনা মোটিভে তত খুন হয় না। কিরীটী বললে।
আসুন না, চলুন উপরে আমার সঙ্গে। সাহু অনুরোধ জানালেন।
বেশ চলুন।
সেই ১৬নং ঘর, সেই রক্তাক্ত মৃতদেহ। চারপাশে মেঝেতে জমাটবাঁধা কালো চাপ চাপ রক্ত। সাহু সেই দৃশ্যটা দেখে যেন থমকে গেলেন। অস্ফুটকণ্ঠে বললেন, উঃ, কি ভয়ানক!
বাইরে তখন আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মেঘে মেঘে আকাশটা কালো হয়ে গিয়েছে।
মেয়েটার বয়স কত হবে বলুন তো মিঃ রায়? সাহুর প্রশ্ন।
বছর ২৮/২৯ তো হবেই–
বলছিলেন না ভবেশবাবু, মেয়েটি বিবাহিতা, কিন্তু মাথায় বা কপালেও সিঁদুর দেখছি না। বউ-টউ সাজিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে ফুর্তি করতে
না, না, ওঁরা স্বামী-স্ত্রীই—প্রফেসারও তাই বলছিলেন গতকাল সকালে। প্রফেসারও ভদ্রমহিলাকে চিনতেন। ভবেশ অধিকারী প্রতিবাদ জানালেন।
অধ্যাপক! কে অধ্যাপক?
অধ্যাপক সরিৎশেখর সেন, ঐ তো দোতলাতে ১৮নং ঘরে উঠেছেন—
আমার বাম দিককার ঘরে, কিরীটী বললে, আমি ১৭নং ঘরে আছি।
সাহু বললেন, এ ঘরের ডানদিকে ১৫নং ঘরে কেউ নেই ভবেশবাবু?
আছেন। গতকালই এসেছেন। চন্দ্রকান্ত ঘাই নামে এক ভদ্রলোক।
মিঃ রায়, আপনি তো বললেন আপনি ১৭নং ঘরে আছেন। কাল রাত্রে আপনি কিছু শোনেননি?
না। কাল–
কিরীটীর কথা শেষ হল না, ঘরের বাইরে জুতোর শব্দ শোনা গেল। সকলেই দরজার দিকে তাকাল। ঘরে এসে ঢুকল সলিল দত্ত মজুমদার। ঘরে পা রেখেই ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার, আমার ঘরে ভিড় কেন ভবেশবাবু?
কারও মুখে কোন কথা নেই।
আপনিই মিঃ দত্ত মজুমদার? প্রশ্ন করলেন সাহুই সর্বপ্রথম।
হ্যাঁ।
উনি আপনার স্ত্রী? ঐ যে মেঝেয় পড়ে–
মেঝের দিকে তাকিয়ে একটা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল সলিল দত্ত মজুমদার, how horrible! এ কি! অনুরাধাকে অমন করে খুন করল কে? নাকি অভিমান করে অনুরাধা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাই করল?
আত্মহত্যা নয় মিঃ দত্ত মজুমদার, its a simple case of murder—diabolical murder! কিরীটী ধীরে ধীরে দত্ত মজুমদারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে গেল।
কিন্তু কে—কে হত্যা করল? কাদাঁদ গলায় বলল সলিল দত্ত মজুমদার।
সাহু এবারে বললেন, উনি আপনার স্ত্রী?
স্ত্রী–না, মানে ঠিক
স্ত্রী নন! পুনরায় সাহুর প্রশ্ন।
মানে ঠিক বিবাহিত না হলেও…স্ত্রীর মত ছিল, we used to live together!
সাহু অত্যন্ত স্পষ্টবক্তা। বললেন, মানে উনি তাহলে আপনার রক্ষিতা ছিলেন বলুন?
হ্যাঁ, মানে–স্ত্রীর মতই—
ইতিমধ্যে অনেক জোড়া কৌতূহলী চোখ ১৬নং ঘরের দরজার সামনে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছিল।
সলিল দত্ত মজুমদার বললেন, এখন আমি কি করি—অসহায় গলার স্বর।
সাহু বললেন, ইনভেস্টিগেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি এ হোটেল ছেড়ে কোথাও এক পা বাইরে যাবেন না।
কেন?
কারণ মৃত্যুর সঙ্গী ছিলেন আপনি—একমাত্র কাছের মানুষ এবং আপনারা দুজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে এই হোটলে এসে উঠেছিলেন।
না না, আমি একাই নয়, সলিল দত্ত মজুমদার বললেন, আরও একজন এই হোটেলে আছে। ১৮নং ঘরে-অনুরাধার পূর্বতন প্রেমিক।
কার কথা বলছেন?
প্রফেসর সরিৎশেখর সেন। কাল তো সকালের দিকে অনেকক্ষণ ১৮নং ঘরে দুজনে ঢলাঢলি করছিল। আর কাল তো সারাটা দুপুর ও রাত্রের দিকে আমি হোটেলেই ছিলাম না—ওরাই ছিল।