অনুরাধা কিন্তু অতঃপর সরিশেখরের দিকে এগিয়েও আসে না বা তার সঙ্গে আর কোন কথাও বলে না।
সরিৎশেখরও সে চেষ্টা করে না। সরিৎশেখর অন্য পথ ধরে ধীরে ধীরে বালুবেলায় নেমে যায়। সমুদ্রে তখন অনেক জ্ঞানার্থীর ভিড়। নানা বয়েসী নারী পুরুষ সমুদ্রের জল তোলপাড় করছে। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউগুলো এসে বালুবেলায় একটার পর একটা অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়ছে একটানা গর্জন তুলে।
সরিৎশেখর পাড়ের দিকে তাকাল—একটু আগে যেখান দিয়ে অনুরাধা ও সেই ভদ্রলোক হাত ধরাধরি করে চলে গেল তার দৃষ্টির সামনে দিয়েই।
সরিৎশেখর দেখল যে হোটেলে সে উঠেছে, ওরা সেই হোটেলেই গিয়ে ঢুকল। তাহলে অনুরাধা সে যে হোটেলে উঠেছে সেই হোটেলেই উঠেছে।
আজই সকালে পুরী এক্সপ্রেসে সরিৎশেখর পুরী এসে পৌঁছেছে। হোটেলে পৌঁছেই বের হয়ে পড়েছিল। সমুদ্রের জলে স্নান করার চাইতে ধীরে ধীরে ভেজা বালুর উপর দিয়ে হাঁটতে তার অনেক ভাল লাগে।
দীর্ঘ দুই বৎসর পরে আবার অনুরাধাকে দেখল সরিৎশেখর। হ্যাঁ, মনে মনে হিসাব করে সরিৎশেখর ঠিক দুই বৎসর পরই, সময়টা, না ভোলার কথা নয়, জীবনের একটা পরিচ্ছেদে অকস্মাৎ যেখানে দাঁড়ি পড়েছিল—সে সময়টা কি কেউ ভুলতে পারে!
সরিৎশেখরও পারে নি। সরিৎ ভেবেছিল, অনুরাধা নিশ্চয়ই কলকাতায় নেই। নচেৎ পথে কখনও না কখনও নিশ্চয়ই দেখা হত, বিশেষ করে কলেজে যাতায়াতের পথে। ঠিক ভেবেছিল নয়, মনে হয়েছিল বুঝি তার, অনুরাধা হয়ত কলকাতায় নেই। কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও হয়ত সে চলে গিয়েছে। কাউকে বিবাহ করে হয়ত সংসারও পেতেছে। অনুরাধা এখন অন্যের। তাছাড়া কলকাতায় থাকলে কখনও না কখনও নিশ্চয়ই তাদের একের সঙ্গে অন্যের দেখা হতই বিশেষ করে কলেজে যাতায়াতের পথে। কারণ ঐ পথ দিয়েই অনুরাধাও কলেজে যেত এবং প্রথম আলাপ তাদের ঐ পথ ধরে যেতে যেতেই এক হঠাৎ আসা দুর্যোগের মধ্যে।
তার আগেও অবিশ্যি সরিৎ দেখেছে অনুরাধাকে ঐ পথ ধরে যাতায়াত করতে। প্রথম আলাপের সেই দিনটাসময়টা জুলাইয়ের শেষাশেষি, কলকাতা শহরে বর্ষা নেমে গিয়েছে। যখন তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে আকাশ কালো করে। কখনও বা কম সময়, কখনও বা বেশি। সময় ধরে চলে সে বৃষ্টি। ছাতা নিয়ে সরিৎ কখনও বড় একটা বের হত না, কারণ বেরুবার সময় ছাতার কথাটা তার মনেই পড়ত না। কিন্তু সেদিন ছাতা নিয়েই সরিৎ বের হয়েছিল। আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টির সম্ভাবনাও ছিল, বোধ করি সেই আশঙ্কাতেই। মাত্র দুটো ক্লাস ছিল সরিতের সেদিন। বেলা তিনটের মধ্যে কলেজ থেকে সে বের হয়ে পড়েছিল। গড়িয়াহাটার মোড়ে বাস থেকে নেমে ও লেকের দিকে হাঁটছিল রজনী সেন স্ট্রীটে তার বাড়ি। প্রচণ্ড গরম সেদিন। আকাশে, কেমন যেন একটা থমথমে মেঘলা-মেঘলা ভাব। বৃষ্টি যে কোন মুহূর্তেই নামতে পারে। রাস্তায় বড় একটা তেমন লোকজন নেই। দোকানপাট অবিশ্যি খোলা, মধ্যে মধ্যে বাস-প্রাইভেটকারগুলো এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ প্রবল ধারায় বৃষ্টি নামল। হাতে ছাতা থাকা সত্ত্বেও সরিৎ ছাতাটা খুলবার সময় পায় না, ভিজেই যায়। তাড়াতাড়ি একটা দোকানের মধ্যে উঠে পড়ে। কারণ ও বুঝেছিল, ছাতা দিয়ে ঐ বৃষ্টির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। তার পিছনে পিছনে অনুরাধাও উঠে পড়েছিল। ছাতা সঙ্গে ছিল না তার। একটা মোটা বই ও একটা মলাট দেওয়া খাতা হাতে। চোখে সরু সৌখীন সোনালী ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচে জলের ছিটে লেগে আছে।
দুজনের চোখাচোখি হতেই অনুরাধা মৃদু সলজ্জ হাসি হাসল। সরিৎশেখরের ওষ্ঠপ্রান্তেও হাসি জাগে। অনুরাধা চশমাটা চোখ থেকে খুলে শাড়ির আঁচলে কাচটা মুছতে থাকে।– আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে তখন। সরিৎশেখর ও অনুরাধা সেদিন তখন কেউ কারও নাম জানে না। জলের প্রবল ছাটে দুজনেই ভিজে যাচ্ছিল। আর একটু দোকানের ভিতরে ঢুকে গেল তারা। বৃষ্টি ধরবার নামগন্ধ নেই।
আপনাকে প্রায়ই দেখি এই পথ দিয়ে যাতায়াত করতে সরিৎশেখরই প্রথমে কথা বললে।
অনুরাধা বললে, আপনাকেও দেখি আমি। আপনি বুঝি কাছেই থাকেন?
সরিৎশেখর বললে, রজনী সেন স্ট্রীটে–
ও মা, তাই নাকি! আমিও তো ঐ রাস্তাতেই থাকি। অনুরাধা বললে, আপনার বাড়ির কত নম্বর বলুন তো?
সরিৎ যে বাড়ির নম্বরটা বললে, তার পাঁচটা নম্বর পরের বাড়িতেই থাকত অনুরাধা। তার বাড়ি পাঁচটা নম্বর পরে হলেও, মাঝপথে একটা ছোট গলির বাঁক আছে। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িটা দেখা যায় না অবিশ্যি।
অনুরাধা আবার বললে, এ পথে যাতায়াতের সময় ছাড়াও আপনাকে আমি আর একটা বাড়িতে দেখেছি
কোথায় বলুন তো? সরিৎ শুধাল।
কেতকীদের বাড়িতে, ডোভার লেনে।
বুঝেছি—আমার পিসিমার বাড়ি। কেতকী আমার পিসতুতো বোন।
সেদিন কেতকীর জন্মদিন ছিল, অনুরাধা বললে, আমিও গেছিলাম। আপনার হাতে ছিল একটা বইয়ের প্যাকেট ও একগোছা রজনীগন্ধা।
রজনীগন্ধা কেতকীর ছিল খুব প্রিয় ফুল।
জানেন আমিও সেদিন রজনীগন্ধা নিয়ে গিয়েছিলাম। অনুরাধা বলল।
দুজনেই দুজনের দিকে চেয়ে হাসল।
বৃষ্টি থামার কিন্তু কোন লক্ষণই নেই। পথে বেশ জল জমেছে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। অনুরাধাই প্রথম উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললে, তাই তো বাড়ি যাব কি করে বুঝতে পারছি না রাস্তায় তো দেখছি এক হাঁটু জল জমে গেল।
জল ভেঙে যাবেন কি করে, এখান থেকে বেশ কিছুটা পথ–সরিৎশেখর বললে।
বুঝতে পারছি না ঠিক কি করব। চিন্তিতভাবে অনুরাধা বললে।