টক্ টক্ টক্। দরজার কবাটে মৃদু আঘাত একবার দুবার–তিনবার।
কে? অনুরাধা প্রশ্ন করল।
অনুরাধা-আমি সরিৎ–
অনুরাধা দরজাটা খুলে দিল। হুহু করে একঝলক বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে ছুটে এল। ঘরের মধ্যে ঝাপসা ঝাপসা আলো।
অনুরাধা—
এই যে আমি, এসো-অনুরাধা সরিতের দিকে এগিয়ে গেল।
এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দত্ত মজুমদার কোথায় গেলেন?
ভুবনেশ্বরে—
সেখানে কি?
বলে গেল তার অফিসের জরুরি কাজ আছে। মরুকগে সে, জান সরিৎ, একটু আগে তোমার কথাই ভাবছিলাম।
আমার কথা?
হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথাটা। সরিৎ, তুমি কি সত্যি সত্যিই আমাকে ভুলে গিয়েছ? মন থেকে তোমার একেবারে মুছে ফেলেছ?
তাই তো স্বাভাবিক অনুরাধা।
স্বাভাবিক, তাই না! আমি তো তোমাকে কই আজও ভুলতে পারিনি।
ঘরের মধ্যে ঝাপসা অন্ধকারটা আরও ঘন হয়েছে। বাইরের অন্ধকার যেন ঘরের মধ্যে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
শুনবে আমার সব কথা? অনুরাধা বললে।
শুনে কি লাভ।
তবু বোধ হয় সব কথা তোমার জানা দরকার সরিৎ–
সরিৎশেখর কোন জবাব দিল না।
অনুরাধা বলে গেল তার কথা। একটু একটু করে থেমে থেমে।
সরিৎশেখর একেবারে নির্বাক বোবা।
আমাকে আমাকে তুমি মুক্তি দিতে পার না?
কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি সলিল দত্ত মজুমদারের বিবাহিতা স্ত্রী।
ও বিবাহ তো মিথ্যা, একটা প্রতারণা।
তাই যদি মনে কর তো মুক্তি তো তোমার নিজের ইচ্ছাতে।
না, তোমার হাতে সরিৎ। তোমার হাতে। আমাকে তুমি নিয়ে চল সরিৎ দূরে, অনেক দূরে কোথাও!
আজ আর তা হয় না অনু!
আবার তোমার সেই ভয়—সেদিন যে ভয় তোমার আমাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি, আজও সেই ভয়? কেন—কেন সেদিন তুমি জোর করে আমাকে ধরে রাখলে না? কেন বলতে পারলে– না, না, তোমাকে আমি যেতে দেব না। তবে তো এই আকণ্ঠ গ্লানির মধ্যে আমাকে ড়ুবে যেতে হত না।–
অনুরাধার গলার স্বরটা যেন কেমন হয়ে এল। সরিতের মনে হল, অনুরাধা যেন কাঁদছে।
হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনুরাধা ছুটে এসে সরিশেখরের বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুহাতে প্রাণপণ শক্তিতে আঁকড়ে ধরল।
ঝড়বৃষ্টি থামেনি। থেকে থেকে সোনালী একটা চাবুকের মত অন্ধকার আকাশটা চিরে দিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, প্রবলধারায় বৃষ্টি, সোঁ সোঁ হাওয়ার গর্জন।
রাত কত হল কে জানে!
ইতিমধ্যে কিরীটী তার ঘরে বসেই কিছু খেয়ে নিয়েছে।
হাতঘড়িটার দিকে তাকাল কিরীটী। রাত দশটা পনেরো।
বোঝবার উপায় নেই এত রাত হয়ে গিয়েছে, জানলার কপাটগুলো থর থর করে কাঁপছে হাওয়ার ঝাপটায়। কি খেয়াল হল কিরীটীর, সমুদ্রের দিকের জানলাটা একবার খুলল। একটা বিদ্যুতের ঝলসানো আলোর চমক।
আর সেই ক্ষণিকের আলোয় কিরীটীর চোখে পড়ল—একটা মনুষ্যমূর্তি হোটেলে প্রবেশ করল। এই রাত্রে—এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে হোটেল থেকে কে বাইরে গিয়েছিল? নাকি কেউ এল?
কিরীটী তাড়াতাড়ি জানলার কপাট চেপে এঁটে দিল ছিটকিনিটা।
০৭. সারাটা রাত্রি বর্ষণ ও ঝড়
সারাটা রাত্রি বর্ষণ ও ঝড়ের বিরাম ছিল না। শেষরাত্রির দিকে ঝড় ও বৃষ্টির প্রকোপ কমে এল ধীরে ধীরে। কিন্তু বাতাস তখনও বেগে বইছে।
শেষরাতের দিকে বোধ করি সামান্য সময়ের জন্য চোখে একটু তন্দ্রামত এসেছিল কিরীটীর, তাটা ভেঙে গেল দরজায় করাঘাত শুনে–
রায়মশাই, রায়মশাই দরজাটা খুলুন।
হোটেলের মালিক ভবেশ অধিকারীর গলা, কিরীটী উঠে দরজাটা খুলতেই যেন একটা দমকা হাওয়ার মত ভবেশ অধিকারী ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন।
কি ব্যাপার ভবেশবাবু?
খুন—
খুন! কিরীটীর বিস্ময়-প্রশ্ন।
হ্যাঁ, খুন। ১৬নং ঘরে—
মানে আমার এই পাশের ঘরে? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন কর।
হ্যাঁ।
কে খুন হয়েছে?
অনুরাধা দেবী।
সে কি!
চলুন–
মেঝেতে পড়ে আছেন ভদ্রমহিলা, গলাটা দুফাঁক করে কাটা। কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললে, আপনি কখন দেখলেন?
সবে ঘুম ভেঙে উঠে–ভবেশ অধিকারী বললেন, ঘরের বাইরে বের হয়েছি চাকরবাকরকে জাগাব বলে, হঠাৎ ওপরের দিকে তাকাতে নজর পড়ল ১৬নং ঘরের দরজা খোলা, দরজার পাল্লা দুটো হাওয়ায় পড়ছে আর খুলছে। তাড়াতাড়ি ওপরে এলাম, ভদ্রমহিলার স্বামী নেই, কাল কাজে ভুবনেশ্বরে গিয়েছেন, উনি একা ছিলেন, তাই আমাকে বলে গিয়েছিলেন একটু নজর রাখতে ওঁর ওপরে! এখন কি হবে রায়মশাই!
ওঁর স্বামী রাত্রে ফেরেননি?
না, আজ দুপুরে ফিরবার কথা, আজকের এক্সপ্রেসেই চলে যাবেন ওঁরা।
ভবেশ অধিকারী আবার বলতে লাগলেন, এবারে আর হোটেলটা টিকিয়ে রাখতে পারব না। হোটেল এবার উঠেই যাবে। তিন বৎসর আগে এক ভদ্রলোক গলায় ক্ষুর চালিয়ে ১৭নং মানে এই ঘরে আত্মহত্যা করেছিলেন, সেই ঘটনার পর হোটেল প্রায় উঠেই যেতে বসেছিল, এবার হয়েছে খুন–
দুর্ঘটনার জন্য তো আর আপনি দায়ী নন ভবেশবাবু, কিরীটী বলল।
সে কথা লোক কি বুঝবে। হোটেলের নামে দুর্নাম রটে যাবে। এতদিনের ব্যবসা-সর্বনাশ হয়ে গেল আমার রায়মশাই!
চলুন একবার পাশের ঘরে কিরীটী বলল।
আকাশ তখনও মেঘাচ্ছন্ন, বৃষ্টি না থামলেও হাওয়া বইছে এলোমেলো। সমুদ্র আথালিপাথালি করছে, বড় বড় ঢেউ তীরের উপর এসে ভেঙে ভেঙে পড়ছে। হোটেলের বাসিন্দারা তখনও কেউ ওঠেনি। পাশের ঘরে অর্থাৎ ১৬নং ঘরে এসে ঢুকল কিরীটী খোলা দরজাপথে। হাওয়ার দাপটে দরজায় পাল্লা দুটো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে! ঘরের মধ্যে আলোটা জ্বলছে। সেই আলোতেই কিরীটীর ভয়াবহ সেই দৃশ্যটা নজরে পড়ল। ঘরের মেঝেতে জমাট বাঁধা রক্তের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে অনুরাধার দেহটা, ঘাড়ে একটা চারইঞ্চি পরিমাণ গভীর ক্ষত, —হাঁ হয়ে আছে। বুঝতে কষ্ট হয় না কোন ধারাল অস্ত্রের সাহায্যে আততায়ী পশ্চাৎ দিক থেকে মেয়েটিকে মোক্ষম আঘাত হেনেছে। এবং সে আঘাতের ফলে মৃত্যু ঘটেছে।