পাশের ১৭নং ঘরে ছিল কিরীটী। পাশের ১৬নং ঘরের দেওয়াল ভেদ করে যেন সলিল দত্ত মজুমদারের প্রত্যেকটি কথা স্পষ্ট তার কানে যাচ্ছিল। আর একজনও শুনতে পাচ্ছিল—চন্দ্রকান্ত ঘাই, একটু আগে যে ১৫নং ঘরে এসে ঢুকেছে। তারও কানে যায় কথাগুলো। সে দেওয়ালে কান পেতে দাঁড়ায়। ঐ গলাটা তার চেনা। তাহলে এই হোটলের ঠিক পাশের ঘরেই ঐ লোকটা এসে উঠেছে! চন্দ্রকান্ত ঘাই মনে মনে হাসে। সংবাদটা তাহলে মিথ্যা নয়? চন্দ্রকান্ত ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল। তারপর পকেট থেকে একটা বিড়ি নিয়ে দেশলাই দিয়ে বিড়িটা ধরাল। তারপর যেন পরম নিশ্চিন্তে বিড়িটায় সুখটান দিতে লাগল।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনুরাধা বলল, আমি আজকের ট্রেনেই কলকাতায় ফিরে যাব।
কি বললি! ফিরে যাবি?
ভদ্রভাবে কথা বলুন, অনুরাধা বলল! নতুবা এখুনি আমি নীচে গিয়ে তোক জড়ো করব—থানায় যাব।
জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন হঠাৎ গুটিয়ে যায়, থানার নাম শুনে সেও যেন চুপসে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বার দুই কেবল হেঁচকি তুলল উ উ শব্দে।
আমি নীচে গিয়ে লোক জড়ো করে তাদের বলব, আপনি আমাকে জোর করে এখানে ধরে রেখেছেন—
তুমি আমার স্ত্রী-মিনমিনে গলায় সলিল দত্ত মজুমদার বললে।
না, কোন দিনই আপনার স্ত্রী ছিলাম না, আজও নই।
কিন্তু আমাদের বিয়ে হয়েছে–
সে বিয়ে আইনত অসিদ্ধ, আদালতে গেলেই তা প্রমাণ হবে। অনুরাধা যেন কুঁসছিল। আরও সে কিছু বলত কিন্তু বন্ধ দরজার গায়ে করাঘাত পড়ল।
দত্তবাবু, দত্তবাবু–
কে?
আমি চাদু, হোটেলের বেয়ারা।
সলিল উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল, কি চাই?
ম্যানেজারবাবু বলে পাঠালেন, আপনার ট্যাক্সি ঠিক হয়ে গিয়েছে। ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞাসা করছে আপনি কখন বেরুবেন।
চল, আমি নীচে যাচ্ছি।
০৬. অনুরাধা খোলা জানলাটার সামনে
অনুরাধা খোলা জানলাটার সামনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল।
কালো মেঘ ক্রমশ আকাশে স্থূপীকৃত ও ঘনীভূত হচ্ছে, মনে হয় এবারে হয়তো বৃষ্টি নামবে। একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাবও পাওয়া যাচ্ছিল সমুদ্রের বাতাসে।
একটা বিশ্রী তিক্ততায় অনুরাধার মনটা যেন ভরে গিয়েছে। একটা কথাই তার কেবলই মনে হচ্ছিল, এখানে এই মানুষটার সঙ্গে এক মুহূর্ত আর নয়, এখুনি এই মুহূর্তে চলে যেতে পারলে যেন ভাল হয়।
সলিল দত্ত মজুমদার এসে ঘরে ঢুকল। অনু—
গলার স্বর তার সম্পূর্ণ পালটে গয়েছে, এ যেন সে মানুষ নয়। সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। সলিল আরও একটু কাছে এগিয়ে এল অনুরাধার-I am really sorry অনু, আমাকে ক্ষমা কর।
অনুরাধা চেয়ে আছে নিঃশব্দে তখনও জানালা-পথে বাইরের দিকে। একেবারে যেন বোবা অনুরাধা। ফিরেও তাকাল না সলিলের দিকে!
হঠাৎ যেন কেমন রাগ চড়ে গেল অনু, কতকগুলো কটু কথা—
অনুরাধা পূর্ববৎ নীরব। জানলা-পথে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে।
আমাকে ক্ষমা কর অনুরাধা, ক্ষমা চাইছি, তোমায় কথা দিচ্ছি আর এমনটি কখনও হবে না। তাকাও, please, আমার দিকে তাকাও।
অনুরাধা তথাপি ফিরে তাকায় না।
তুমি কেন ঐ লোকটার ঘরে গেলে, ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে—তাইতেই তো হঠাৎ রাগ চড়ে গেল আমার, সলিল দত্ত মজুমদার আবার বললে।
অনুরাধা এতক্ষণে ফিরে তাকাল, বলল, আমি আজকের এক্সপ্রেসেই ফিরে যেতে চাই
আমাদের রিটার্ন টিকিট তো কালকের, আজ ফিরব কেমন করে? তাছাড়া আমার অফিসের একটা জরুরি কাজ আছে, আমি ভুবনেশ্বরে যাচ্ছি। কাল দশটার মধ্যেই ফিরে আসছি, কালই যাব আমরা।
অনুরাধা কোন কথা বলল না।
আমি বেরুচ্ছি, নীচে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, আর আমার সঙ্গে যদি তুমি ভুবনেশ্বরে যেতে চাও তো–
না, আমি যাব না।
অনুরাধা তখন ভাবছে, অন্তত একটা রাত তাকে ঐ জানোয়ারটার পাশে শুতে হবে না, ওর পশু-কামনাকে চরিতার্থ করতে হবে না তাকে।
তাহলে থাক তুমি, আমি চললাম। সলিল দত্ত মজুমদার বের হয়ে গেল।
জানালা-পথে একটু পরেই অনুরাধা দেখতে পেল ট্যাক্সিটা হোটেলের সামনে থেকে চলে গেল সলিল দত্ত মজুমদারকে নিয়ে।
এতক্ষণে যেন বুকভরে একটা হালকা নিঃশ্বাস নিল অনুরাধা।
১৮নং ঘরে সরিৎশেখর নিঃশব্দে জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে, কালো মেঘের ছায়া পড়েছে সমুদ্রের বুকে। এবারে বৃষ্টি নামবে-সমস্ত আয়োজন তার শেষ। বিদ্যুৎ চমকাল। এলোমেলো ঠাণ্ডা হাওয়া সনসন করে বয়ে এল ঘরের মধ্যে। মনে পড়ে গেল আবার সরিশেখরের অনুরাধার সেই কথাটা—আজ ২৯শে জুলাই। ২৯শে জুলাই তার পরিচয় অনুরাধার সঙ্গে, দুজন দুজনকে জেনেছিল প্রথম। মনে পড়ে সরিশেখরের সেদিনের সেই ২৯শে জুলাই ছিল মঙ্গলবার। সরিতের এক বন্ধু হিমাংশু, তার গণনার বাতিক ছিল, ওকে একদিন হিমাংশু বলেছিল, মঙ্গলবারটা সব সময় এড়িয়ে যাবি সরিৎ, মঙ্গলে তোর জন্ম, সেদিন ছিল রাহু আর শনি মুখখামুখি, কোন ভাল কাজ ঐ মঙ্গলবারে করবি না, তোর পক্ষে সবচাইতে ভাল রবিবারটা।
হেসেছিল সরিৎশেখর। বলেছিল, বোগাস!
আজ হঠাৎ মনে পড়ছে সেদিনের সেই ২৯শে জুলাই ছিল মঙ্গলবার।
একটা আবছা পর্দা দুলতে দুলতে সাগরের মাথা ছুঁয়ে এগিয়ে আসছে। বৃষ্টি নেমেছে, বৃষ্টির ধারা ছুটে আসছে। একটু আগে সরিৎ দেখেছে সলিল দত্ত মজুমদার একটা গাড়িতে চেপে বের হয়ে গেল।
অনুরাধা ভাবছিল, এই শেষ। সলিল দত্ত মজুমদারের সঙ্গে তার সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছাড়বে কি সলিল দত্ত তাকে? যেতে কি দেবে তাকে? অনুরাধা জানে, দেবে না সলিল—অত সহজে সলিল তাকে মুক্তি দেবে না। সে তার হিংস্র নিষ্ঠুর থাবা দিয়ে অনুরাধাকে তার কাছে রাখবার চেষ্টা করবে। ঐ মানুষটার সঙ্গে তার রাতের পর রাতের স্মৃতিসেই কামনাসিক্ত হিংস্র একটা জানোয়ারের মত রাতের পর রাত তার দেহটাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। যন্ত্রণায় সে কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠেছে। একটির পর একটি রাত গিয়েছে আর মনে মনে মুক্তির জন্য হাঁসফাঁস করেছে সে। একটা কথা মনে পড়ল হঠাৎ অনুরাধার। কটক স্টেশন থেকে একটা ছুরি কিনেছে সে। সুদৃশ্য হরিণের সিংয়ের বাঁট আর ইস্পাতের ফলাটা চকচক করছে, সুটকেসেই আছে ছুরিটি। সুটকেসটা খুলে অনুরাধা ছুরিটা বের করল। ছুরিটা হাতে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। সলিল যদি আবার তার কাছে আসতে চেষ্টা করে, জোর-জার করে, এই ছুরিটা,সমূলে সে বসিয়ে দেবে তার বুকে না হয় পেটে।