আমি জানতে চাই সলিল, মুকুল কোথায়? পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন।
আমি তোমার প্রশ্নের কোন জবাব দেব না জীমূতবাহন—
দিতে তোমাকে হবে, মুকুল আমার বোন—তোমার বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে সে নেই, সেখানে অন্য ভাড়াটে–
সে আমার স্ত্রী, আমার স্ত্রী সম্পর্কে সব কিছু তোমার এক্তিয়ারের বাইরে—
হ্যাঁ, স্ত্রীর মর্যাদা তো তাকে যথেষ্ট দিয়েছ!
এখান থেকে চলে যাও—
জবাব না নিয়ে আমি যাব না। আমি জানতে চাই, তুমি আবার বিয়ে করেছ কিনা?
আমি আবার বিয়ে করেছি? হ্যাঁ করেছি।
তবে শুনে রাখ, I shall drag you to the court. পলিগেমির শাস্তি কি সেটা জানতে তোমার দেরি হবে না।
I say get out—দত্ত মজুমদারের হাতে পিস্তল, তার ড্রয়ারে সব সময়ই একটা পিস্তল থাকত, সেটা তখন তিনি বের করেছেন Get out of this room!
ঠিক আছে আমি যাচ্ছি, তবে আবার আমাদের দেখা হবে, লোকটা চলে গেল।
পাশের ঘরে অনুরাধার মাথাটা তখন ঘুরছে। পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। একটু একটু করে নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা অফিস থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিল অনুরাধা।
রাত তখন দশটা।
রজনী সেন স্ট্রীটের বাড়িতে তার ঘরে ঝিম মেরে বসে ছিল অনুরাধা।
ঝি বেলার মা সেদিন আবার কাজে আসেনি, সে-ই রান্না করে রেখে যেত, ঐ দিন রাত্রে স্থির ছিল বাইরের হোটেলে সে ও দত্ত মজুমদার ডিনার করবে।
সিঁড়িতে জুতোর শব্দ।
ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল। দত্ত মজুমদার এসে ঘরে ঢুকলেন, অনু—
ফ্যাকাশে অসহায় বোবা দৃষ্টি তুলে তাকাল অনুরাধা দত্ত মজুমদারের দিকে।
তুমি হঠাৎ অফিস থেকে আমায় না বলে চলে এলে কেন অনু? চল চল, ডিনার খেতে যাবে না?
না। তারপরই অনুরাধা বললে, তুমি–তুমি বিবাহিত?
কে বললে?
যেই বলুক কথাটা সত্যি কিনা তাই শুধু জানতে চাইছি!
না, সত্যি নয়—
সত্যি নয়? তুমি বিবাহিত নও—তোমার স্ত্রীর নাম মুকুল নয়?
হ্যাঁ, তার নাম মুকুলই ছিল। মানে অনেককাল আগে একজনকে বিয়ে ঠিক নয় লাইফ কম্প্যানিয়ান হিসাবে ছিল, সেই মুকুল।
ছিল মানে?
সে বেঁচে নেই। দুই বৎসর আগে তার মৃত্যু হয়েছে, She is dead.
আমি কথাটা বিশ্বাস করি না। তুমি মিথ্যুক—
আমার কথা তুমি বিশ্বাস করো না রাধা?
না—না—না–করি না, তুমি চলে যাও–
কেন কেলেঙ্কারি করবে, নীচের ভাড়াটেরা সব জেনে যাবে, চল আমার পার্ক স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে চল।
না, যাব না আমি।
দুজনের মধ্যে মনোমালিন্যের সূত্রপাত ওখানেই।
যায়নি সেদিন অনুরাধা সলিল দত্ত মজুমদারের পার্ক স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে। কিন্তু তারপর কটা দিনই বা, নিজের অপমান লজ্জা ও কেলেঙ্কারির ভয়ে অনুরাধাকে কয়েকদিন পরেই আবার। সলিল দত্ত মজুমদারের ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকতে হয়েছিল। কিন্তু মনের মধ্যে যে চিড় খেয়েছিল সেটা আর জোড়া লাগল না। ক্রমশ সেটা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে চলেছিল। একটা অজগর যেমন তার শিকারকে গ্রাস করে, দত্ত মজুমদার যেন তেমনি করেই তাকে গ্রাস করেছিল। বের হয়ে আর আসতে পারেনি অনুরাধা সেই গ্রাস থেকে।
কিন্তু আজ আজ আবার অনেক দিন পরে সরিৎকে দেখে অনুরাধার মনের মধ্যে যেন–একটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। সে যেন এই দুর্বিসহ বন্দী জীবন থেকে বেরুবার একটা ইঙ্গিত পেয়েছে। মনের কোথায় যেন একটা মুক্তির বাঁশি শুনতে পেয়েছে।
তার এই দুই বৎসরের বন্দীজীবনে কতবার ভেবেছে সরিৎশেখরের কাছে সে ছুটে যায়, কিন্তু কেন যেন সাহস হয়নি।
ঐ দত্ত মজুমদার মানুষটা হয়তো তাহলে সরিৎশেখরকেও নিষ্কৃতি দেবে না, ভয়ংকর চরিত্রের ঐ মানুষটা, ওকে বিশ্বাস নেই।
অনুরাধা মনে মনে স্থির করে, আজ সে বলবে, সরিৎকে সব কথা বলবে। বলবে, বাঁচাও আমাকে সরিৎ, আমাকে বাঁচাও। বালুর উপর বসেছিল অনুরাধা, উঠে দাঁড়াল, হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা একটা বেজে গিয়েছে। সূর্য দেখা যাচ্ছে না, আকাশে মেঘ জমেছে, একটা কালো শান্ত ছায়া যেন আকাশ ও সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। অনুরাধা আবার হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
অনুরাধা যখন হোটেলের ১৬নং ঘরে এসে ঢুকল, সলিল দত্ত মজুমদার তখন একটা চেয়ারে বসে ঐ দ্বিপ্রহরে নির্জলা হুইস্কি পান করছিল। কাল রাত্রে যে বোতলটা খুলেছিল, আজ দুপুরের আগেই সেটা প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে।
অনুরাধাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সলিল দত্ত মজুমদার ওর দিকে চোখ তুলে তাকাল। চোখ দুটো লাল, মাথার চুল রুক্ষ।
এতক্ষণ কোথায় ছিলে? সলিল প্রশ্ন করল।
অনুরাধা কোন জবাব দিল না।
আমার কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন হারামজাদী! কথার জবাব দে—যেন একটা বিষাক্ত কেউটে রাগে হি হি করে।
অনুরাধা নির্নিমেষ চেয়ে আছে ঐ লোকটার দিকে।
পুরানো নাগর দেখে পীরিত উথলে উঠেছিল, তাই না? আবার গর্জে উঠল সলিল দত্ত মজুমদার, জবাব দে।
মনে রাখবেন এটা হোটেল। পাশের ঘরে লোক আছে।
Shut up! চেঁচিয়ে উঠল সলিল দত্ত মজুমদার।
অনুরাধা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সলিল দত্ত মজুমদার চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়া, এক পা এগুবি তো কুকুরের মত গুলি করে মারব। হারামজাদী, বেশ্যা!
কি কুৎসিত দেখাচ্ছিল দত্ত মজুমদারের মুখটা, যেন একটা কালো নেকড়ে বাঘ। রক্তাক্ত চোখের চাউনি থেকে যেন কুটিল হিংস্রতা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে অনুরাধা লোকটার মুখের দিকে নির্বাক তাকিয়েছিল, ঘৃণায় লজ্জায় যেন অনুরাধা ঐ মুহূর্তে পাথর হয়ে গিয়েছে। এইটাই বোধ করি ঐ মানুষটার সত্যিকারের পরিচয়।..