একটা তিক্ত হিংসা যেন সলিল দত্ত মজুমদারের বুকের মধ্যে আঁচড়ে আঁচড়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এখনও সরিৎশেখরের ঘরেই অনুরাধা।
অনুরাধা যদি নাই জানত সরিৎশেখর আসবে—তবে তার ঘরে গেল কেন।
যাবে নাকি ১৮নং ঘরে, অনুরাধার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসবে?
০৫. এক সময় থমকে দাঁড়াল অনুরাধা
এক সময় থমকে দাঁড়াল অনুরাধা।
সমুদ্রের নির্জন তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ইতিমধ্যে কখন যেন সে হোটেল থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে, এখন বাঁয়ে অশান্ত কল্লোলিত সমুদ্র একটানা গর্জন করে চলেছে, অন্যদিকে ধু ধু বালিয়াড়ি, কোন লোকালয়ের চিহ্নমাত্রও নেই। ভিজে বালির উপর দিয়ে হাঁটছিল অনুরাধা। এবারে সেখানেই বসে পড়ল, পা দুটো ক্লান্ত। মধ্যে মধ্যে ঢেউগুলো এসে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মাথায় আঁচলটা ঘোমটার মত তুলে দিয়ে চপ্পলজোড়া পা থেকে খুলে হাতে তুলে। নিয়েছিল অনুরাধা। রৌদ্রের তাপটা যেন কেমন এখন ঝিমিয়ে এসেছে। আকাশের দিকে তাকাল অনুরাধা, সেই হাল্কা ইতস্তত ছড়ানো টুকরো টুকরো মেঘগুলো কখন যেন পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে আর অনেকখানি আকাশের গায়ে জুড়ে বসেছে। কি ভেবে ফিরল অনুরাধা। আর এগুনো হয়ত ঠিক হবে না।
এ দুই বৎসর অনুরাধাদের সংসারেরও অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আকস্মিকভাবেই বৎসরখানেক আগে মধুছন্দার বিয়েটা হয়ে গেল। রিটায়ার্ড জজ যোগেশবাবু হাঁটতে হাঁটতে লেক থেকে ফিরবার পথে অনেক দিন মধুছন্দাকে দেখেছেন, কারণ তার বাড়িও ছিল ঐ রজনী সেন স্ট্রীটেই! একমাত্র ছেলে তার ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনিয়ার, ভিলাইতে চাকরি করছিল, স্ত্রীর অনেক দিন আগেই মৃত্যু হয়েছিল, ছেলে যেবার আই. আই. টি.-তে ভর্তি হয়। সংসারে বাপবেটা ছাড়া কোন তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না। ছেলের বিবাহ দেবেন বলে যোগেশবাবু পাত্রী দেখছিলেন, মধুছন্দাকে দেখে তার ভাল লাগে, তিনি নিজে তার মা সরোজিনীর সঙ্গে দেখা করে বিবাহের প্রস্তাব তোলেন।
মা-ও হাতে স্বর্গ পান। তাছাড়া কিছুদিন থেকে পেটের একটা যন্ত্রণায় মা খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন, প্রায়ই শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হত তাকে এবং আরও একটা কথা—অনুরাধার কথা ভেবে তার মনের সমস্ত শান্তি চলে গিয়েছিল। মেয়ে অনু চাকরি নেবার কয়েক মাস পর থেকেই যেন তার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে শুরু করেছিলেন ওদের মা সরোজিনী দেবী।
অনুরাধা প্রায়ই তার অফিসের বড় সাহেবের সঙ্গে আজ দিল্লী, পরশু বোম্বাই, তরশু মাদ্রাজ যেতে শুরু করল কখনও সাত দিন, কখনও দশ দিন পরে ফিরত। অবিবাহিতা বয়সের মেয়ে, আদৌ ভাল লাগছিল না ব্যাপারটা সরোজিনীর। একদিন আর না থাকতে পেরে প্রশ্নই করলেন, অনু, সরিৎকে আর দেখি না কেন রে? সেই যে যার সঙ্গে তোর পরিচয় ছিল, এখানে প্রায়ই আসত–
তা আসে না কেন আমি জানব কি করে।
সরিৎ তো তোকে বিয়ে করবে বলেছিল—
সে বিয়ে হবে না।
বিয়ে হবে না? কেন? সে বলেছে বিয়ে করবে না?
না—আমার বস দত্ত মজুমদার চান না তার সঙ্গে আমি কোন সম্পর্ক রাখি।
সে আবার কিরকম কথা?
মিঃ দত্ত মজুমদারকেই আমি বিয়ে করছি—
দত্ত মজুমদারকে বিয়ে করবি? লোকটার তো অনেক বয়েস হয়েছে বলছিলি!
তাতে কি হয়েছে, ব্যাচিলার এখনও।
সরোজিনীর ব্যাপারটা আদৌ ভাল লাগল না, কিন্তু তিনি আর কোন কথা বললেন না।
সরিৎশেখর যে গত দুই বৎসর অনুরাধাকে কখনও পথে যেতে আসতে দেখেনি তার কারণ সে দত্ত মজুমদারের গাড়িতেই সর্বদা যাতায়াত করত। সকালে দত্ত মজুদারের গাড়ি এসে তাকে নিয়ে যেত, ফিরে আসতে আসতে প্রায়ই রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা হয়ে যেত।
সরোজিনী মেয়েকে কখনও আর কোন প্রশ্নই করেননি। অনুরাধা অফিসে চাকরি করে, মোটা মাইনে পায়, নিত্য নতুন দামী দামী শাড়ি ব্লাউজ—সবই দেখতেন সরোজিনী, কিন্তু কোন কথা বলতেন না। তবে মেয়ের হালচাল দেখে অনেক কিছুই অনুমান করতে তার কষ্ট হয়নি। তাই যোগেশবাবুর প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হয়ে গেলেন সরোজিনী। পরের মাসেই মধুছন্দার বিবাহ হয়ে গেল। সে চলে গেল তার স্বামীর কাছে দিল্লীতে। সেই মধুছন্দাই দিন কয়েকের জন্য কলকাতায় এসে তার মাকে দিদি সম্পর্কে অনেক কথা বলে গেল।
বললে, সবাই জানে মা, দিদির দত্ত মজুমদারের সঙ্গে বিয়ে হয়নি।
বিয়ে হয়নি!
না। আমি ভাল করে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, দিদি দত্ত মজুমদারের রক্ষিতার মত আছে। দত্ত মজুমদারের স্ত্রী আছে। তাহলেই বুঝে দেখ ব্যাপারটা।
সরোজিনী অস্ফুট একটা চিৎকার করে উঠলেন, মধু!
হ্যাঁ মা, ঐ দত্ত মজুমদারটা একটা স্কাউড্রেল—
সরোজিনী যেন পাথর হয়ে গেলেন। অনুরাধা সে-সময় কলকাতায় ছিল না। দিল্লীতেই ছিল। চার দিন পরে অনুরাধা যখন ফিরে এল, ব্যথায় সরোজিনী শয্যাশায়ী। সলিল দত্ত মজুমদার সব শুনে অনুরাধাকে পরামর্শ দিলেন, মাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করে দাও-খরচপত্র যা লাগে। আমিই দেব।
কি জানি কেন অনুরাধা আর কোন আপত্তি করল না। সরোজিনীও আপত্তি করলেন না। কিন্তু নার্সিং হোমে পেট ওন করে দেখা গেল ক্যানসার। এবং রোগ তখন অনেক ছড়িয়ে গিয়েছে, করবার আর কিছু নেই।
তিন মাস বাদে ঐ নার্সিং হোমেই সরোজিনী শেষ নিঃশ্বাস নিলেন। এবং তারই কিছুদিন পরে সেই বিচিত্র ঘটনাটা ঘটল।
এক শনিবার বেলা তখন সোয়া তিনটে হবে, অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। অনুরাধা ঘরে একা বসে একটা চিঠি টাইপ করছিল। পাশেই দত্ত মজুমদারের ঘরে একটা তর্কাতর্কি চেঁচামেচি তার কানে এল। কড়া-গলায় দত্ত মজুমদার ও অন্য এক ব্যক্তি পরস্পরের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছেন।