প্রশ্নটা কেন জানি সরিতের মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগল। হাতে ধরা সিগ্রেটটা। পুড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।
অনুরাধা হেঁটে চলছিল।
পায়ের তলার বালি ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। তপ্ত বালুকা থেকে যেন একটা তাপ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, সমুদ্রের এলোমেলো হাওয়ায় গায়ের কাপড় ঠিক থাকে না।
আজ ২৯শে জুলাই। যেদিন প্রথম সরিতের সঙ্গে ওর আলাপ সেদিনও ছিল ২৯শে জুলাই, প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়েছিল সেদিন কলকাতা শহরে। চলতে চলতে অন্যমনস্ক ভাবে অনুরাধা একবার আকাশের দিকে তাকাল, কয়েকটা পাতলা মেঘ ভাসছে আকাশে। ঐ ধরনের মেঘে বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টি নামলে কিন্তু বেশ হত। নামবে কি বৃষ্টি কে জানে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছিল অনুরাধা।
কিন্তু তবু একবারও হোটেলে ফেরার কথাটা তার মনে হয় না।
কি হবে হোটেলে ফিরে? এতক্ষণে হয়ত মানুষটা ফিরে এসেছে। ঘরে ঢুকলেই তো তাকে সেই মানুষটার মুখখামুখি হতে হবে। অসহ্য-অসহ্য হয়ে উঠেছে যেন।
অথচ নিষ্কৃতি নেই তার, মুক্তি নেই ঐ মানুষটার বন্ধন থেকে। আজ বুঝতে পারছে যেন অনুরাধা, ঐ লোকটাকে কোন দিন সে কামনা করেনি। কোন দিন সহ্য করতে পারেনি, অথচ ওর হাত থেকে মুক্তিরও কোন পথও জানা নেই তার।
হোটেলের ম্যানেজার দেবেশ অধিকারী বড় একটা বাঁধানোে খাতায় ঝুঁকে পড়ে গত মাসের হোটেলের প্রত্যেক দিনের খরচ-খরচাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। রীতিমত লাভবান ব্যবসাটা, প্রতি বছর লাভের অঙ্কটা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আজকাল প্রায়ই একটা চিন্তা দেবেশের মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করে—আর একটা হোটেল খুললে কেমন হয়। ছোট ভাই বারানসীতে এম. কম. পাস করে ব্যাংকে একটা চাকরি পেয়েছে বটে কিন্তু কি-ই বা এমন রোজগার করে, ও চাকরি ছেড়ে দিয়ে হোটেলে বসলে অনেক উপার্জন করতে পারবে।
দেবেশ ভাইকে কথাটা অনেকবার বলেছেন কিন্তু সে কান পাতেনি।
একটা জুততার শব্দে মুখ তুলে তাকালেন দেবেশ।
দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি সামনে দাঁড়িয়ে! হাতে একটা ছোট চামড়ার সুটকেস, অনেক দিনের পুরাতন। একমাথা ঝাকড়া পাকা চুল, একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি। চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা। পরনে একটা নোংরা টেরিলিনের প্যান্ট ও গায়ে অনুরূপ একটা টেরিকটের হলদে রঙের শার্ট।
কি চাই?
এ হোটেলে একটা আলাদা ঘর পাওয়া যাবে?
কোথা থেকে আসছেন?
কলকাতা থেকে ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরটা যেন কেমন ভাঙা ভাঙা, একটু কর্কশও।
কিন্তু এ সময় কলকাতা থেকে কিসে এলেন?
কেন ট্রেনে?
এসময় কোন্ ট্রেনে?
এত, প্রশ্ন করছেন কেন বলুন তো, জায়গা আছে কিনা তাই বলুন।
কদিন থাকবেন? ভবেশ অধিকারী আবার প্রশ্ন করেন।
এক মাস থাকতে পারি, সাত দিনও থাকতে পারি, এক দিন বা এক ঘণ্টাও থাকতে পারি, আপনি ফু চার্জ করবেন দেব-ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে বিরক্তি।
দেবেশ অধিকারী তখনও তাকিয়ে আছেন আগন্তুকের দিকে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। ৬৪। ৬৫ তো হবেই—এক আধ বছর বেশী হওয়াও আশ্চর্য নয়। হাফহাতা টেরিটের শার্টের বাইরে দুটো রোমশ বাহুঁ। তামাটে বর্ণ, এককালে হয়ত ভদ্রলোকের গায়ের রঙ ফর্সাই ছিল, এখন পুড়ে গিয়েছে।
এক সপ্তাহের ভাড়া জমা দিতে হবে—শুধু থাকবেন না খাওয়া-দাওয়া করবেন?
রুম-সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে?
আছে।
তাহলে ফুডিং লজিং এক সপ্তাহের জন্য কত চার্জ পড়বে?
ত্রিশ টাকা করে রোজ—সাত দিনে–
দুশো দশ তো—এই নিন—ভিতরের পকেট থেকে একটা বহু পুরাতন ম্যানিব্যাগ বের করল আগন্তুক এবং তার ভিতর থেকে একশো টাকার দুটো ময়লা নোট ও ততোধিক ময়লা দশ টাকার একটা নোট বের করে দিল।
মালপত্র আর নেই? খাতায় টাকাটা জমা করে ভবেশ অধিকারী বললেন।
না।
গোপী, এই গোপী—ভবেশ অধিকারী চিৎকার করে ডাকলেন।
গোপী রান্নাঘরে বসে আলু কাটছিল, এসে সামনে দাঁড়াল। কহন্তু—
এই ভদ্রলোককে ১৫নং ঘরটা খুলে দে।
গোপী আগন্তুকের দিকে তাকাল, তারপর বলল, আসুচি–গোপী চলে গেল।
নামধামটা এই খাতায় লিখে দিন স্যার।
লিখতে আমি পারি না—ভদ্রলোক বলেন।
পারেন না, না লেখাপড়া জানেন না?
জানি, কিন্তু লিখতে পারি না।
কেন?
নিউরস্থানিয়ায় ভুগছি, গত তিন বৎসর থেকে কলম ধরতে পারি না। লিখে নিন না—চন্দ্রকান্ত ঘাঁই। পুরী ফ্রম ক্যালকাটা টু ব্যাক ক্যালকাটা।
আগন্তুকের দিকে একবার তাকিয়ে খাতায় লিখে নিলেন দেবেশ অধিকারী।
গোপী এসে বললে, চল বাবু।
ভবেশ অধিকারী খাতায় সময় লিখলেন, বেলা বারোটা চল্লিশ।
চন্দ্রকান্ত গোপীকে অনুসরণ করল। মাঝখানের বাঁধানো চত্বরটা পার হয়ে বাঁদিক দিয়ে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি—আগে আগে গোপী, তার পশ্চাতে চন্দ্রকান্ত সিঁড়িতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দেবেশ অধিকারী কিন্তু তখনও ভাবছেন, কোন্ ট্রেনে ভদ্রলোক এলেন? জগন্নাথ এক্সপ্রেস খুব ভোরে এসে পৌছায়, পুরী এক্সপ্রেস সকাল আটটা সোয়া আটটায় পৌঁছায়, বড় জোর লেট থাকলে নটা। এখন পৌনে একটা বেজে গিয়েছে। ভদ্রলোক কি এ হোটেলে আসার আগে অন্যান্য হোটেলে ঢুঁ মেরে দেখছিলেন ঘর পাওয়া যায় কিনা।
সলিল দত্ত মজুমদার ১৬নং ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন আর বিরক্তির সঙ্গে চিন্তা করছিলেন।
ঐ সরিৎশেখর লোকটা হঠাৎ এখানে কেন এসে উঠল? অনুরাধার পূর্ব প্রণয়ী? ব্যাপারটা কি একান্ত আকস্মিক, না পূর্বের পরিকল্পনামতো লোকটা এখানে এসেছে, তাও রয়েছে ১৮নং ঘরে। অনুরাধা তো জানতই তারা পুরীতে আসছে, হয়ত অনুরাধাই জানিয়ে দিয়েছিল তাকে। এখন তো বোঝাই যাচ্ছে, এই দুই বৎসরেও অনুরাধা সরিৎশেখরকে ভোলেনি। আর সরিৎশেখরও অনুরাধাকে ভোলেনি।