চশমা চোখ থেকে খোলেনি সে?
না। কেবল বেশভূষায় দুজনের পার্থক্য, ভদ্রলোকের পরনে দামী স্যুট, যে ধরনের দামী স্যুট ক্ষিতি জীবনে কখনও পরা তো দূরে থাক, তার কল্পনারও বাইরে, এবং দুজনের গলার স্বর ও দাঁড়াবার ভঙ্গিটাও সম্পূর্ণ এক।
তারপর? কিরীটীর কণ্ঠস্বরে বেশ একটা কৌতূহল।
ক্ষিতির সে-সময়কার চোখমুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল, ক্ষিতি বোধ হয় সত্যিই তাকে চেনে না। তার কথার মধ্যে মিথ্যা ছিল না! যাক তারপর যা বলছিলাম, মৃদু হেসে জীমূতবাহন বললেন, তাহলে আর কি হবে, চিনতেই যখন আমায় পারলে না, কি আর বলব। মিলিও হয়ত তোমারই মত আজ আমায় চিনতে পারবে না, আমি কিন্তু তোমাকে ভুলিনি ক্ষিতীন্দ্র, আর তাকেও না। আচ্ছা চলি ক্ষিতীন্দ্র, গুড নাইট।
জুতোর শব্দ তুলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন আগন্তুক। এতক্ষণ আগন্তুককে একদৃষ্টে দেখছিলাম, এবার আমার সামনে চৌকির উপরে উপবিষ্ট ক্ষিতির দিকে তাকালাম। মনে হল ক্ষিতি যেন কেমন একটু অন্যমনস্ক, তার দুচোখের দৃষ্টি যেন বাইরের অন্ধকারে নিবদ্ধ।
বাইরে শীতের রাত তখন ঝিমঝিম করছে। আর জামসেদপুরে শীতও সেসময় প্রচণ্ড। একেবারে যাকে বলে হাড় কাঁপানো শীত।
খেলা তো আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাসগুলো তখনও সামনে তেমনি ছড়ানো পড়ে আছে। হঠাৎ ক্ষিতি উঠে পড়ল, চলি রে বন্ধু
বললাম, সে কি! খেয়ে যাবি না? কড়াইশুটির খিচুড়ি, ফুলকপি ভাজা করছেন তোর বৌদি।
না, আজ থাক।
আমার স্ত্রী সেদিন খিচুড়ি বেঁধেছিল, বাড়িতে এটা-ওটা রান্না হলেই আমার স্ত্রী ক্ষিতিকে বলত, ক্ষিতিবাবু, রাত্রে আজ খেয়ে যাবেন। ক্ষিতিও সানন্দে সম্মত হয়ে যেত। তাই সেদিন। অবাক হলাম, আশ্চর্য ব্যাপার, ক্ষিতির আহারের ব্যাপার ঔদাসীন্য কখনও আগে দেখিনি।
না, না, সেকি! চল্ খাবি চল, বললাম।
না, আজ চলি। আর একদিন খাওয়া যাবে কথাগুলি বলে ক্ষিতি আর দাঁড়াল না। ঘর ছেড়ে চলে গেল।
তারপর? কিরীটী শুধাল।
তারপর যা ইতিপূর্বে কোন দিন হয়নি তাই হল, দিন দশেক ক্ষিতি আর এলোই না। আমার স্ত্রী একদিন বললে, তোমার বন্ধুর ব্যাপার কি, আর যে আসেন না!
সেইদিনই আমি ক্ষিতির বাসায় গেলাম খোঁজ নিতে। মালতী দেবী বললেন, সে তো নেই!
নেই! কোথায় গিয়েছে?
আমার মনে হয় কলকাতাতেই গিয়েছেন—
কলকাতায়!
হ্যাঁ, তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু শিশির গুপ্ত, বোধ হয় সেখানেই গিয়েছেন।
আমিও জানতাম-বঙ্কিম বলতে লাগলেন, ক্ষিতির দীর্ঘদিনের এক বন্ধু ছিল। ভদ্রলোক বোধ হয় সত্যিই ক্ষিতিকে ভালবাসতেন নচেৎ কতবার যে ভদ্রলোকের সঙ্গে ও ঝগড়া বাধিয়ে অকারণ অজুহাতে সম্পর্ক ছেদ করেছে তার গোনাগুনতি নেই। আবার নিজেই গিয়ে ভাব করেছে, কারণ বোধ হয় ক্ষিতি জানত ঐ একটিমাত্র মানুষ সত্যিই তাকে ভালবাসেন। এর দিন দুই পরেই ঐ দুঃসংবাদ পেলাম, ক্ষিতি পুরীর এক হোটেলে আত্মহত্যা করেছে গলায় ক্ষুর চালিয়ে—
কিরীটী থামল। দেবেশ অধিকারী এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি। এবার ধীরে ধীরে বললেন; এ যে রীতিমত এক রহস্য রায়মশাই, আপনি তাহলে ঐ রহস্যের একটা কিনারা করতেই এসেছেন পুরীতে?
হ্যাঁ।
কিন্তু তিন বছর আগে যে ব্যাপার ঘটে গিয়েছে—
১৭নং, সেই ঘরের দেওয়ালে কান পাতলে আজও হয়ত অনেক কিছুই শোনা যাবে দেবেশবাবু! সেই রাত্রের সেই ঘটনার সাক্ষী ঐ ঘরের দেওয়ালগুলোই, আর সামনে ঐ সমুদ্র নীল!
এইসব আজগুবী আপনি বিশ্বাস করেন রায়মশাই?
করি বৈকি।
ঐ সময় গোপী এসে বললে, ১৭নং ঘর পরিষ্কার করে বেডিং পেতে দেওয়া হয়েছে। কিরীটীর সঙ্গে একটা সুটকেস ছাড়া বেশী কিছু মালপত্র ছিল না। সেটা গোপী হাতে তুলে নিল। কিরীটী তাকে অনুসরণ করল।
১৭নং ঘর। ঘরে পা দিতেই কিরীটীর কেমন যেন একটা বিচিত্র অনুভূতি জাগে মনের মধ্যে। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে ঘরটার চারিদিকে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল কিরীটী। তিন বৎসর আগে এই ঘরেই এক রাত্রে একজন নিহত হয়েছিল বা আত্মহত্যা করেছিল। মোট কথা একজনের দেহান্ত হয়েছিল। তারপর এই তিন বৎসরে জনা দুই ঘরে রাত্রিবাস করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। এবং ঐ ঘটনার পর এ ঘরে আর কোন যাত্রীকে রাখা হয়নি।
ভূতের ভয়?
ভূত ইতিপূর্বে কিরীটী দেখেনি বটে তবে তার উপস্থিতি অনুভব করেছে। এবং কিরীটীর একটা বদ্ধমূল ধারণা, ভূতেরা কারও কোন অনিষ্ট করে না। ঘরটা আকারে বেশ বড়ই। সমুদ্রের দিকে পর পর দুটো জানালা। জানালায় মোটা মোটা শিক বসানো, বেশ একটু ফাঁক ফাঁক করেই। খোলা জানালাপথে সমুদ্র সারাটা দৃষ্টি জুড়ে যেন এক আদিগন্ত বিস্ময়কর ছবির মত ভেসে ওঠে! নীল আকাশ চক্ৰবালে নীল সমুদ্রের ওপর ঝুঁকে নিজেকে নিজে দেখাচ্ছে আর দেখছে। দেখার বুঝি শেষ নেই। অজস্র সূর্যালোক। বহু মোচার খোলার মত দোদুল দুলছে ইতি উতি কয়েকটা জেলেডিঙি!
১৮নং ঘরে সরিৎশেখর জানালার কাছ থেকে সরে এল।
অনুরাধা দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছে। সরিৎশেখর একটা সিগ্রেট ধরালো। খুব বেশী ধূমপান করে না সরিৎশেখর, মধ্যে মধ্যে এক-আধটা সিগ্রেট ধরায়, তাও শেষ পর্যন্ত অর্ধেকের বেশী থাকতেই ফেলে দেয়। ভাবছিল সরিৎশেখর, অনুরাধা তাহলে বিবাহিতা। ঐ সলিল দত্ত মজুমদারকেই বিবাহ করেছে।
অনুরাধা পরস্ত্রী, একজনের গৃহিণী!
সুখী হয়েছে কি অনুরাধা সলিলকে বিবাহ করে?