তা ঠিক, তবে momentary insanity-তে মানুষ—
কিন্তু সেটাই বা হঠাৎ তার হবে কেন? চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে, তারপর পুরীতে বেড়াতে গিয়েছে। ছেলেরা মানুষ হয়ে গিয়েছে, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে—
সবই ঠিক, কিন্তু পারিবারিক শান্তি তো ছিল না একেবারেই—তাছাড়া কেবল স্ত্রী কেন, ছেলেমেয়েদের ভালবাসাও মানুষটা কোন দিন পায়নি।
কেন?
সেও তার নিজের চরিত্রের জন্য। অমন আত্মসর্বস্ব মানুষ হলে সন্তানদের শ্রদ্ধা ভালবাসা পাওয়া যায় না কিরীটী। সংসারে থেকেও তো সে সংসারের কেউ ছিল না। একেবারে একা যাকে বলে।
কি জান বঙ্কিম, কম তো বয়স হল না, কম দেখলামও না। বেশীর ভাগই দেখেছি মানুষ নিজের দুঃখ নিজেই তৈরী করে নেয়। সংসারে বাস করতে হলে একটা সততা বজায় রাখতে হয়।
তা ঠিক, বঙ্কিম সুর হেসে বলল, কিন্তু তুমি ক্ষিতি সম্পর্কে এত সংবাদ জানতে চাইছ কেন তা তো বললে না।
আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো ভদ্রলোক আজও বেঁচে আছেন।
কি বলছ তুমি!
বলছি তিন বৎসর পুরীর হোটেলে যে আত্মহত্যা করেছিল বা খুন হয়েছিল সে তোমাদের পরিচিত মালতী দেবীর স্বামী ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নন।
অসম্ভব। মালতী দেবী নিজে গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করে এসেছিলেন।
তার ভুলও তো হতে পারে।
ভুল! স্ত্রী স্বামীকে চিনতে ভুল করবেন?
ইচ্ছা করেও তো ভুলটা করতে পারেন। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
ইচ্ছা করে। কিন্তু কেন?
সেই কেনর জবাবটা পেলেই তো সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যায় বঙ্কিম। তুমি জান না বঙ্কিম, কিছুদিন আগে মালতী দেবী তার স্বামীর হাতের লেখা একখানা চিঠি পেয়েছেন।
চিঠি! মানে ক্ষিতি চিঠি লিখেছে তার স্ত্রীকে?
হ্যাঁ। সে চিঠি আমি দেখেছি। অন্য দুখানা চিঠির সঙ্গে মিলিয়েও দেখেছি, সব চিঠিই যে একই হাতের লেখা সে সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই।
ব্যাপারটা যেন কেমন আমার গোলমেলে ঠেকছে–ক্ষিতি আজও বেঁচে আছে, তাছাড়া–কি?
এ ধরনের একটা ব্যাপার গড়ে তুলবার তার কি প্রয়োজন ছিল?
হয়ত ছিল কিছু একটা!
কিন্তু তার পরে আবার বেঁচে উঠবারই যখন ইচ্ছা ছিল তখন–
এই তিন বৎসর কেন সে চুপচাপ ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
নিশ্চয়ই হিমালয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যায়নি।
না, সন্ন্যাসী হবার মত মানুষ সে নয়। তিনজনের খাবার না খেলে যেমন তার চোরা দ্বিতীয় পাকস্থলীটা ভরত না, তেমনি বড় বড় মিথ্যা বোলচাল না দিলে তার পেট ফাঁপে, মানে ফাপত—আচ্ছা, মালতী কি বলছেন?
মনে হল ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া একটু কষ্টকর হচ্ছে—
কেন, এ তো আনন্দের কথা, সত্যিই যদি ক্ষিতি আজও বেঁচে থাকে—
বমি, আমার তো মনে হয় সেটা আনন্দ সংবাদ বহন করে আনবে না। তুমি কি ভাবতে পার বঙ্কিম, ব্যাপারটা ক্ষিতীন্দ্রর পক্ষে কত বড় একটা নিষ্ঠুর পরিহাস!
সত্যি, মানুষটার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। সত্যিই বেচারা হতভাগ্য, যেটা হতে পারত সত্যিকারের একটা আনন্দ সংবাদ, সেটাই যদি–
তবু আমি মালতী দেবীকে কথা দিয়েছি বঙ্কিম, ঐ রহস্যের একটা মীমাংসা করে দেবার চেষ্টা করব, কারণ ব্যাপারটা জানতে তিনি অত্যন্ত উগ্রীব। যাক সে কথা, আমার আরও কিছু জানবার আছে ক্ষিতীন্দ্র সম্পর্কে।
বঙ্কিম বললেন, কি জানতে চাও বল?
প্রত্যেক মানুষেরই চরিত্রে কিছু দোষ ও গুণ থাকে, মানুষটার চরিত্রে কালো দিকটাই। তোমাদের কাছে শুনেছি, মানে তার স্ত্রী ও তোমার মুখ থেকে। তার চরিত্রে কোন ভাল দিকই কি ছিল না?
তোমার ঐ প্রশ্নের জবাবে একটা কথাই বলতে পারি কিরীটী, ওকে কেউ ভালবাসতে পারে না। এমন কি আমি যতদূর জানি, ওর নিজের বাপ-মাও বোধ করি ওকে কোন দিন ভালবাসতে পারেননি।
কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বললে, আচ্ছা, উনি তো শুনেছি, মানে ক্ষিতিবাবু মালতী দেবীকে ভালভাবেই বিবাহ করেছিলেন এবং মালতী দেবীও ভালবেসেছিলেন একদা ঐ মানুষটিকে–
গোড়ার কথাটা অবিশ্যি তাই। কিন্তু আমার মনে হয়, ক্ষিতিকে ঘিরে মালতী দেবীর স্বপ্ন ভেঙে যেতে দেরি হয়নি। আমার কি মনে হয় জান, ঘটনাকে তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে যেতে দাও কিরীটী, তুমি দূরে সরে যাও।
কিন্তু আমি যে ভাই কথা দিয়েছি মালতী দেবীকে, কিরীটী বললে, তাছাড়া আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে বোধ হয় আমিও ফিরতে পারব না।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। বঙ্কিম একটু পরে উঠে দাঁড়াল, এবার আমি তাহলে চলি! রাত্রে তুমি কিন্তু আমার ওখানে খাবে কিরীটী।
না, বরং তুমিই হোটেলে এসো, একসঙ্গে ডিনার খাওয়া যাবে। ভাল কথা, একটা কথা বোধ হয় তোমার জানা প্রয়োজন কিরীটীকি বল তো? ক্ষিতি হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দিন দশেক আগেই বোধ করি, এক সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে দুজনে তাস খেলছিলাম, ঐ সময় এক ভদ্রলোক ক্ষিতির খোঁজে আমার বাড়িতে এসে হাজির—পরনে একটা দামী স্যুট, চোখে কালো চশমা। বেশ দীর্ঘকায় ব্যক্তি। নাম বললেন জীমূতবাহন। ক্ষিতি কিন্তু আগন্তুক ভদ্রলোককে চিনতে পারল না।
জীমূতবাহন বললেন, সে কি রে? সত্যি সত্যিই তুমি মনে করতে পারছ না ক্ষিতীন্দ্র— জীমূতবাহন ঘোষালকে তোমার মনে পড়ছে না? রাজসাহী কলেজে একসঙ্গে দুবছর পড়েছি থাকতামও একই হোস্টেলে পাশাপাশি ঘরে–
না, আমি দুঃখিত। সত্যিই মনে পড়ছে না। ক্ষিতি বলে।
বঙ্কিম বলতে লাগল, যে কারণে তোমাকে ঘটনাটা বলছি কিরীটী—আমি কিন্তু তখন অপার বিস্ময়ে আগন্তুকের মুখের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি। এমন আশ্চর্য মিল দুজনার চেহারার মধ্যে। অবিশ্যি আগন্তুকের চোখে কালো চশমা থাকায় তার চোখ দুটো আমি দেখতে পাইনি।