যদি সত্যিই তিনি বেঁচে থাকেন, আপনাকে তিনি অপদস্থ করতে চাইছেন তাই বা ভাবছেন কেন মিসেস চ্যাটার্জী?
কেন ভাবছি—তাই না? আমি মানে আমার মত করে তো কেউ ঐ মানুষটাকে চেনেনি— চিনবার সুযোগও পায়নি। যাকগে সে কথা, আজ আমি উঠি। আপনি তার একটা ফটো চেয়েছিলেন, এই নিন—বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দিন দশেক আগে তোলা এই ফটোটা। চলিফটোটা কিরীটীর হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মালতী দেবী।
আসুন—
মালতী চলে গেলেন।
কিরীটী মনে মনে মানুষটাকে কল্পনা করবার চেষ্টা করে ফটোটা সামনে ধরে। বেশ বোঝা যায়, মাথার সামনের দিকে বিস্তৃত টাক কিন্তু টাকা ঢাকা দেওয়া হয়েছে এক দিককার বড় বড়। চুল অন্য দিকে সযত্নে এনে।
চোখ দুটো ছোট ঘোট, বর্তুলাকার। চোখের চাউনি দেখে মনে হয়, যেন অত্যন্ত সহজ সরল মানুষটি, কিন্তু স্ত্রী মালতী যে পরিচয় তাঁর দিয়ে গেলেন সেটা ঠিক বিপরীত। চোখের দৃষ্টি থেকে মনের গতিবিধি বোঝা সত্যই অনেক সময় দুষ্কর।
কৃষ্ণা এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
কার ফটো নিয়ে তন্ময় হয়ে আছে গো?
কিরীটী মৃদু হেসে ফটোটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে ধরলো। দেখ তো কৃষ্ণা, মানুষটিকে কেমন বলে মনে হয় তোমার এই ফটো দেখে।
কৃষ্ণা স্বামীর হাত থেকে ফটোটা নিয়ে দেখতে দেখতে বললে, সযত্নে চুল দিয়ে টাক ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে, আত্মসচেতন—মনে হয় চোখ দুটো মিথ্যা বলছে—আদৌ সহজ সরল নয় মানুষটি। বরং একটু লোভী। তা এ কে?
ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাল রাত্রে তোমাকে যার কথা বলছিলাম। লোকে জানে বৎসর তিনেক আগে পুরীর এক হোটেলে আত্মহত্যা করেছেন–
বাজে কথা, আত্মহত্যা করেনি, করতে পারে না। তার প্রমাণ তো ঐ চিঠিটাই—
চিঠিটা অন্য কারও লেখাও তো হতে পারে, হাতের লেখা নকল করে চিঠি দিয়েছে।
না, একই হাতের লেখা চিঠিগুলো, আমি হলফ করে বলতে পারি।
আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত কৃষ্ণা। কিরীটী বলল।
তাহলে?
যদি অনুমান আমার না ভুল হয়ে থাকে, তাহলে এই তিন বৎসর চুপচাপ ছিল কেন ভদ্রলোক? কারণ কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই ঐ নিস্তব্ধতার পিছনে, হয়ত যে হোটেলে তিন বৎসর আগে ঘটনাটা ঘটেছিল তারই সঙ্গে নিস্তব্ধতার কোন ঘনিষ্ঠ কার্যকারণ রয়েছে। তবে এটাও ঠিক, আজও যদি সে বেঁচেই থেকে থাকে, মালতী দেবীর কাছ থেকে দূরে থাকলেও তার সমস্ত খবরাখবর ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রাখতেন বরাবরই।
এ কথা বলছ কেন?
নচেৎ মালতী দেবী টাকা তুলবেন সে কথাটা জানলেন কি করে ক্ষিতীন্দ্রবাবু। না কৃষ্ণা, প্রথম দিকে সব শুনে ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিলাম এখন মনে হচ্ছে হয়ত তত সহজ নয়, সমস্ত ঘটনার মূল শিকড়টা মাটির নীচে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। আমি যখন হাত দেব স্থির করেছি, বর্তমান রহস্যের গিট আমি খুলবই। শোন, সর্বাগ্রে আমাকে একবার জামসেদপুর যেতে হবে।
জামসেদপুর?
হ্যাঁ। ওখানে আমার এক বিশেষ পরিচিত ভদ্রলোক আছেন। অনুসন্ধান আমাকে টিসকো থেকেই শুরু করতে হবে।
বঙ্কিম সুর বহুকাল জামসেদপুর-নিবাসী। চাকরির শুরু থেকেই জামসেদপুরে, যদিও দেশ তার হাওড়ায়। বঙ্কিম সুর টিসকোতেই চাকরি করত, বছর চার-পাঁচ হল রিটায়ার করে ওল্ড সারকিট হাউস এরিয়াতে বাড়ি করে বসবাস করছে।
দুই ছেলে, দুটি ছেলেই কৃতী। একজন কলকাতায় চাকরি করে বিরাট একটা ফার্মে, অন্যজন টিসকোতেই চাকরি করছে। ছোটখাটো রোগা পাতলা মানুষটি। দিবারাত্র যেমন পান চিবাচ্ছে তেমনি টানছে সিগ্রেট একটার পর একটা, চেন-স্মোকার। হাসিখুশি রসিক মানুষ। তার কাছ থেকে অনেক সংবাদ পাওয়া যাবে আশা করা যায়।
ট্রেন থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে কিরীটী সোজা নটরাজ-এ গিয়ে উঠল, হোটেলটা বেশ বড় এবং সব রকম ব্যবস্থাই আছে।
হোটেলের ঘরে বসেই ফোন করল কিরীটী বঙ্কিমকে।
কে বঙ্কিম, আমি কিরীটী—
কিরীটী! কোথা থেকে কথা বলছ হে? বঙ্কিম জানতে চান।
নটরাজ হোটেল। একবার চলে এস না।
তা তুমি আমার বাসায় না উঠে হোটেলে উঠতে গেলে কেন হে?
তুমি হোটেলে এস, সব জানতে পারবে।
আধঘণ্টার মধ্যে বঙ্কিম এল, মুখে একগাল পান, হাতে সিগারেট। বললে, উঃ, অনেক দিন পরে দেখা। তা খবর কি বল, হঠাৎ এখানে?
কিরীটী সংক্ষেপে তার আসার উদ্দেশ্য বলে গেল।
সব কথা মন দিয়ে শুনল বঙ্কিম। তারপর বললে, ক্ষিতীন্দ্রকে আমি বেশ ভাল করেই চিনতাম। তা সে তো বছর তিনেক আগে সুইসাইড করেছে পুরীর এক হোটেলে। ব্যাপারটা কি বল তো?
সেই ভদ্রলোক সম্পর্কে কি জান বল। তুমি তো তাকে চিনতে বললে।
হ্যাঁ, প্রায় সন্ধ্যাতেই একটা ভাঙা সাইকেল নিয়ে আমার বাসায় আসত তাস খেলতে।
তাস খেলার নেশা ছিল বুঝি?
তা ছিল।
অন্য কোন নেশা?
দেখ ভাই, নেশা করতে হলে একটা দিল চাই। নেশা কি সকলে করতে পারে। তাছাড়া লোকটা ছিল স্বভাব-কৃপণ, আর সে কৃপণতার জন্য সে পারত না দুনিয়ার এমন কোন কাজই ছিল না। তার উপরে ছিল মুখে সর্বদা বড় বড় বোলচাল। অনেকটা বলতে পার বোকা চালিয়াৎ, বোকা এইজন্য বলছি, নিজের ভালটা যেমন বুঝতে পারত না, তেমনি ঐ চালিয়াতির জন্য তার যে ক্ষতিটা হত সেটা বুঝবার কোন চেষ্টা করত না। কিন্তু মানুষটার অন্তরটা ছিল পরিষ্কার, কিন্তু ঐ যে বললাম, বোকা, সমস্ত গুণই তার সেটা নষ্ট করে দিয়েছিল তা কি ব্যাপার বল তো?
দেখ বঙ্কিম, এবার একটা সত্যি কথা বল তো, তুমি লোকটার যে চরিত্র বর্ণনা করলে, তাতে করে কি মানুষটা সুইসাইড করতে পারে বলে তোমার মনে হয়? তাও গলায় ক্ষুর চালিয়ে? গলায় দড়ি দেওয়া যায়, বিষপানও করা যায়, কিন্তু গলায় ক্ষুর চালানোর জন্যে অন্য এক ধরনের নার্ভের দরকার, তাই নয় কি!