কিরীটী কোন সূত্রই খুঁজে পায় না—যে সূত্র ধরে সে এগুতে পারে।
০৪. দিন দুই বাদে মালতী দেবী
দিন দুই বাদে মালতী দেবী আবার এলেন কিরীটীর গৃহে। কিরীটী বললে, আসুন মিসেস চ্যাটার্জী, বসুন। আপনার কথাই ভাবছিলাম এ দুদিন।
মালতী আসন গ্রহণ করলেন।
কিরীটী বললে, মিসেস চ্যাটার্জী, আমরা যদি ধরে নিই যে আপনার স্বামী ক্ষিতীন্দ্রবাবু তিন বছর আগে পুরীর হোটেলে আত্মহত্যা করেননি, আজও বেঁচে আছেন এবং কোথাও আত্মগোপন করে আছেন, সেক্ষেত্রে স্বভাবতই যে প্রশ্নটা সর্বাগ্রে আমাদের মনে জাগে সেটা হচ্ছে, না-ই যদি মারা গিয়ে থাকেন তবে আত্মগোপন করে আছেন কেন? আচ্ছা, তার অতীত জীবনের এমন কোন ঘটনা কি আপনার জানা আছে যেটা বরাবর তিনি সকলের কাছ থেকে গোপন করে এসেছেন বলে আপনার মনে হয়?
না। আর সেরকম কিছু থাকলেও আমার জানা নেই। তা ছাড়া তিনি নিজের প্রয়োজন ছাড়া আমাদের কারও সঙ্গে বিশেষ কোন কথাই বলতেন না, নিজের জামাকাপড় আহার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া পৃথিবীর আর কোন কিছু ভাবতেন বলে আমার মনে হয় না।
টাকাপয়সার প্রতি কেমন আকর্ষণ ছিল আপনার স্বামীর?
ছিল, তবে সেটা এমন কিছু একটা উল্লেখযোগ্য নয়।
আচ্ছা মিসেস চ্যাটার্জী, আপনার স্বামীর এই ফিক্স ডিপোজিটের টাকাটা ছাড়া আর কোন টাকা ছিল না? অতদিন চাকরি করেছিলেন বলছেন এবং শেষের দিকে ভালই মাইনা পেতেন বললেন
মালতী কিরীটীর প্রশ্নের উত্তরে বললেন, মনে হয় ছিল। তবে সে সম্পর্কে আমি কিছুই কোনদিন জানতে পারিনি। এমন কি ঐ যে ফিক্স ডিপোজিটের টাকাটার কথা বললাম তাও তিনি যদি একদিন নিজের থেকে আমাকে না বলতেন তো জানতেও পারতাম না হয়ত।
কোন লাইফ ইনসিওরেন্স ছিল না ক্ষিতীন্দ্রবাবুর? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।
ছিল কিনা জানি না। আসলে ঐসব—মানে টাকাপয়সার ব্যাপারে কখনও আমি মাথা ঘামাইনি। উনি বরাবর ওর নিজের মর্জিমত চলতেন, আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকতাম।
কেন?
পারিবারিক জীবনটা ক্রমশ ওঁর স্বার্থপর ব্যবহারে এমন বিষিয়ে তুলেছিলেন যে আমার কোন প্রবৃত্তি হয়নি দুজন একত্রে বসে দুদণ্ড কথা বলবার।
স্নেহমমতা কেমন ছিল? ভালবাসা—
সাধারণত এগুলি ওঁর ছিল বলে আমার মনে হয় না, থাকলেও তা নিজের ওপরেই—
কিন্তু বিবাহের পূর্বে তো আপনি–
তাঁকে জানতাম ঠিকই—কিন্তু পরবর্তীকালে আমার মনে হয়েছে, বিবাহের পূর্বে সেটা একটা অভিনয় ছিল বোধ হয়। ভালবাসার একটা অভিনয়। তাই প্রথমটায় না বুঝতে পারলেও, বলতে লজ্জা-ঘৃণা হয়, আমাকে তার বোধ হয় একমাত্র প্রয়োজন ছিল রাত্রে, কিছুক্ষণের জন্য আমার দেহটায়—
সংসারে তাহলে আপনাদের কোন শান্তি ছিল না বলুন!
কেমন করে থাকবে বলুন, এমন একটা মানুষের সঙ্গে ঘর করলে কোন শান্তি বা সুখ থাকে। কি?
মিসেস চ্যাটার্জী, এবারে বলুন তো, তিন বছর আগে পুরীর হোটেলে যে মৃতদেহটা আপনি সনাক্ত করেছিলেন, ভাল করেই ডেড বডিটা তো দেখেছিলেন, না কি স্বামীর প্রতি যে অবজ্ঞা ঘৃণা ও বিরক্তি দীর্ঘকাল পোষণ করে এসেছেন মনে মনে সেই সব নিয়েই, মানে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখেছিলেন—
মালতী দেবী চুপ করে রইলেন।
আমার কি মনে হয় জানেন, মৃতদেহটা সেদিন নিশ্চয় আপনি ভাল করে দেখেননি! দেখলে হয়ত চেনার মধ্যে আপনার সেদিন কোন ফাঁক থাকত না। মনে মনে যদি আমার বুঝবার না ভুল হয়ে থাকে ক্ষিতীন্দ্রবাবুর কাছ থেকে আপনি যে মুক্তি চাইছিলেন সেই আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি যখন আপনার সামনে এসে অকস্মাৎ দাঁড়াল আপনি সেই মুক্তিকেই স্বাগত জানালেন—এমন কি আপনার বৈধব্য পরবর্তী জেনেও।
আমি—
নচেৎ সেদিনকার তাঁর সেই মৃত্যু আর পরবর্তী কালের এই চিঠি জানবেন কোনটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঠিক আছে মালতী দেবী, এ রহস্যের মীমাংসা কষ্টসাধ্য হবে না বলেই মনে হয়।
তাহলে কি মিঃ রায়, আপনি বিশ্বাস করেন সে আজও জীবিত?
তাই আমার মনে হচ্ছে—
তাহলে—আমি, আমি সকলকে কি বলব?
দেখুন স্বামীর ভয়াবহ মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে যে কোন স্ত্রীই ঐ ধরনের ভুল করতে পারে, অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া আপনি কেন একমাত্র আপনার দিকটাই ভাবছেন, ক্ষিতীন্দ্রবাবুর দিকটাও ভাবুন—same problem তো বেঁচে উঠলে তাকেও face করতে হবে। সেটা নিশ্চয় তার পক্ষে খুব একটা সুখের হবে না। কিন্তু তার মধ্যেও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে অর্থাৎ তিনি যদি হঠাৎ আজ আবার সত্যিই বেঁচে উঠতে চান—তো কেন। আবার বেঁচে উঠবার নতুন করে তার কি কারণ থাকতে পারে, কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেবলমাত্র ঐ ফিক্স ডিপোজিটের টাকাটার জন্য তিনি আজ আবার বেঁচে উঠতে চাইছেন, আমার মন মেনে নিতে পারছে না। নিশ্চয়ই আরও কোন কারণ আছে। সেটা কি, কি হতে পারে। তারপর একটু থেমে কিরীটী বলল, সে যাই হোক, আপনি জানতে চান সত্যি সত্যিই আজও আপনার স্বামী বেঁচে আছেন কিনা—মনে হয় আপনার সেই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব।
মালতী দেবী বললেন, আসল সত্যটুকু আমাকে জানতেই হবে মিঃ যায়। বলতে আমার কোন দ্বিধা বা লজ্জা নেই—যে মানুষটা দীর্ঘ একটা যুগ কেবল আমাকে মানসিক পীড়নই করে গিয়েছে, সে মরেও আবার বেঁচে উঠে আমাকে কেন যে অপদস্থ করতে চায় সেটা আমার জানা আজ খুব বেশী প্রয়োজন। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কত বড় দুঃখে কোন এক স্ত্রীর মুখ থেকে তার স্বামী সম্পর্কে এই কথাটা বের হতে পারে–