- বইয়ের নামঃ সামনে সমুদ্র নীল
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ ইলমা পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
০১. সরিৎশেখর কল্পনাও করতে পারে নি
সরিৎশেখর কল্পনাও করতে পারে নি, পুরীতে এসে হঠাৎ ঐ অবস্থায় তার আবার অনুরাধার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।
অবিশ্যি আবার অনুরাধার সঙ্গে দেখা হবার একটা প্রত্যাশা সরিশেখরের অবচেতন মনের মধ্যে কোথাও যেন ছিল। এবং দেখা যে হবেই সে বিশ্বাসও ছিল সরিশেখরের। পথে চলতে চলতে কতদিন অন্যমনস্কভাবে এদিক ওদিক তাকিয়েছে সরিৎশেখর নিজের অজ্ঞাতেই। তার মনটা যেন কার প্রত্যাশায় সর্বক্ষণই প্রতীক্ষা করেছে। তাই বুঝি আজ পুরীতে এসে অনুরাধাকে দেখে ও থমকে দাঁড়িয়েছিল। সত্যি, এমনি আকস্মিকভাবে দীর্ঘ দুই বৎসর পরে যে আবার অনুরাধার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে সরিৎশেখর ভাবতেও পারেনি।
জীবনের দু-দুটো বৎসর তো নেহাৎই একটা কিছু কম সময় নয়। অকস্মাৎ একদিন অনুরাধা সরিশেখরের জীবন থেকে সরে গিয়েছিল। এবং যাবার আগে বলে গিয়েছিল—আজও সরিশেখরের অনুরাধার সে কথাগুলো মনে আছে—ভোলেনি ভুলতে পারেনি সরিৎশেখর।
ভেবে দেখলাম সরিৎ–
তখনও জানে না, কল্পনাও করতে পারেনি সরিৎশেখর কি বলতে চায় অনুরাধা তাকে!
সকাল থেকেই শরীরটা ভাল ছিল না বলে সরিৎশেখর কলেজে পড়াতে যায়নি। ডিকেন্সের একটা উপন্যাস নিয়ে শয্যায় শুয়ে শুয়ে পড়ছিল। বাইরে সেদিন যেন বাতাসে একটা অগ্নির জ্বালা। একটি মাত্র জানালা খোেলা ঘরের, হঠাৎ অনুরাধা ঘরে ঢুকল।
সরিৎ!
এ কি, তুমি এই প্রচণ্ড গরমে দুপুরে?
শ্যা, কলেজেই গিয়েছিলাম তোমার, গিয়ে শুনলাম তুমি কলেজে যাওনি, তাই সোজা অফিস থেকে এখানেই চলে এলাম।
মনে হচ্ছে খুব জরুরী প্রয়োজন। তা দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বোস রাধা।
ঐ নামেই ডাকত সরিৎ অনুরাধাকে পরিচয় হবার কিছুদিন পর থেকে।
ভেবে দেখলাম—মানে—অনুরাধা যেন কেমন একটু ইতস্তত করতে থাকে।
যে তাগিদে কথাটা বলবার জন্য সরিতের কলেজ পর্যন্ত ছুটে গিয়ে সেখানে তাকে না পেয়ে এখানে এসেছে—সে তাগিদটা যেন আর অনুভব করছে না অনুরাধা।
মনের মধ্যে কি কোন দ্বন্দ্ব ছিল তার তখনও!
হয়ত ছিল। অনেকবার কথাটা মনে হয়েছে গত এই দুই বৎসরে সরিশেখরের—মনে হয়েছে সেদিন যে কথাগুলো বলেছিল তাকে অনুরাধা, তার জন্য কোন স্থির পূর্ব-সংকল্প ছিল না।
যা বলেছিল সে সেদিন, সেটাই তার সেদিনকার হয়ত শেষ কথা ছিল না।
অনুরাধা কিন্তু বসল না। একটু থেকে আবার বললে, ভেবে দেখলাম সরিৎ–
কি ব্যাপার কি আবার ভেবে দেখলে? মৃদু হাসি সরিতের ওষ্ঠপ্রান্তে।
তোমার আমার সম্পর্কের এইখানেই শেষ হয়ে যাওয়া ভাল।
কথাটা শুনেই সরিৎশেখর শয্যার উপর উঠে বসে, কয়েকটা মুহূর্ত অনুরাধার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুরাধা তখনও বসেনি, দাঁড়িয়েই আছে।
আজও মনে আছে স্পষ্ট সেদিনের অনুরাধার চেহারাটা, পরনে তার সবুজ-পাড় একটা দামী তাঁতের শাড়ি, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা গায়ের ব্লাউজ, মাথার চুলগুলো আলগা ভাবে একটা
খোঁপা করা। খোঁপাটা কাঁধের ওপর ভেঙে পড়েছে, ডান হাতটা খালি, বাঁ হাতে ছোট একটা রিস্টওয়াচ—চোখে সরু সোনালী দামী ফ্রেমের চশমা, পায়ে চপ্পল।
সরিৎশেখর চুপ করেই ছিল, অনুরাধা আবার বলল, ভেবেছিলাম একবার একটা চিঠি লিখে তোমাকে কথাটা জানিয়ে দেব, কিন্তু পরে মনে হল আমার, যা বলবার সামনাসামনিই তোমাকে জানিয়ে দেওয়া ভাল। আমি চললাম
এটুকু বলবার জন্যই কি এতটা পথ এই দুপুর রোদে ছুটে এসেছ?
তাই।
আর কিছুই তোমার বলবার নেই রাধা?
না।
কেন এভাবে এতদিনকার সম্পর্কটা শেষ করে দিয়ে যাচ্ছ, তাও বলবে না?
কোন প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজন নেই?
না। কারণ তুমি তো সবই জান। জানা কথাটা নতুন করে আবার আমারই বা বলবার কি আছে, আর তোমারই বা শোনবার কি আছে বল।
কিন্তু বিশ্বাস কর—
থাক, মিথ্যা কতকগুলো কথা আর নাই বা বললে বানিয়ে বানিয়ে–
ঐ শেষ কথা অনুরাধার। আর সে দাঁড়ায়নি। ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর দীর্ঘ দুই বৎসর পরে আজ অকস্মাৎ পুরীর সমুদ্রতটে অনুরাধার মুখমুখি সে।
সকাল আটটা কি সাড়ে আটটা হবে তখন।
হোটল থেকে বের হয়ে সরিৎশেখর সমুদ্রের দিকেই যাচ্ছিল। হঠাৎ কানে এল তার একটা হাসির উচ্ছ্বাস, অনেক দিনের অনেক পরিচিত সেই হাসি, যে হাসি আজও ভোলেনি। তার কানের পর্দায় এসে ঝঙ্কার তুলতেই সে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সামনের দিকে তাকিয়েছিল।
পরনে সুইমিং কস্টিউম, একটা বিরাট টাওয়েল গায়ে জড়ানস্নান সেরে বালুর ঢালু পাড় ধরে অনুরাধা ও বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বা তারও হয়ত কিছু বেশীই বয়সের এক ব্যক্তি উপরের দিকে উঠে আসছিল সমুদ্রের জল থেকে। একেবারে মুখখামুখি—মাত্র কয়েক হাত ব্যবধান। অনুরাধার দৃষ্টি কিন্তু সামনের দিকে নয়, অন্য দিকে প্রসারিত।
সরিশেখরের অজ্ঞাতেই তার কণ্ঠ হতে বের হয়ে এসেছিল নামটা, অনুরাধা।
অনুরাধাও সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়েছিল, উচ্চারিত ডাকটা তার কানে যেতেই বোধ হয় সরিতের দিকে তাকিয়েছিল।
অনুরাধা! সরিতের অস্ফুট কণ্ঠস্বর। সরিৎ! অনুরাধার কণ্ঠেও বিস্ময়।
অনুরাধার সঙ্গী লোকটি সেই সময় সামনের দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে সরিশেখরের মনে হয়, অনুরাধার সঙ্গীর সঙ্গে তার পরিচয় না থাকলেও, ভদ্রলোককে সে যেন ইতিপূর্বে দেখেছে। কোথায় দেখেছে অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে না সরিশেখরের, তবে তাকে পূর্বে দেখেছে।