যাওয়া
মাটিতে চোখ রেখে ঘুরে বেড়াত লোকটা,
কখনও আকাশ দেখেনি।
এখন
খাটিয়ার উপরে
চিতপটাং হয়ে সে শুয়ে আছে, আর
আশ মিটিয়ে আকাশ দেখছে।
জীবনে কখনও ফুলের স্বপ্ন দেখেনি লোকটা,
অষ্টপ্রহর শুধু
ভাতের গন্ধে হন্যে হয় ঘুরত।
এখন তার
তেলচিটে বালিশের দু’দিকে দুটো
রজনীগন্ধার বাণ্ডিল ওরা সাজিয়ে দিল।
এতকাল সে অন্যের বোঝা হয়ে বেড়াত।
আর আজ
তারই নীচে কোমরে-গামছা চার বেহারা।
আকাশ দেখতে-দেখতে,
ফুলের গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে
লোকটা এখন গঙ্গার হাওয়া খেতে যাচ্ছে।
শব্দ, শুধু শব্দ
হাজার শব্দ মাথায় ছিল,
হাজার শব্দ বুকে,
আর তা ছাড়া বাপ-পিতেমোর
জং-ধরা সিন্দুকে
শব্দ ছিল দু-তিন হাজার–
খরচা করে সবই
দেখছি তবু হয়নি আঁকা
তোমার মুখচ্ছবি।
দোষ ছিল না শব্দে, শুধু
দোষ ছিল জোড় বাঁধায়,
ভুল-বিবাহের বর-কনে তাই
গড়ায় ধুলো-কাদায়।
এখন ভূমিশয্যা থেকে
কুড়িয়ে তাদের তুলি;
নতুন করে জোড় মিলিয়ে
মেটাচ্ছি ভুলগুলি।
শুধু যাওয়া
কক্ষনো কি তোমাদের কাউকে
এমন কথা বলেছিলুম যে, আমি
পৌঁছে গেছি?
তা হলে তোমরা ধরেই নিয়ো যে,
কথাটা মিথ্যে,
কিংবা আমার বিশ্বাসে অনেক
ভেজাল ছিল।
আমি শুধু যাবার কথাই বলি,
পৌঁছবার কথা বলি না।
আসলে, পৌঁছনোটা যে খুব জরুরী ব্যাপার,
এমন বিশ্বাসই আমার নেই।
যাওয়াতে যারা বিশ্বাস করো,
তারা আমার সঙ্গে চলো।
যারা পৌঁছতে চাও, তারা
এসো না।
স্বদেশ আমার
এ কী স্নেহ! এ কী মায়া! এ কী নিজদেশেও নিয়ত
উদ্বেগে আতঙ্কে যন্ত্রণায়
প্রহর যাপন! এ কী চতুর্দিকে গর্জমান
বৈরী জনতার মধ্যে বন্ধুদের মুখের আদল
উদয়াস্ত
উন্মাদের মতো খুঁজে ফেরা!
মেহেদির বেড়া
কালকেও করেছে রক্ষা উদ্যানের গোলাপগুলিকে।
কালকেও গোলাপ ছিল,
অজস্র টগর জুঁই মল্লিকা ও গন্ধরাজ ছিল।
আজ নেই। অথচ, আশ্চর্য কাণ্ড,
সমূহ শূন্যতা ঘিরে আজকেই বসেছে কাঁটাতার।
ওরা বলে, তুমি তো ভিনদেশি, তুমি আর
এইখানে থেকো না, তুমি যাও।
না-গিয়ে নিষ্কৃতি নেই, কে না জানে।
যেতে-যেতে তবু তুমি পিছনে তাকাও।
ভাবে, কেন যাবে?
এ কি মোহ, এ কি জানো ভূমি যে কখনও
নিজস্ব হবার নয়, এই কথা
মেনে নিতে না-পারার বিড়ম্বনা?
হৃৎপিণ্ডে মোচড় লাগে, চোখ ফেটে সহসা ঝরে পড়ে
নিরুদ্ধ আবেগ।
কোথাও জমে না কিছু মেঘ।
শুধু তাসা-বাদ্য শুনে চমকে ওঠে এ-পাড়া ও-পাড়া,
কঠিন ভ্রুভঙ্গি দেখে মায়ের আঁচলে
মুখ লুকায় শিশু।
এ কী ভ্রান্তি! এ কী অহোরাত্র শুধু অর্থহীন বিসর্জন
স্বদেশে আমার!
কোনোদিকে বোধনের চিহ্ন নেই, কোনো
ঘরে নেই আমন্ত্রণ;
কেউ এসে দাঁড়ায় না কারও পাশে।
তারই মধ্যে আমি দেখছি তোমাকে, যে-তুমি
হাত রেখেছ কাঁটাতারে, চোখ রেখেছে উন্মুক্ত আকাশে।
হাইওয়ে
বিঘের পর বিঘে এখন
সাদা, সটান
রজনীগন্ধার চাষ চলেছে।
খাল, বিল আর
হাজা-মজা পুকুরের ইজারা নিয়ে
ফোটানো হচ্ছে পদ্ম।
অভদ্রা বর্ষাকাল,
শেয়ালে চাটে বাঘের গাল,
উঠোনে এক-হাঁটু কাদা।
অল্প-একটু রোদ উঠতেই
গালফোলা গোবিন্দ সামন্তের বুড়ি-ঠাক্মা তাই
পিচঢালা
হাইওয়ের উপরে তার
সাড়ে তিন কাঠা জমির ধান শুকিয়ে নিচ্ছে।
গোবিন্দ কোথায়?
জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে,
যেহেতু এখন ‘জমিতে আর কিছুই নাই, বাবু’, তাই
হাওড়ার ছেলে গোবিন্দ গিয়ে
মেদিনীপুরের দেউলিয়াবাজারের চায়ের দোকানে
কাজ নিয়েছে।
নদী পেরুলে কোলাঘাট,
কোলাঘাট ছাড়ালে দেউলিয়াবাজার।
সেখানে
বাস থেকে নেমে
উইকএণ্ডের শৌখিন বাবুরা
গোবিন্দ সামন্তের মালিকের দোকান থেকে
একঠোঙা মুড়ি,
বিটনুন-ছেটানো দু-দুটো আলুর চপ, আর
একভাঁড় চা খেয়ে ফের বাসে ওঠে।
তারপর
কেউ ঝাড়গ্রাম, কেউ টাটানগর, কেউ
জুনপুট কি দিঘার দিকে
চলে যায়।
রজনীগন্ধা আর পদ্মগুলো
ঝুড়ি-বোঝাই হয়ে ট্রাকে ওঠে; তারপর
ট্রাক-বোঝাই হয়ে
বিয়েবাড়ি, জয়ন্তী-অনুষ্ঠানের মঞ্চ আর মড়ার খাটিয়ে
সাজাবার জন্যে
হাওড়া ব্রিজ আর নতুনবাজারের ফুলের দোকানে চলে আসে।
কিন্তু বুড়ি-ঠাক্মা তার ধান কিছুতেই
ছাড়তে চায় না।
এন. এইচ. সিক্সের উপরে সারা দুপুর সে তার
ধান আগলে বসে থাকে।
আর
তেরপলে-ঢাকা ট্রাক দেখলেই
লাঠি উঁচিয়ে
কাক তাড়াবার ভঙ্গিতে বলে–হুশ্!