ফুলের স্বর্গ
যৌবনে আনন্দ নেই, যদি তার সমস্ত সম্ভার
আমৃত্যু অক্ষয় থাকে। ক্ষয়ে তার শান্তি, জীবনের
প্রার্থনা পূরণ। এই অপরূপ প্রথম-গ্রীষ্মের
আলস্যের ভারে নম্র আদিগন্ত রৌদ্র-হাওয়া-নীলে
সামান্যই সুখ, দুঃখ অসামান্য : সে-ঐশ্বর্যে তার
শুধু ব্যর্থ সঞ্চয়ের বিড়ম্বনা বাড়ে। এ-যৌবন
রিক্তই না হয় যদি, বঞ্চনায় বাঁচে তিলে তিলে,–
শাস্তিও সান্ত্বনা তার, মৃত্যু তার সন্তাপহরণ।
সে-মৃত্যু যখনই নামে বিদ্যুৎবিদীর্ণ ঘন মেঘে
বৃষ্টির ধারায়, তুচ্ছ যৌবনজড়িমা লজ্জা সব;
প্রাণের সমস্ত পাপড়ি মেলে তার দেবতাদুর্লভ
আলিঙ্গনে সংকোচের বৃন্ত থেকে খসে পড়ে যাওয়া–
সে-ই তো আমার স্বর্গ। প্রত্যাশায় সারারাত্রি জেগে
হাওয়ার হাততালি শুনি; হাওয়া, হাওয়া–অফুরন্ত হাওয়া!
ভয়
যদি এ চোখের জ্যোতি নিভে যায়, তবে
কী হবে, কী হবে!
দূর পথে ঘুরে ঘুরে ঢের নবীবন
খুঁজে যাকে এই রাতে নিয়ে এলে মন,
এখনও দেখিনি তাকে, দেখিনি, এখন
যদি এ চোখের জ্যোতি নিভে যায়, তবে
কী হবে, কী হবে!
যে-ও চলে যেতে পারে, যদি যায়, তবে
কী হবে, কী হবে!
এই যে চোখের আলো, ব্যথা-বেদনার
আগুনে রেখেছি তাকে জ্বেলে আমি, তার
দেখা পাওয়া যাবে, তাই। সে যদি আবার
চলে যায়, চোখভরা আলো নিয়ে তবে
কী হবে, কী হবে!
কখনও হারাই প্রাণ, কখনও প্রাণের
থেকেও যে প্রিয়তর, তাকে। সারাদিন
কথা মনে ছিল কোনো মায়াবী গানের,
সুর খুঁজে পেয়ে তার বিষাদমলিন
কথাগুলি যদি ফের ভুলে যাই, তবে
কী হবে, কী হবে!
মেঘডম্বরু
নেই তার রাত্রি, নেই দিন। প্রাণবীণার ঝংকারে
সুরের সহস্র পদ্ম ফুটে ওঠে অতল অশ্রুর
সরোবরে, যন্ত্রণার ঢেউয়ের আঘাতে। সেই সুর
খুঁজে ফিরি রাত্রিদিন। হৃদয়ের বৃন্তে নিরবধি
মুদিতনয়ন পদ্মে যদি না সে শতলক্ষধারে
মন্ত্রবারি ঢালে, তার পাপড়িতে-পাপড়িতে যদি না সে
জেগে থাকে নিষ্পলক তবে সে নিষ্ফল, না-ই যদি
ঝড়ের ঝংকার তোলে এই মেঘডম্বরু আকাশে।
আকাশ স্তম্ভিত। মন গম্ভীর। কখন গুরুগুরু
গানের উদ্দাম ঢেউ সমবেত কণ্ঠের আওয়াজে
ভেঙে পড়ে! পুঞ্জীভূত মেঘের মৃদঙ্গে পাখোয়াজে
বাজে তার সংগতের বিলম্বিত ধ্বনি। বারে বারে
জীবন লুন্ঠিত যার, গানে তার উজ্জীবন শুরু;
প্রাণ তার পরিপূর্ণ মন্ত্রময় গানের ঝংকারে।
রৌদ্রের বাগান
কেন আর কান্নার ছায়ায়
অস্ফুট ব্যথার কানে কানে
কথা বলো, বেলা বয়ে যায়,
এসো এই রৌদ্রের বাগানে।
এসো অফুরন্ত হাওয়ায়,–
স্তবকিত সবুজ পাতার
কিশোর মুঠির ফাঁকে ফাঁকে
সারাটা সকাল গায়ে গায়ে
যেখানে টগর জুঁই আর
সূর্যমুখীরা চেয়ে থাকে।
এসো, এই মাঠের উপরে
খানিক সময় বসে থাকি,
এসো, এই রৌদ্রের আগুনে
বিবর্ণ হলুদ হাত রাখি।
এই ধুধু আকাশের ঘরে
এমন নীরব ছলোছলো
করুণাশীতল হাসি শুনে
ঘরে কে ফিরতে চায় বলো।
এই আলো-হাওয়ার সকাল–
শোনো ওগো সুখবিলাসিনী,
কতদিন এখানে আসিনি,
কত হাসি কত গান আশা
দূরে ঠেলে দিয়ে কতকাল
হয়নি তোমায় ভালোবাসা।
কেন আর কান্নার ছায়ায়
অস্ফুট ব্যথার কানে কানে
কথা বলো, বেলা বয়ে যায়,
এসো এই রৌদ্রের বাগানে।
শিয়রে মৃত্যুর হাত
শিয়রে মৃত্যুর হাত। সারা ঘরে বিবর্ণ আলোর
স্তব্ধ ভয়। অবসাদ। চেতনার নির্বোধ দেয়ালে
স্তিমিত চিন্তার ছায়া নিবে আসে। রুগ্ণ হাওয়া ঢালে
ন্যাসপাতির বাসী গন্ধ। দরজার আড়ালে কালো-টুপি
যে আছে দাঁড়িয়ে, তার নিষ্পলক চোখ, রাত্রি ভর
হলে সে হারাবে।
সিঁড়ি-অন্ধকারে মাথা ঠুকে ঠুকে
কে যেন উপরে এল অনভিজ্ঞ হাতে চুপিচুপি
ভিজিট চুকিয়ে দিয়ে ম্রিয়মাণ ডাক্তারবাবুকে।
শিয়রে মৃত্যুর হাত। স্তব্ধীভূত সমস্ত কথার
মন্থর আবেগে জমে অস্বস্তির হাওয়া। সারা ঘরে
অপেক্ষা নিঃশ্বব্দ জটলা। যেন রাত্রির জঠরে
মানুষের সব ইচ্ছা-অনিচ্ছা ভাসিয়ে শূন্য সাদা
থমথমে ভয়ের বন্যা ফুলে ওঠে। ওদিকে দরজার
আড়ালে আবছায়া-মূর্তি সারাক্ষণ যে আছে দাঁড়িয়ে,
নিষ্পলক চোখ তার। নিরুচ্চার মায়ামন্ত্রে বাঁধা
ক্লান্তির করুণ জ্যোৎস্না নেমেছে শয্যার পাশ দিয়ে।
শিয়রে মৃত্যুর হাত। জরাজীর্ণ ফুসফুসে কখন
নিশ্বাস টানার দীর্ঘ যন্ত্রণার ক্লান্তি ধীরে-ধীরে
স্তব্ধ হয়ে গেছে কেউ জানে না তা। ভোরের শিরশিরে
হাওয়ায় জানলার পর্দা কেঁপে উঠে তারপর আবার
শান্ত হয়ে এল। ছায়া অন্ধকার। মাঠ-নদী-বন
পেয়েছে নিদ্রার শান্তি। এদিকে রাত্রির অবসানে
সে-ও নেই। শান্তি! শান্তি! সে চলে গিয়েছে। সঙ্গে তার
কে গেছে জানে না কেউ, শুধু এই অন্ধকার জানে।
শেষ প্রার্থনা
জীবন যখন রৌদ্র-ঝলোমল,
উচ্চকিত হাসির জের টেনে,
অনেক ভালোবাসার কথা জেনে,
সারাটা দিন দুরন্ত উচ্ছ্বল
নেশার ঘোরে কাটল। সব আশা
রাত্রি এলেই আবার কেড়ে নিও,
অন্ধকারে দু-চোখ ভরে দিও
আর কিছু নয়, আলোর ভালোবাসা।
স্বপ্ন-কোরক
তবু সে হয়নি শান্ত। দীর্ঘ অমাবস্যার শিয়রে
যে-রাত্রে নিঃশব্দে ঝরে পড়ে
মলিনলাবণ্য স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার মমতা,
যে-রাত্রে সমস্ত তুচ্ছ অর্থহীন কথা
গানের মূর্ছনা হয়ে ওঠে,
শোক শান্ত হয়, দুঃখ নিভে আসে, যে-রাত্রে শীতার্ত মন ফোটে
কল্পনার সুন্দর কুসুম, নামে সান্ত্বনার জল
চিন্তার আগুনে, আর আকন্যাকুমারীহিমাচল
কপালে জ্যোৎস্নার পঙ্ক মেখে
জেগে ওঠে অতলান্ত অন্ধকার সমুদ্রের থেকে,–
তখনও দেখলাম তাকে, কী এক অশান্ত আশা নিয়ে
সে খোঁজে রাত্রির পারাপার,
দুই চোখে তার
স্বপ্নের উজ্জ্বলশিখা প্রদীপ জ্বালিয়ে।
সে এক পরম শিল্পী। সংশয়-দ্বিধার অন্ধকারে
সে-ই বারে-বারে
আলোকবর্তিকা জ্বালে, দুঃখ তার পায়ে মাথা কোটে,
তারই তো চুম্বনে ফুল ফোটে,
সে-ই তো প্রাণের বন্যা ঢালে
তুঙ্গভদ্রা, গঙ্গায় কি ভাক্রা-নাঙালে।
সে এক আশ্চর্য কবি, পাথরের গায়ে
সে-ই ব্রহ্মকমল ফোটায়।
কী যে নাম, মনে নেই তা তো–
আবদুল রহিম কিংবা শংকর মাহাতো,
অথবা অর্জুন সিং। মাঠে মাঠে প্রদীপ জ্বালিয়ে
সে জাগে সমস্ত রাত স্বপ্নের কোরক হাতে নিয়ে।
আমার সমস্ত সুখ, সকল দুঃখের কাছাকাছি
সে আছে, আমিও তাই আছি।