মিলিত মৃত্যু
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ
পরিস্কার করে।
প্রসঙ্গত, শুভেন্দুর কথা বলা যাক।
শুভেন্দু এবং সুধা কায়মনোবাক্যে এক হতে গিয়েছিল।
তারা বেঁচে নেই।
অথবা মৃন্ময় পাকড়াশি।
মৃন্ময় এবং মায়া নিজেদের মধ্যে কোনো বিভেদ রাখেনি।
তারা বেঁচে নেই।
চিন্তায় একান্নবর্তী হতে গিয়ে কেউই বাঁচে না।
যে যার আপন রঙ্গে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে-
মিলিত মৃত্যুর থেকে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে-
তা হলে দ্বিমত হওঁ। আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
তা হলে বিক্ষত হও তর্কের পাথরে।
তা হলে শানিত করো বুদ্ধির নখর।
প্রতিবাদ করো।
ঐ দ্যাখো কয়েকটি অতিবাদী স্থির
অভিন্নকল্পনাবুদ্ধি যুবক-যুবতী হেঁটে যায়।
পরস্পরের সব ইচ্ছায় সহজে ওরা দিয়েছে সম্মতি।
ওরা আর তাকাবে না ফিরে!
ওরা একমত হবে, ওরা একমত হবে, ওরা
একমত হতে-হতে কুতুবের সিঁড়ি
বেয়ে উর্ধ্বে উঠে যাবে, লাফ দেবে শূন্যের শরীরে।
২৪ ফাল্গুন, ১৩৬৭
যবনিকা কম্পমান
কেহই কিংখাবে আর ঢাকে না বিরহ;
দাঁত নখ ইত্যাদি সবাই আজ
অনায়াসে দেখতে দেয়। পৃথিবীর নিখিল সন্ধ্যায়
গোপন থাকে না কিছু। যত কিছু
দেখিনি, এবারে সব দেখা হয়।
যেন পশুলোমে সব ঢাকা ছিল। গোলাপি কম্বল
তুলে নিলে স্পষ্ট হয় কিছু রক্ত, আর
পিত্তের সবুজ, পুঁজ, কফ, লালা,
গয়ের ইত্যাদি। সব গোলাপি কম্বলে চাপা দিয়ে
প্রত্যেকে দেখিয়েছিল এতকাল
গাঞী, গোত্র, মেল।
অর্থাৎ মার্জিত পরিভাষার সুন্দর যবনিকা।
যবনিকা কম্পমান। দেখে যান বার্ট্রাণ্ড রাসেল।
শব্দের পাথরে
জলের উপরে ঘুরে ঘুরে
জলের উপরে ঘুরে ঘুরে
ছোঁ মেরে মাছরাঙা ফের ফিরে গেল বৃক্ষের শাখায়।
ঠোঁটের ভিতরে তার ছোট্ট একটা মাছ ছিল।
কে জানে মাছরাঙা খুব সুখী কি না।
রোদ্দুরে ভীষণ পুড়ে পুড়ে
রোদ্দুরে ভীষণ পুড়ে পুড়ে
সন্ধ্যায় অনন্তলাল ফিরেছে অভ্যস্ত বিছানায়।
মস্তিষ্কে তখনও তার রূপকথার গাছ ছিল;
গাছের উপরে ছিল হিরামন পাখি।
কে জানে অনন্তলাল সুখী কি না।
শব্দের পাথরে মাথা খুঁড়ে
শব্দের পাথরে মাথা খুঁড়ে
কেউ কি কখনও মাছ, বৃক্ষ কিংবা পাখির কঙ্কাল পেয়ে যায়?
ভাবতেই ভীষণ হাসি পাচ্ছিল।
সূর্যাস্তের পর
সূর্য ডুবে যাবার পর
হাসির দমকে তাদের মুখের চামড়া কুঁচকে গেল,
গালের মাংস কাঁপতে লাগল,
বাঁ চোখ বুঁজে, ডান হাতের আঙুল মটকে
তারা বলল,
“শত্রুরা নিপাত যাক।”
আমি দেখলাম, দিগন্ত থেকে গুঁড়ি মেরে
ঠিক একটা শিকারি জন্তুর মতন
রাত্রি এগিয়ে আসছে।
বললাম, “রাত্রি হল।”
তারা বলল, “হোক।”
বললাম, “রাত্রিকে যেন একটা জন্তুর মতন দেখাচ্ছে।”
তারা বলল, “রাত্রি তো জন্তুই।
আমরা এখন উলঙ্গ হয়ে
ওই জন্তুর পূজায় বসব।
তুমি ফুল আনতে যাও।”
আমি ফুল আনতে যাচ্ছিলাম।
পিছন থেকে তারা আমাকে ডাকল।
বলল, “ফুলগুলিকে ঘাড় মুচড়ে নিয়ে আসবে।”
স্বর্গের পুতুল
কে কতটা নত হব, যেন সব স্থির করা আছে।
যেন প্রত্যেকেই তার উদ্বৃত্ত ভূমিকা অনুযায়ী
উজ্জ্বল আলোর নীচে নত হয়।
সম্রাট, সৈনিক, বেশ্যা, জাদুকর, শিল্পী ও কেরানি,
কবি, অধ্যাপক, কিংবা মাংসের দোকানে
যাকে নির্বিকার মুখে মৃত ছাগলের চামড়া ছাড়াতে দেখেছি,
এবং গর্দানে-রাংয়ে যে তখন মগ্ন হয়ে ছিল,
তারা প্রত্যেকেই আসে উজ্জ্বল আলোর নীচে একবার।
কপালে স্বেদের বিন্দু, সানন্দ সুঠাম ঘুরে গিয়ে
তারা প্রত্যেকেই নত হয়।
কেউ বেশি, কেউ কম, কিন্তু প্রত্যেকেই নত হবে
উজ্জ্বল আলোর নীচে একবার।
না-কেনা না-বেচা পণ্য, স্বর্গের তটিনী
সারাদিন জ্বলে;
এবং সৈনিক, বেশ্যা, কলাবিৎ, ভাড়াটিয়া গুণ্ডা, কারিগর
একবার সেখানে যায়, যে-যার ভূমিকা অনুযায়ী
নত হয়; স্বর্গ থেকে প্রলম্বিত আলোর সলিলে
মুখ প্রেক্ষালন করে নেয়।
ঘরের বাহিরে জ্বলে দৈব জলধারা;
দ্যাখো আলো জ্বলে, দ্যাখো আলোর তরঙ্গ জ্বলে, আলো–
সকালে দুপুরে সারাদিন।
স্বর্গের তটিনী জ্বলে, আলো জ্বলে, আলো,
যেখানে দাঁড়াও।
কে বড়বাজারে যাবে, দু’ গজ মার্কিন এনে দিয়ো;
কে যাও পারস্যে, এনো সুন্দর গালিচা;
কে যাও তটিনীতীরে স্বর্গের পুতুল,
কিছুই এনো না, তুমি যাও।