বৃষ্টিতে নিজের মুখ
অরণ্য, আকাশ, পাখি, অন্তহীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে–
আকাশ, সমুদ্র, মাটি, অন্তহীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে–
সমুদ্র, অরণ্য, পাখি, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
যতই ঘোরাও, আমি কী নতুন দেখব জাদুকর?
যেন দূরদেশে কোন্ প্রভাতবেলায়
যেতে গিয়ে আবার ফিরেছি
আজন্ম নদীর ধারে, পরিচিত বৃষ্টির ভিতর।
যেন সব চেনা লাগে। ফুল, পাতা, কিউমুলাস মেঘের জানালা,
সটান সহজ বৃক্ষ, গ্রামের সুন্দরী, আর
নানাবিধ গম্বুজ মিনার।
যেন যত দৃশ্য দেখি আয়নার ভিতরে,
উদ্ভিদ, মানুষ, মেঘ, বিকেলবেলার নদী–
বৃষ্টির ভিতরে সব দেখা হয়, সব
নিজের মুখের মতো পরিচিত। আমি
এই পরিচিত দৃশ্য করবার দেখবে জাদুকর?
আয়নায় জলের স্রোত, অন্তহীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
উদ্ভিদ, মানুষ, মেঘ, অন্তহীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে–
হাতের আমলকীমালা, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
যতই ঘোরাই, আমি কী নতুন দেখব জাদুকর?
বৃষ্টির ভিতরে সব দেখি যেন, আমি
আজন্ম নদীর ধারে, প্রাচীন ছায়ায়
পাহাড়, গম্বুজ, মেঘ, গ্রামের বালিকা,
দেবালয়, নদীজলে বশংবদ দৃশ্যের গাগরি–
দেখে যাই, যেন সব বৃষ্টির ভিতরে দেখে যাই।
যখন প্রত্যকে আজ দ্বিতীয় স্বদেশে
চলেছে, তখনও দেখি আয়নার ভিতরে জলধারা
নেমেছে রক্তের মতো। যাবতীয় পুরানো দৃশ্যের
ললাটে রক্তের ধারা বহে যায়। আমি
পুরানো আয়নায় কাঁচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
নিজের রক্তাক্ত মুখ কত আর দেখব জাদুকর?
বয়ঃসন্ধি
কে কোন্ ভূমিকা নেব, কে কার বান্ধব হব, এইবারে সব
জানা যাবে বেতার-বার্তায়।
পুরনো বন্ধু ও পুঁথি, ইজের-কামিজ-ধুতি-প্যাণ্টের করুণ কলরব
শেষ হয়ে যায়
এখন মরিচা-পড়া সমস্ত পুরনো তালাচাবির গরব
মৎস্যের আহার হতে চায়।
এখন আমরা এক ভিন্ন লোকালয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছি।
এখন আমরা যেন আর-এক-সময়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছি।
এখন আমরা যেন ভয়ে-ভয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছি।
আমাদের বন্ধুগুলি ক্রমে যেন আমাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতার
বন্ধু হয়ে যায়।
ক্রমেই আঁটসাঁট হয় আমাদের পাতলুন-পাঞ্জাবি।
নামের অক্ষরগুলি মুছে দিয়ে আদি নির্মাতার
আমাদের পুঁথিপত্র ধীরে-ধীরে যেন সব তাৎপর্য হারায়।
এখন মরিচা-পড়া আমাদের তোরঙ্গের চাবি
শুয়ে আছে মৎস্যের পাড়ায়।
ভিতর-বাড়িতে রাত্রি
রাত্রি হলে একা-একা পৃথিবীর ভিতর-বাড়িতে
যেতে হয়।
সারাদিন দলবদ্ধ, এখানে-ওখানে ঘুরি-ফিরি,
বাজারে বাণিজ্যে যাই;
মাঝে-মাঝে রোমাঞ্চিত হবার তাগিদে
সামান্য ঝুঁকিতে বসি তাসের আড্ডায়;
কেউ বা তিন-আনা যেতে; কেউ হারে।
রাত করলে সবাই উঠে যায়।
মাথায় কান-ঢাকা, টুপি, পায়ে, মোজা, বারোটা-রাত্তিরে
জানি না কোথায় যায় দুরি তিরি রাজা ও রমণী।
আমি যাব ভিতর-বাড়িতে।
ভিতর-বাড়ির রাস্তা এখনও রহস্যময় যেন।
এত যে বয়স হল, তবুও অচেনা লাগে।
কোথায় কবাট-জানালা, উঠোন, মন্দির, কুয়োতলা,
কুলুঙ্গি, ঘোরানো সিঁড়ি, বারান্দা, জলের কুঁজো।
কোথায় ময়নাটা ঠায় রাত্রি জাগে।
বুঝবার উপায় নেই কিছুই, অন্তত আমি কিছুই বুঝি না।
বাড়িটা ঘুমের মধ্যে হানাবাড়ি। তবু
দুয়ার ঠেললেই কেউ ভীষণ চেঁচিয়ে উঠবে, এখন আশঙ্কা হয়।
দুয়ার ঠেলি না, আমি সারা রাত্রি দেখি
খরস্রোত অন্ধকার বয়ে যায় ভিতর-বাড়িতে।
মল্লিকার মৃতদেহ
উদ্যানে গিয়েছি আমি বারবার। দেখেছি, উদ্যান
বড় শান্ত ভূমি নয়। উদ্যানের গভীর ভিতরে
ফুলে-ফুলে
তরুতে-তরুতে
লতায়-পাতায়
ভীষণ চক্রান্ত চলে; চক্ষের নিমেষে খুন রক্তপাত
নিঃশব্দে সমাধা হয়। উদ্যানের গভীর ভিতরে
যত না সৌন্দর্য, তার দশ গুণ বিভীষিকা।
উদ্যানে গিয়েছি আমি বারবার। সেখানে কখনও
কেহ যেন শান্তির সন্ধানে আর নাহি যায়।
যাওয়া অর্থহীন; তার কারণ সেখানে
কিছু ফুল
নিতান্ত নিরীহ বটে, কিন্তু বাদবাকি
ফুলেরা হিংসুক বড়, আত্মরূপরটনায় তারা
যেমন উৎসাহী, তত বলবান, হত্যাপরায়ণ।
উদ্যানে গিয়েছি আমি বারবার। সেখানে রূপের
অহঙ্কার ক্ষমাহীন। সেখানে রঙের
দাঙ্গায় নিহত হয় শত-শত দুর্বল কুসুম।
আজ প্রত্যুষেই আমি উদ্যানের বিখ্যাত ভিতরে
মল্লিকার মৃতদেহ দেখতে পেয়েছি।
চক্ষু বিস্ফোরিত, দেহ ছিন্নভিন্ন, বুক
তখনও কি উষ্ণ ছিল মল্লিকার?
কার নখরের চিহ্ন মল্লিকার বুকে ছিল,
কে হত্যা করেছে তাকে, কিছুই জানি না।
কিন্তু গোপালের লতা অতখানি এগিয়ে তখন
পথের উপরে কেন ঝুঁকে ছিল?
এবং রঙ্গন কেন আমাকে দেখেই
অত্যন্ত নীরবে
হঠাৎ ফিরিয়ে নিল মুখ?
আমার বাগানে আরও কতগুলি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে?
মাটির মুরতি
তার মূর্তিখানি আজ গলে যায় রক্তের ভিতরে।
কাদায় বানানো মূর্তি; ললাট, নাসিকা,
চোয়াল, ওষ্ঠের ডৌল, নাভিমূল
ধীরে গলে যায়। চক্ষু গলে যায়। সব নির্মাণের
জোড় একে-একে আজ খুলে আসে। দম্ভের, ক্ষমার,
চতুর ফন্দির, শান্ত করুণার, হিংসার, প্রেমের
সমস্ত কড়ি ও বর্গা খসে পড়ে। যতনে যোজিত
উপাদানগুলি আজ পাতালগঙ্গায়
ভেসে যেতে থাকে। তার কাদার শরীর
মেদ মাংস ধীরে ধীরে রক্তের ভিতরে গলে যায়।
স্মৃতির ভিতরে কেউ পা ঝুলিয়ে কখনও বোসো না।
স্মৃতি বড় ভয়াবহ। স্মরণের গভীর পাতালে
লেগেই রয়েছে দাঙ্গা, খুন, রাহাজানি। নিশিদিন
স্মরণের গভীর পাতালে
রক্তের ভীষণ ঢেউ বহে যায়। পাহাড়প্রমাণ ঢেউ
স্মৃতির পাতাল থেকে উঠে আসে।
উঠে এসেছিল আজ। চোখের সমুখ থেকে
আর-একটি মূর্তিকে তারা লুফে নিয়ে গেল।
কাদায় বানানো মূর্তিখানি আজ পাতালগঙ্গায়
ভেসে চলে। ললাট, নাসিকা,
চোয়াল, কণ্ঠার হার, নাভিমূল, যতনে যোজিত
মাটির পেরেক-বল্টু রক্তের ভিতরে গলে যায়।