নিয়ন-মণ্ডলে, অন্ধকারে
যে যার জিজ্ঞাসাগুলি এবারে গুছিয়ে নাও।
কেননা, আর সময় নেই।
বিকেল-পাঁচটায় আমরা নিয়ন-মণ্ডলে যাব।
সেখানে সেই পৌঢ় পালোয়ানের সঙ্গে আমাদের
খুব জরুরি একটা অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট আছে,
তিন বছর আগে যাঁর শেষ প্রেস-কনফারেন্সে
আমরা উপস্থিত ছিলাম। এবং
নরম ডাঁটা দিয়ে ইলিশমাছের পাতলা ঝোল খেতে তাঁর ভাল লাগে কি না
এই প্রশ্নের উত্তরে যিনি বলেছিলেন,
“দিবারাত্রি কবিতা লেখাই আমার হবি।”
ঢোলা-হাতা মলমলের কামিজ পরনে
নিয়ন-মণ্ডলে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আমাদের দেখেই তিনি ভীষণভাবে ডানা ঝাপটাতে লাগলেন এবং
তৎক্ষণাৎ সেই মুরগির উপমা আমাদের মাথায় এল,
যে কিনা এক্ষুনি একটা ডিম পাড়তে ইচ্ছুক।
কিন্তু ডিম না-পেড়েই তিনি বললেন,
“আগে কি তোমরা একটা ওমলেট খেতে চাও?”
আমরা বললুম, “না।
তার চাইত আপনার উপলব্ধির কথাটাই বরং বলুন।”
শুনে তিনি হাস্য করলেন। এবং
বুকের ভিতরে তাঁর চতুর্দশ উজ্জ্বল বাতিটা
জ্বালিয়ে তিনি জানালেন,
“চিরকাল নিয়ন-মণ্ডলে
অনেক কঠিন কাণ্ড দেখা যায়। তবু
পাতলুনের দক্ষিণ পকেটে
বাঁ হাত ঢোকাবার চাইতে
কঠিন সার্কাস কিছু নেই।”
বাতিগুলি তখন দপদপ করে নিভে গেল।
দেখে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,
আর্ত গলায় বললেন, “আমাকে একটা আয়না দাও,
এক্ষুনি আমি আমার মুখ দেখব।”
কিন্তু তাঁর পিসিমা তাঁকে বলে দিয়েছিলেন যে,
অন্ধকারে কখনও নিজের মুখ দেখতে নেই।
তাই তিনি মুখ দেখলেন না;
তার বদলে একটি কবিতা প্রসব করলেন।
তার আরম্ভটা এই রকম :
‘অন্ধকারে কোথায় অশ্রুর
ধারা বহে যায়।
কে যেন নিজের মুখ চিরকাল দেখতে চেয়েছে
নিয়ন-মণ্ডলে, অন্ধকারে!’
নীরক্ত করবী
আমরা দেখি না, কিন্তু অসংখ্য মানুষ একদিন
পূর্বাকাশে সেই শুদ্ধ উদ্ভাস দেখেছে,
যাকে দেখে মনে হতো, নিহত সিংহের পিঠে গর্বিত পা রেখে
স্বর্গের শিকারী দাঁড়িয়েছে।
আমরা এখন সেই উদ্ভাস দেখি না।
এখন রোদ্দুর দেখে মনে হয়, রোদ্দুরের পেটে
এখন আঁধার রয়ে গেল।
যেহেতু উদরে অম্ল, রক্তে বমনের ইচ্ছা নিয়ে
তবুও সহাস্যে হাঁটে সুবেশ যুবক,
যেহেতু শয়তান তার শখ
মেটাবার জন্য পারে ঈশ্বরের মুখোশ ভাঙাতে,
অতএব অন্ধকার রাতে
মায়াবী রোদ্দুর দেখা অসম্ভব নয়।
রৌদ্রের বাগানে রক্তকরবীনিচয়
ফুটেছে, ফুটুক।
আমি রক্তকরবীর লজ্জাহীন প্রণয়ে যাব না।
এখন যাব না।
রৌদ্র যে মুখোশ নয়, ঈশ্বরের মুখ,
আগে তা সুস্থির জেনে নেব।
না-জেনে এখনই আমি বাহির-দুয়ারে দাঁড়াব না।
পুতুলের সন্ধ্যা
আবার সহজে তারা ফিরে আসে আষাঢ়-সন্ধ্যায়।
তারা ফিরে আসে। কাগজের
সানন্দ তরণী, সাদা মাটির বিড়াল–
মুখে মস্ত ইলিশের পেটি। ফিরে আসে
কাঠের জিরাফ, সিংহ, কাকাতুয়া, আহ্লাদী পুতুল;
উড়ন্ত কিন্নরী; খড়কুটা ও কাপড়ে
ফাঁপানো ভীষণ মোটা শাশুড়ি, তরুণী বধু, ফুল, লতাপাতা;
কুরুশ-কাঁটার পদ্ম। একদা ফিরতেই হবে
জেনে সকলেই তারা আষাঢ়-সন্ধ্যায়
সহজ খুশিতে ফেরে ‘মনে-রেখো’-ছবির শৈশবে।
সবাই সহজে ফেরে। সময়ের কাঁটা
ঘুরিয়ে আবার যেন শৈশব-দিবসে ফেরা বড়ই সহজ।
কাঠের আলমারি কিংবা কলি-না-ফেরানো
দেওয়ালের শূণ্য জমি আষাঢ়-দিবসে
আবার সহজে তাই ভরে ওঠে, উপ্সরা-কিন্নরী-
জিরাফ-শাশুড়ি-বউ-সিংহ-কাকাতুয়ার বিভায়।
যেন অনায়াসে কোনো প্রাচীন জনতা
সমস্ত আইন ফাঁকি দিয়ে
সন্ধ্যার চৌরঙ্গি রোড একে-একে নির্বিকার পার হয়ে যায়–
সহজ আনন্দে, হাতে হ্যারিকেন-লণ্ঠন ঝুলিয়ে।
প্রেমিকের ভূমি
চুলের ফিতায় ঝুল-কাঁটাতারে আরও একবার
শেষবার ঝাঁপ দিতে আজ
বড় সাধ হয়। আজ দুর্বল হাঁটুতে
আরও একবার, শেষবার,
নবীন প্রতিজ্ঞা, জোর অনুভব করে নিয়ে ধ্বংসের পাহাড়
বেয়ে টান উঠে যেতে ইচ্ছা হয়
মেঘলোক। মনে হয়, স্মৃতির পাতাল কিংবা অভ্রভেদী পাহাড়ের চূড়া
ব্যতীত কোথাও তার ভূমি নেই।
প্রেমিকের নেই। তাই অতল পাতালে
অথবা পাহাড়ে তার দৃষ্টি ধায়।
মনে হয়, অন্ধকারে কোটি জোনাকির শবদেহ
মাড়িয়ে আবার ঝুল-কাঁটাটারে চুলের ফিতায়…
ভীষণ লাফিয়ে পড়ি। অথবা হাঁটুতে
নবীন রক্তের জোর অনুভব করে নিয়ে যুগল পাহাড়
ভেঙে উঠে যাই মেঘলোকে।
আরও একবার যাই, আরও একবার, শেষবার।
বাঘ
আঁচড়িয়ে কামড়িয়ে ফেঁড়ে কাণ্ডটাকে ফুলন্ত গাছের
তখনও দাউ-দাউ জ্বলে রাগ।
চিত্রিত বিরাট বাঘ।
ফিরে যায় ঘাসের জঙ্গলে। থেকে-থেকে
শরীরে চমকায় জ্বালা। দূরের কাছের
ছবিগুলি স্থির পাংশু! ত্রিজগৎ নিশ্বাস হারায়
চলন্ত হলুদ-কালো চিত্রখানি দেখে।
বাঘ যায়। বনের আতঙ্ক হেঁটে যায়।
বাঘ যায়। অন্ধকার বনের নিয়তি।
চিত্রিত আগুনখানি যেন ধীরে-ধীরে
হেঁটে যায়। প্রকাণ্ড শরীরে
চমকায় হলুদ জ্বালা। বড় জ্বালা। শোণিতে শিরায়
যেন ঝড়-বিদ্যুতের গতি
সংবৃত রাখার জ্বালা বুঝে নিতে-নিতে
বাঘ যায়। বনের আতঙ্ক হেঁটে যায়।
আমরা নিশ্চিন্ত বসে বাঘ দেখি ডিস্নির ছবিতে।
বার্মিংহামের বুড়ো
“ফুলেও সুগন্ধ নেই। অন্ততঃ আমার
যৌবনবয়সে ছিল যতখানি, আজ তার অর্ধেক পাই না।
এখন আকাশ পাংশু, পায়ের তলায় ঘাস
অর্ধেক সবুজ, নদী নীল নয়। তা ছাড়া দেখুন,
স্ট্রবেরি বিস্বাদ, মাংস রবারের মতো শক্ত। ভীষণ সেয়ানা
গোরুগুলি। বালতি ভরে দুধ
দেয় বটে, কিন্তু খুব জোলো দুধ। নির্বোধ পশুও
দুগ্ধের ঘনতা আজ চুরি করে কী অবলীলায়।
এদিকে মদ্যও প্রায় জলবৎ। আগে
দু-তিনটে বিয়ার টেনে অক্লেশে মাতাল হওয়া যেত।
ইদানিং কম করেও পাঁচ বোতল লাগে।”
বার্মিংহামের সেই বুড়োটার লাগে। যে সেদিন
ফুল নদী ঘাস মেঘ আকাশ স্ট্রবেরি
মাংস দুধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে ভীষণ
অভিযোগ তুলেছিল। যার বিধ্বস্ত মুখের ভাঁজে তিলমাত্র করুণা ছিল না,
উদরে সক্রিয় ছিল পাঁচ বোতল ঘোলাটে বিয়ার।