জীবনে একবারমাত্র
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–যেন বুকের ভিতরে
ভীষণ শোরগোল ওঠে। শুনতে পাই
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–যেন
তটভূমি ধসে পড়ছে, ছলোচ্ছল ছলোচ্ছল
ঢেউ লাগছে নিরুপায় নৌকায়। রক্তের
পাতালবাহিনী নদী হঠাৎ ভীষণভাবে
ফুলে ফেঁপে ওঠে।–আমি বালকবয়সে
ট্রেনের কামরায় কোনো বৃদ্ধ ফিরিঅলাকে একবার
আশ্চর্য মলম হাতে দারুণ বাঘের মতো চেঁচাতে শুনেছি
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–আমি
ঘাটশিলার হাটে এক লালাকে একবার
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’ বলে অসম্ভব পুরনো পেঁয়াজ
বিক্রি করে হাসতে দেখেছি!–আমি
মফস্বল-শহরে একবার
ঘণ্টা-হাতে সার্কাসের তাঁবুর বাইরে কাকে গম্ভীর গলায়
অন্ধকারে বলতে শুনেছি
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–আমি গঙ্গার জেটিতে
সন্ধ্যায় লঞ্চের দড়ি তুলে নিতে-নিতে এক প্রাবীণ মাল্লাকে যেন জীবনে একবার
ভয়ঙ্কর আত্মমগ্ন বলতে শুনেছি
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–কিন্তু বুকের ভিতরে
এই যে প্রলয়রোল শুনতে পাওয়া গেল–কোনো বৃদ্ধ ক্যানভাসার,
ধূর্ত লালা, সার্কাসের দালাল অথবা
মাল্লার গলার সঙ্গে এর কোনো তুলনা হয় না।
জীবনে একবারমাত্র। রক্তের ভিতরে
জীবনে একবারমাত্র ‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’ এই বন্য মহারোল
শুনতে পাওয়া যায়, আমি শুনতে পাচ্ছি
‘লাস্ট টাইম! লাস্ট টাইম!’–যেন
নিরুপায় নৌকার শরীরে
ছলোচ্ছল ছলোচ্ছল ঢেউ লাগছে। যেন
রক্তের পাতালগঙ্গা, দাঁড়ি-মাঝি-বৈঠা-হাল ইত্যাদি সমেত,
ভীষণ পাক খেতে-খেতে, ভীষণ পাক খেতে-খেতে
জলস্তম্ভ হয়ে গিয়ে ফুলে-ফেঁপে হঠাৎ স্বর্গের দিকে
দৌড়ে উঠে যায়।
তর্জনী
তর্জনী দেখিয়ে কেন কথা বলো…কখনও বলবে না…
কাকে…তুমি ভয় দেখাও কাকে…
আমি অনায়াসে সব ভেঙে ফেলতে পারি…
মুহূর্তে তছনছ করে দিতে পারি সবকিছু…
বাঁ পায়ের নির্দয় আঘাতে আমি সব
মুছে ফেলতে পারি…
তর্জনী দেখিয়ে কেন কথা বলো…কখনও বলবে না…
ভীষণ চমকিয়ে দিয়ে দশটার এক্সপ্রস চলে গেল।
পরক্ষণে পৃথিবী নীরব।
তারের উপরে বাজে হাওয়ার শাণিত ভাষা, আর
মিলায় চাকার শব্দ…তর্জনী দেখিয়ে কেন…
তর্জনী দেখিয়ে কেন…
যেন-বা হুড়মুড় শব্দে স্বপনের বাড়িটা
ভেঙে পড়তে গিয়ে টাল সামলে নিয়ে এখন আবার
অতল নয়নজলে জেগে রয়।
তোমাকে নয়ু
যেন কাউকে কটুবাক্য বলবার ভীষণ
প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাক নয়।
যেন যত দুঃখ আমি পেয়েছি, এবারে
চতুর্গুণ করে তাকে ফিরিয়ে দেবার
প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাকে নয়।
দুই চক্ষু ভেসে গেল রক্তের ধারায়।
দমিত আক্রোশে খুঁড়ি নিজের পাতাল।
দ্যাখো আমি যন্ত্রণায় দাউ-দাউ আগুনে
জ্বলে যাচ্ছি, নেমে যাচ্ছি হিংসার নরকে।
যেন আত্মনিগ্রহের নরকে না-গিয়ে
সমস্ত যন্ত্রণা আজ ফিরিয়ে দেবার
প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু না, তোমাকে নয়; কিন্তু না, তোমাকে নয়…
নরকবাসের পর
১.
তোমরা পুরানো বন্ধু। তোমরা আগের মতো আছ।
আগের মতোই স্থির শান্ত স্বাভাবিক।
দেখে ভাল লাগে।
প্রাচীন প্রথার প্রতি আনুগত্যবশত তোমরা
এখনও প্রত্যহ দেখা দাও,
কুশল জিজ্ঞারা করো আজও।
দেখে ভাল লাগে।
তোমরা এখনও সুস্থ অনুগত আলোকিত আছ।
তোমরা পুরনো বন্ধু। অমিতাভ স্নেহাংশু অমল।
তোমরা এখনও
সুস্থির দাঁড়িয়ে আছ আপনি জমিতে।
সাঁইত্রিশ বছর তোমরা আপন জমিতে
দাঁড়িয়ে রয়েছ সুস্থ মাননীয় বৃক্ষের মতন।
দেখে ভাল লাগে।
আমি নিজে সুস্থ নই, সূর্যালোকে সুন্দর অথবা।
২.
আমি নিজে সুস্থ নই, আলোকিত সুন্দর অথবা।
আমি এক সুদূর বিদেশে,
অতি দূর অনাত্মীয় আঁধার বিদেশে
বৃথাই ঘুরেছি
দীর্ঘ দশ বছর, অমল।
অমল, তুমি তো রৌদ্র হতে চেয়েছিলে;
স্নেহাংশু, তোমার লক্ষ্য আকাশের অব্যয় নীলিমা;
তুমি অমিতাভ, তুমি জলের তরঙ্গ ভালবাসো।
আমি দীর্ঘ এক যুগ রোদ্দুরের ভিতরে যাইনি।
আকাশ দেখিনি।
সমুদ্র দেখিনি।
কী করে আকাশ তার মুখ দেখে সমুদ্রে–দেখিনি।
আমি এক আঁধার বিদেশে
চোখের সমস্ত আলো, বুকের সাহস,
দেহের সমস্ত স্বাস্থ্য তিলে-তিলে বিসর্জন দিয়ে,
দিনকে রাত্রির থেকে পৃথক জা-জেনে
দিন কাটিয়েছে।
৩.
আঁধার বিদেশ থেকে কখনও ফেরে না কেউ। আমি
আবার ফিরেছি।
ফ্যাকাশে চামড়া, চোখে মৃত মানুষের দৃষ্টি নিয়ে
ফিরেছি আবার আমি অমিতাভ, স্নেহাংশু, অমল।
এবং দেখেছি তোমাদের।
তোমার পুরানো বন্ধু। তোমরা আগের মতো আছ।
দেখে ভাল লাগে।
তোমরা এখনও সুস্থ অনুগত আলোকিত আছ।
দেখে ভাল লাগে।
আমিও আবার স্থির সুস্থ স্বাভাবিক হতে চাই।
আতি আমি ফিরেছি আবার
অমিতাভ, স্লেহাংশু, অমল।
তাই তোমাদের কাছে আবার এসেছি।
তিনটি জীবন্ত চেনা মানুষের কাছে
এসে দাঁড়িয়েছি।
উপরে আকাশ, নীচে অনন্ত সুন্দর জলরাশি,
পিছনে পাহাড়,
শোণিতে দৃশ্যের আলো জ্বলে।
আমি এইখানে এই বান-ডাকা রৌদ্রের বিভায়
অবিকল মাননীয় বৃক্ষের মতন
দু’ দণ্ড দাঁড়াব।
স্বাস্থ্য ফিরাবার জন্য এখন খানিক পথ্য প্রয়োজন হবে।
আমি এইখানে এই সমুদ্রবেলায়
অফুরন্ত নীলিমার নীচে
প্রত্যহ এখন যদি একগ্লাস টাট্কা রোদ খেয়ে যেতে পারি,
তবে আমি সুস্থ হয়ে যাব।
নিদ্রিত, স্বদেশে
পেটে-আসছে-মুখে-আসছে না, সেই কথাটা, সেই
হঠাৎ-শুনতে-পাওয়া কথাটা আমি
ভুলে গিয়েছি।
যে-কথা অস্ফুট স্বরে তুমি একদিন
যে-কথা অর্ধেক রাত্রে তুমি একদিন
সে-কথা স্বপ্নের মধ্যে তুমি একদিন বলেছিলে।
স্বপ্নের মধ্যে কেউ যখন কথা বলে,
তখন তাকে খুব অচেনা মানুষ বলে মনে হয়।
তখন তার নিদ্রিত মুখের দিকে তাকালে আমার মনে হয়,
অনেক বড়-বড় সমুদ্র পেরিয়ে, তারপর
অনেক উঁচু-উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে, তারপর
সুদীর্ঘ প্রবাস-জীবনের শেষে সে তার স্বদেশে ফিরেছে।
একমাথা রুক্ষ চুল, পায়ে ধুলো,
ঘুমের মধ্যে সে তার স্বদেশে ফিরেছে।
ঘুমের মধ্যে সে তার আপন ভাষায় কথা বলছে।
প্রিয় গাভীটির গলকম্বলে হাত বুলোতে-বুলোতে
খুব গভীর স্বরে সে তার বাড়ির লোকজনদের জিজ্ঞেস করছে,
সে যখন বিদেশে ছিল, তখন তার
আঙুল-বাগানোর পরিচর্যা ঠিকমতো হত কি না, তখন তার
খেতের আগাছা ঠিকমতো নিড়িয়ে দেওয়া হত কি না, তখন তার
গ্রামে কোনও বড়-রকমের উৎসব হয়েছিল কি না।
ঘুমের মধ্যে কি এসব প্রশ্ন করেছিলে তুমি?
আমার মনে নেই।
পেটে-আসছে-মুখে-আসছে না, সেই কথাটা, সেই
হঠাৎ-শুনতে পাওয়া কথাটা আমি
ভুলে গিয়েছি।
যে-কথা অস্ফুট স্বরে তুমি একদিন
যে-কথা অর্ধেক রাত্রে তুমি একদিন
যে-কথা স্বপ্নের মধ্যে তুমি একদিন বলেছিলে।